You dont have javascript enabled! Please enable it! মনে পড়ে - অরুণ বাগচী - সংগ্রামের নোটবুক

মনে পড়ে — অরুণ বাগচী

বাংলাদেশের হৃদয় থেকে অমৃতের সন্তানেরা মুক্তির মন্ত্রপাঠ করে চলেছে, আর আমার শৈশবের শিকড় পর্যন্ত স্মৃতিশিহরিত হচ্ছে। ব্রাহ্মণরা নাকি দুবার জন্মায়। আমরা, যারা পূর্ব বাংলার অতীতকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি, বর্তমানকে আটকে দিয়েছি পশ্চিম-বাংলা-র ফ্রেমে, আমরা সবাই আজ এই দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করলাম।  যখন বাংলাদেশ একটাই ছিল, ছােটবেলায়, দূর আসামে বসে প্রতি বছর বড় ছুটির দিনে আমি লােভে কম্পমান হতাম। কোথায় যাব ছুটি কাটাতে? মামাবাড়ির গ্রামে? পাবনা জেলার সেই বর্ধিষ্ণু ছবির মত গ্রামের শান্তিতে? না, যাব ইন্দ্রপুরী কলকাতায়? চিড়িয়াখানা, জাদুঘর, গড়ের মাঠ, আইস্ক্রীম, বায়স্কোপের আসরে? সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত নিতেন বাবা। আমি শুধু মনে মনে একবার খালবিল আমবন, আর একবার বাঁধানাে ফুটপাথ ধরে চলতাম।

সেই কলকাতা আজ অভ্যেসে ব্যবহারে মলিন। পূর্ববঙ্গের সেই গ্রাম আজও তরুণ, শ্যামল, স্নিগ্ধ। বাউল গানের সেই কলির মত- ফুটলাে কমল, টলটলাটল, রাত্রের শিশির জল গাে! মামাবাড়ির অন্দর থেকে বাইরের মহলে আসতে পড় মুক্ষুদি (মােক্ষদাদি)র বারান্দা। সেখানে যেন কেবলি রােদ। সেই রােদে কেবলি আমসত্ব বা লােভনীয় আঁচার মুখােচ্ছে। দেখে জিভে জল আসত; কিন্তু মুক্ষুদির মন গলত না। একমাত্র আপীলের জায়গা ছিল দিদিমার। দরবার, সেখানে মামলায় সহজেই জিত হত। মামলা চলাকালে সর্দি কাশির ধমকটা সামলে রাখতে হত অবশ্য। মুক্ষুদির ঘরের পাশেই বেল গাছ। সেখানে এক জোড়া ব্ৰহ্মদৈত্য বাস করতেন। স্নানের ইচ্ছে হলে তারা আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামিয়ে নিতেন। আর চাঁদের আলােয় খড়ম-মেলে রেখে পুকুর পার ধরে রেস দিতেন উভয়ে। ধূলাে উড়ে কুয়াশা জমত জলের  উপর। সেটা রােজ সকালে দেখতে পেতাম। কিন্তু দৌড়বাজদের কখনও দেখিনি। ভাদুড়ি বাড়ির মেজবাবু নাকি দেখেছেন কয়েকবার। আর পোেস্টমাস্টারবাবু। তিনি বােতলে করে লাল-জল নিয়ে ফিরছিলেন। তাঁকে দাঁড় করিয়ে তেষ্টা মেটাতে চেয়েছিলেন ওনারা। মাস্টারবাবু যতই বলেন- “এ জল খাবেন না, এটা খারাপ জল। আপনাদের যুগ্যি নয়”- তটা তারা জিদ করেন। এবং খাওয়ামাত্র, ও, সে কী কাণ্ড” বলেই মাস্টারবাবু থেমে যেতেন। হাজার অনুরােধেও মুখ খুলতেন না। অগত্যা আমরা লালজল খাবার বায়না তুলতাম। বড়রা সবাই উচ্চহাস্য করতেন।

-শীতকালে পুকুরে নৌকা ডােবান থাকত। বর্ষার আগে তুলে নিয়ে তাকে গাব ঘষা হত। কয়েক খালুই মাছ ধরা পড়ত। মাছ আর গাবের গন্ধে নাকে জল হুড়হুড় করে বাঁধানাে নালা বেয়ে মাঠের উপচে পড়া জল পুকুরে নামত। মাঠঘাট সব জল, পানায় ডুবে গ্রামটা দিব্য একটি দ্বীপ বনে যেত। তখন সেই উল্লাপাড়া রেল স্টেশনে যেতে হলে নৌকা চড়ে যাও। .

গ্রামের কত লােককে মনে পড়ে। থিয়েটারে ভীম সেজে মুকুলমামার সেই কাকস্থলী বিকস্থলী- মাকন্দীবারণাবত আর একখানি গ্রাম —- টেনে টেনে উচ্চারণ। কুন্ডী সেজে বুড়ােমামা কী কান্নাটাই কাদাতেন মা-মাসী-দিদিদের। নস্যি ওড়াতে ওড়াতে চান্দাবাসী হেড স্যার স্কুলের পথে চলেছেন। পাঁচুর মিষ্টির দোকানে, ছানার ছড়াছড়ি। ধামায় মুড়ি খাচ্ছি, “মাঠা” বেচতে এল পাশের গা থেকে। খাটা পায়খানার দিক থেকে ডাহুক পাখীর ডাক ভেসে আসছে তাে আসছেই। সব মনে পড়ে। অথচ আশ্চর্য, গায়ের মুসলমানদের নাম মনে পড়ে না কেন? তারাই তাে সংখ্যায় বেশি ছিল। তবু, তারা যেন কেউ না। গানের আসরে না, পূজার ভাসানে না, স্কুলের ম্যাচে না। তারা কোথায় লুকিয়ে থাকত? ধানের ক্ষেতের সবুজে সবুজ লুঙ্গী পরে তারা হাওয়ায় ভাসত শুধু? আলের পিঠ বেয়ে তারা চলে যাচ্ছে এ ছবি মনে পড়ে। ইচ্ছে হয়; তাদের চেঁচিয়ে ডাকি।- বলি, কোথায় চলে যাচ্ছ সব? নামগুলাে বলে যাও। ধার দিয়ে যাও আমাকে তােমাদের নাম। বাড়ী এলে বারান্দায় সন্তর্পনে তারা বসে থাকত। তাদের কেবলি প্রার্থনা জানাতে শুনেছি। এই অভাব, ওই অভাব, এটা চাই, ওটা চাই। তারা দরিদ্র, বুঝতে পারতাম। আমরাও যে দেউলিয়া হয়ে যেতে বসেছি,  তা তখনও বুদ্ধিতে আসত না। এখনও, যখন ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে, তখনও দেখি কেউ কেউ বুঝতে পারেন না কে কী হল। এক বিকেলে শােভাযাত্রা গেল পুকুরধার দিয়ে। শাজাদপুরের মৌলভী সেই দঙ্গল লীড করে নিয়ে গেলেন জামিরতার দিকের মাঠে। শােভাযাত্রীরা গান গাইছিল। রাত্রে ঘুমােতে পারিনি। গলাটা যেন আমার কানে বাজছিল।

সেই গানের দলে ছিল আমার এক প্রিয় শিল্পী। পেশায় জেলে। কিন্তু সেটা ছদ্মবেশ। প্রায়ই এসে সেই ব্রহ্মদত্যির বেলগাছতলে গান শােনাত। এক হােন্নরায় (সােনারায়) এর করুণ কাহিনী সে বিয়ে করে অনেক “মান্য পেয়েছে। ছেড়া বালিস কথা, ফুটো সানকী বদনা, অচল কিছু পয়সা, খোড়া বউ। আর হ্যা “হহুর (শ্বশুর) বাড়ির কানা ঘােড়া তা-ও দাবড়াইছি।” গান শুনতাম, হাসতাম। আবার গায়কের জীর্ন পােষাক আর শীর্ণ দেহ দেখে চোখে জলও আসত। যদিও জানতাম তার নিজের নাম সােনারায় নয়, অন্যকিছু। সেটা কী, এটাই জানবার জন্য সে শােভাযাত্রায় গিয়েছিল?

৪ এপ্রিল, ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭