You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.09 | বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরােধের শ্ৰেণীতত্ত্ব | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে সশস্ত্র প্রতিরােধের শ্ৰেণীতত্ত্ব

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদের বিবর্তন সম্পর্কে কিছু আলােচনা আগের সপ্তাহে দর্পণে প্রকাশিত হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে যে, বাঙালি মুসলমান জান কবুল করে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গড়ে তুলল হিন্দু জমিদার ও শিল্পপতিদের শােষণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য। কিন্তু নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে নতুন মুসলমান শশাষক শ্রেণী গড়ে উঠল। পশ্চিম পাকিস্তানের বড় জমিদার আর মূলধন খাটিয়ে মুনাফালােভীদের সমন্বয় এই শ্রেণীতে। এরা পূর্ববঙ্গে সমস্ত কিছু কজা করতে চাইল, ইসলামী ঐক্যের জিগীর তুলে। পূর্ব বাংলার মানুষ আস্তে আস্তে বুঝল যে, এই ধর্মের জিগীর শােষণ কায়েম রাখার ষড়যন্ত্রের এক অংশ। এই পরিপ্রেক্ষিতে জনাব সােহরাবর্দির (সােহরাওয়ার্দি) ছাপান্ন সালে গণপরিষদে বক্তৃতার কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি একেবারে মূলে চলে গেছেন এবং প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব ধােপে টেকে না, ধর্মনিরপেক্ষ শােষণমুক্ত রাষ্ট্র কাঠামাের দরকার আর এর জন্য প্রয়ােজন গণতন্ত্র কায়েম করার।
অর্থাৎ সােহরাবর্দি (সােহরাওয়ার্দি) বাঙালি নয়। কিন্তু দুর্বল পুঁজিবাদীদের মুখপাত্র হিসেবে গণপরিষদে সামন্ত শােষণ থেকে মুক্তির কথা বলেছেন, ধর্মীয় রাষ্ট্রের বদলে গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কথা বলেছেন। তখন থেকেই এই নয়া পুঁজিবাদীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকায়। লগ্নীর প্রয়ােজনীয় পুঁজির অভাবে এই নয়া পুঁজিবাদীরা তখনও শিল্পপতি হওয়ার চিন্তায় ব্যাকুল নয়। তারা চায় বাণিজ্য যাতে এর মারফত তাদের প্রয়ােজনীয় পুঁজি সৃষ্টি হতে পারে। তাই বার বার দাবি উঠেছে, পশ্চিম বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান প্রদানের বিধিনিষেধ রদ হওয়া দরকার। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এই ব্যবস্থায় রাজি হতে পারে নি, কারণ পূর্ব পাকিস্তানে বাণিজ্যে তাদের মােটা মুনাফা আসে। আর তা ছাড়া পূর্ব-পশ্চিম বাংলার বাণিজ্যিক আদান-প্রদানে পশ্চিমবঙ্গের পাট শিল্পের সুবিধা হবে এবং সেই অনুপাতে পশ্চিমীদের কজায় পাট শিল্পের উন্নতিতে বাধা সৃষ্টি হবে।
এভাবে নানা টানপােড়েনের মধ্যে পূর্ব বাংলায় নতুন রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ হতে থাকে। এতে চাষীরাও জড়িয়ে পড়ে, কারণ তারা তাদের ফসলের মাছের আর অন্যান্য কিছু কৃষিতে উৎপাদন হয় তার বেশি দাম পেতে ইচ্ছুক। পশ্চিম বাংলার সঙ্গে ব্যবসায়িক যােগাযােগে বড় মধ্য চাষীদের স্বার্থ আছে। এরা তাই বাঙালি নয়া পুঁজিবাদের স্বাতন্ত্রের দাবিতে সামিল। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের নতুন মধ্যবিত্ত সমাজও। তারাও বাঙালি বাজার বিস্তারের ফলে বর্ধিত সুযােগ-সুবিধার সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ।
তাই বাঙালি স্বাতন্ত্রের দাবিতে সকলে এগিয়ে আসে, গ্রামের ছােট বড় চাষী ও জমির মালিক, নয়া পুঁজিবাদ, মধ্যবিত্ত ও মেহনতি জনসাধারণ। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আসে প্রধানত এই জমির মালিক, নতুন পুঁজিবাদ ও মধ্যবিত্তের মধ্যে থাকে। ধনতন্ত্র বিকাশের প্রথম যুগে এরা অবশ্যই প্রগতিশীল। তাই আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদী ভূমিকা ঠিক মেহনতি মানুষের শ্রেণী সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে নি। কিন্তু তবুও এই ভূমিকা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধে বাধা স্বরূপ নয়। এমনকি প্রতিরােধ সশস্ত্র আকার নিলেও। যদি পুঁজিবাদী নেতৃত্ব আরও শক্তিশালী হত, যেমন ভারতবর্ষে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের যুগে ছিল তাহলে এই নেতৃত্ব সশস্ত্র প্রতিরােধের পথে কোনাে মতেই জনসাধারণকে নামতে দিত না। পশ্চিমীরাও নতুন রাষ্ট্রে উন্মুক্ত শােষণের সুযােগে আত্মহারা। তারা এখনও বুঝতে শেখে নি যে, শােষণকে মানুষের প্রতিরােধ থেকে বাচতে গেলে কিছু রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়ােজন আছে। ভারতের পুঁজিবাদীরা এদিক থেকে অনেক পােক্ত, তাদের এ ব্যাপারে কোনাে গােলমাল হয়নি। তাই পাকিস্তানে মুসলিম লীগের মততা, ভারতে কংগ্রেস পার্টি মানুষের আন্দোলনের মুখে লেজে গােবরে হয়ে যায় নি।
এই সূত্রে আবার বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ববিদ গুনার মিরডালের কথা বলতে হয়। তিনি বলেছেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার বৈষম্য নিহিত আছে এই দুই দেশে নেতৃত্বের শ্রেণী চরিত্রের বিভিন্নতায়। তাঁর বিখ্যাত বই ‘এশিয়ান ড্রামা’র প্রথম খণ্ডে ৩০৮-৩০৯ পাতার গুনার মিরডাল লিখেছেন :
‘স্বাধীনতাপূর্ব যুগে দেশ বিভাগের আন্দোলনে মগ্ন থেকে মুসলিম লীগ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতাে কোনাে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির কথা ভাবতে পারে নি। দেশ বিভাগের পর নতুন মুসলিম রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জন্য, হিন্দু শােষণ মুক্তি ছাড়া, আর কী করতে চায় সে সম্পর্কে কোনাে পরিষ্কার কথা আগে থেকে ভাবা হয়নি। মুসলিম লীগের বেশির ভাগ নেতাদের ভাবভঙ্গি কয়েক যুগ আগের বৃটিশ রক্ষণশীলদের সঙ্গে তুলনীয়। এই মুসলিম নেতারা নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রেখে একটি ধর্ম নিরপেক্ষ, কিয়দংশে আধুনিক এবং এমন কি প্রগতিশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থা সৃষ্টি করার ঝেকের আভাসও দিয়েছিল। এসব নেতারা সকলেই পাশ্চাত্য শিক্ষায় কিছুটা অনুপ্রাণিত। কিন্তু এই নেতৃত্বের প্রবল বিরােধিতা করেছে আরও বেশি রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িকতাবাদী মােল্লারা। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের এই দুই অংশই কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে প্রগতিশীল সংস্কারমূলক কর্মসূচির তীব্র বিরােধী।
‘মুসলিম লীগ নেতৃত্বের শ্রেণী চরিত্র থেকেই তার রাজনৈতিক রক্ষণশীলতার কৈফিয়ত মেলে। নেতারা বেশির ভাগই পেশাদার রাজনীতিবিদ, উত্তর ভারতের বড় সামন্ত পরিবারের সন্তান অথবা এই পরিবারসমূহের সঙ্গে কোনাে না কোনাে যােগসূত্রে আবদ্ধ। এদের মধ্যে ব্যবসায়, বাণিজ্যে, শিল্পে নিযুক্ত পরিবারের কেউই তেমন ছিল না বললেই চলে। কিন্তু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থনের একটি বিরাট অংশ এসেছে এই শেষােক্ত গােষ্ঠী থেকে।
অর্থাৎ পাকিস্তানে নেতৃত্ব সাধারণভাবে সামন্ত শ্রেণী কজা করেছে তাই ওদের এই অনমনীয় রক্ষণশীলতা। ভারতের নেতৃত্বে পুঁজিবাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে- তাই পুঁজিবাদের প্রাথমিক যুগের প্রগতিশীলতা কংগ্রেসের কর্মসূচীতে এবং স্বাধীনতা-উত্তর যুগে ভারতীয় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রকল্পে প্রতিফলিত।
পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক রক্ষণশীলতা শিল্পে নতুন লগ্নীর সুযােগে দিশেহারা হয়ে যায়- এই লগ্নী এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার যােগসূত্র ও দেশের নেতৃত্বের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতাে ওরা গণতান্ত্রিক রাজনীতির গুরুতুপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে প্রয়ােজনমতাে অভিজ্ঞ ছিল না। সেই জন্যই আপাত প্রগতিশীল কোনাে সংবিধানই সেখানে রচিত হতে পারেনি; ও দেশের সবচেয়ে প্রতিপত্তিশালী সামন্ত শ্রেণী (পশ্চিম পাকিস্তানে) কোনাে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রগতিশীল কথার আড়ালে শােষণ গােপন করার কৌশল আয়ত্ত করতে পারে নি; ওরা শােষণের তীব্রতা বৃদ্ধিতে মানুষের অসন্তোষের প্রাথমিক রাজনীতিগত মােকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে সরাসরি মিলিটারি শাসন প্রতিষ্ঠা করে এবং এই শাসনের আমলে দুই পাকিস্তানেই মানুষের অবশ্যম্ভাবী প্রতিরােধের কথা চিন্তা করে নয়া পুঁজিরােধের কথা চিন্তা করে নয়া পুঁজিবাদের সঙ্গে সামন্তশ্রেণীর যুক্তফ্রন্টের প্রয়ােজনীয়তার কথা ওরা ভাবতে শেখে নি। তাই ওদের রক্ষণশীলতা, অসহনীয়তা এবং মানুষের অসন্তোষ প্রকাশের ভঙ্গি থেকে শিক্ষা গ্রহণের অক্ষমতা এবং সে জন্যই শেষ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে মানুষের অসন্তোষ আর শাসক-শােষকের অসহনীয়তা অনিবার্যভাবে আন্দোলনের স্তরে ক্রমােন্নয়ন আনে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন সশস্ত্র প্রতিরােধের পর্যায়ে পৌছে যায়।

সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১