You dont have javascript enabled! Please enable it! বাড়ি যাচ্ছি- মনােজ বসু - সংগ্রামের নোটবুক

বাড়ি যাচ্ছি– মনােজ বসু

বাড়ি যাচ্ছি আমার মায়ের কোলে। কতকাল আজ মা-ছাড়া- স্বাধীনতা সৌভাগ্যের সেই পয়লা দিন থেকে। আমার চিরকালের গাঁ-গ্রাম ভিন্ন রাষ্ট্রে পুরে দিল। সাতপুরুষের ভিটাখানা চোখে দেখে আসবারও এক্তিয়ার নেই যেহেতু আমি বিদেশী এবং শত্রুপক্ষীয় । চেখে দেখিনি, কিন্তু চোখ বুজে খুঁজে নিত্যদিন দেখে থাকি। খালবিল, মাঠঘাট, গাছগাছালি, গরুবাছুর, খােড়ড়া বাড়ির বাংলাদেশ আমার জন্মকালের ধাত্রী, আমার বাংলা কিশাের, যৌবন-দিনের হাজার লক্ষ স্বপ্নকল্পনা জোনাকির মতন সে দেশে আজও জ্বলে আর নেভে, বাতাসে ভেসে বেড়ায়। মায়ের ডাক পাচ্ছি ওপার। থেকে, আমি বাড়ি চললাম। গােধূলির ছায়ান্ধাকারে গ্রাম নদীটি পার হয়ে আমি উঠোনে গিয়ে উঠব। সারাদিনের ধূলােমাটির গায়েগালি খেয়েছি, আবার আদরও পেয়েছি। আদর করে আপনারা শিরােপা পরিয়ে দিয়েছেন। তিরস্কার পুরস্কার। ক্লান্তি ঘাম মােছর মতন মুছে দিয়ে আমি বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি বন্ধু-শত্ৰু সকলের পায়ে প্রনাম নিবেদন করে। 

খেলাধূলাে অন্তে দিনের শেষে শিশু যেমন মায়ের কোলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে, খানিক কান্নাকাটি করে, কোলের মধ্যে বিভাের হয়ে ঘুমােয়। আমি ঘুমাবাে- ঐ লােভেই তাে মরি-মরি করে বেঁচে রয়েছি এতদিন। দূরের মা-জননী আজকের একেবারে আমার চোখের উপর। শ্যাম শােভা কোথায় গেছে মা, চারিদিক লালে লাল একেবারে। এই চৈত্র রক্তবরণ শিমূলে পলাশ গাছে গাছে আগুন ধরে আছে। পায়ের তলের মাটিও দগদগে রাঙা। রক্তাম্বর-ধারিণী মা আমার আলুথালু আচ্ছন্নের মতন এপারের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। অঙিনা জুড়ে খুনেরা হামলা দিয়ে বেড়াচ্ছে, ছেলেমেয়েরা একটুও তবু ভয় মানেনি। লক্ষ সন্তান তারিয়ে আমার। মায়ের এক চোখে অশ্রু আর এক চোখে আগুন। নিরক্ষর দীনাতিদীন বলে যাদের তাচ্ছিল্য করতাম, এ কোন আশ্চর্য মহিমায় তারা দ্যুতিমান হয়ে উঠেছেন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে একটি কি বিশ্বাসহন্তা কাপুরুষ নেই? হাইকোটের সর্বোচ্চ বিচারক থেকে হেঁড়া লুঙ্গিপরা নগণ্য গ্রাম্য চাষী-সকলে একটিমাত্র মুখে কথা, সে মুখ মুজিবরের । আমার সদর শহর যশােহরের অদূরে রেলের মাঠ নামে পতিত অনুর্বর একটা জায়গা-ছােট বয়স থেকে কতবার হেলাভরে তাকিয়ে পাশ দিয়ে চলে গেছি। লড়াইয়ের সময় সেই মাঠে প্লেন নামাবার একটুকু ব্যবস্থা হল। হতে হতে এরােড্রোম, কিছু দূরে ক্যানটনমেনট। আধুনিকতম মারণাস্ত্রে অগােপাস্তলা সজ্জিত হয়ে পাঞ্জাবী সামরিকচক্রের গােলামের সেখানে ঘাঁটি জমিয়ে বসেছে। কুষ্টিয়া থেকে বিজয়ী মুক্তিফৌজ ধেয়ে আসছে। মা তােমার মুখে তাকিয়ে কী আদেশ শুনে নিল সরল প্রাণ সামান্য সাধারণেরা- সবুর সইল না, লাঠি সরকি রামদা হাতের কাছে যে যা পেলাে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল রেলের মাঠে এরােড্রামের উপর মুক্তিফৌজের কাজটা এগিয়ে রাখবে তারা। মেশিনে যেমন-ধারা ফসল কাটে দেড় হাজার শহিদ হলেন ঐ একটা জায়গায়, একটু ক্ষণের ভিতরে। মাগাে, বাড়ির পথে আমার আশৈশব  অবহেলিত রেলের মাঠকে এবার সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করে যাবাে। 

পড়শিদের গিয়ে চিনতে পারবাে কি, আমার বড় ভয় করছে। সারা বেলান্ত খেটেও মুখের ভাত জোটাতে পারত না তারা, অত্যাচার-অবিচারে মূক মৌন খােদাতালাহু’র উপর বরাত দিয়ে ভারবাহী পশুর মত দিনাতিপাত করত। আজকে কী হয়ে গেছে-বিকীর্ণ ঘরে ঘরে চাঁদ-সূর্যের মেলা, মায়ের বীর সন্তানেরা প্রায়নিরস্ত্র হয়েও ভয় মানেনা- শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। শত্রু খতম করে, অথবা হেলায় প্রাণ দিয়ে দেয়। কি ভালাে বেসেছে তারা বাংলাদেশকে আকাশ ছাড়িয়ে মাথা উঁচু হয়ে উঠেছে, তাদের মুখে আমি কি উর্ধ্বমুখ হয়ে তাকাব? ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, মেয়ে লাঞ্ছিত, ছেলে তিনটে বেরিয়ে পড়েছে শত্রুর মুকাবেলায়- দুটো খতম খবর এসে গেছে, একটির খোজ নেই। মুরুব্বি কর্তা পড়শিদের সঙ্গে খাতকোদাল নিয়ে রাজপথে খানা খুঁড়তে লেগে গেছেন, আম্মা কেঁকিশালে পাড় দিচ্ছেন- ধান ভানা নয়, শুকনাে লঙ্কার গুড়াে নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবে, তাক বুঝে চলন্ত জীপে ছুঁড়ে ফৌজি মানুষকে অর্ধেক কানা করে দেবে।  রাজপথে সর্বত্র খানাখন্দ, বড় বড় গাছ উপড়ে ফেলে রেখেছে। রেলরাস্তা উপড়েছে, সাঁকোরপুল ভেঙে দিয়েছে। পাঁচ-সাত-দশ বছুরে ছেলে পথের ধারে গরু-ছাগল চরাচ্ছে। নিরীহ দৃষ্টি মেলে তাকায় নতুন মানুষ দেখলেই সচকিত হয়। তৃতীয় দৃষ্টি খুলে গেছে ওদের, কে শত্ৰু, কে মিত্র নজর ফেলেই ধরতে পারে। গরু ফেলে ছুটল অতএব গােপন ঘাঁটিতে খবর দিতে আর বন্ধু হল তাে অপথ-কুপথ ভেঙে গন্তব্য জায়গায় খবর পৌছে দিয়ে এলাে-আপন শক্তিতে যে জায়গা খুঁজে বের করা নতুন লােকের সাধ্যাতীত। আধুনিকা কলেজি মেয়ে, এই সেদিন অবধি অতি বড় শৌখিন মেয়ে বিশৃঙ্খলা বেশভূষা, হাঁটুভর ধূলাে, বিশুষ্ক মুখ, সে মুখে কতদিন ভাত ওঠেনি কে জানে। তপস্বিনী মূর্তি এরাও সব ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে। ফাস্ট ইয়ারের মেয়ে রােশনরা বেগম এদেরই একটি, বুকে যে মাইন বেঁধে শত্রুর প্যাটন ট্যাঙ্কের উপর ঝাপিয়ে পড়ল। ট্যাঙ্ক ঘায়েল হল সােনার মেয়ে নিজেও ছিন্নভিন্ন। আমি তােমাদের কোন সেবায় লাগতে পারি মা-জননীরা ক্ষুধার অন্ন? অঙ্গ বস্ত্র? মাথার উপরের আচ্ছাদন? তারা বলে, অস্ত্রঅস্ত্র দাও, অস্ত্র দাও- বলে হাজারে হাজারে হাত বাড়িয়ে ধরছে।

৪ এপ্রিল, ১৯৭১

আনন্দবাজার পত্রিকা

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭