এই কলকাতায়
বীরেন্দ্র মিত্র
গ্রিল ছেড়ে আমি ঠিক কেন যে একা একা বেরিয়ে এসেছিলাম, জানি না। বােধহয় উত্তেজনার উত্তাপে গরম লাগছিল। কলকাতায় গরমীর যেমন আভাস দিচ্ছে তাতেই গলদঘর্ম অবস্থা, তদুপরি সর্বদাই কোনাে না কোনাে উত্তেজনার গরম আতিশয্যের অতিরেক। এই আতিশয্যাটাই আসলে অসহ্য লাগে আমার। অথচ কলকাতায় ঐ রােগটাই প্রধান। পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে এবং নাগরিক চরিত্রে সর্বত্রই আতিশয্য। কলকাতাকে অনেকে অনেক নামেই ডেকেছেন, আমি বলব, এ শহরের সবচেয়ে জুৎসই নাম হতে পারে একটাই, তা হলাে : আতিশয্য নগরী। যখন যেটা নিয়ে মাতবে, মাতাল করে উন্মাদ করে ছাড়বে। কারণ যত তুচ্ছ কিংবা যত গুরুগম্ভীরই হােক। লম্বা জুলপীর মতাে এক একটা ব্যাপার সাময়িক উৎসাহের অতিরেকে মহানগরীর চন্দ্রাননে গজগজিয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের ঢেউ পশ্চিম তটে ভেঙে পড়ারই কথা; না পড়লেই বরং অবাক হতে হত। কিন্তু সে ঢেউ এপারকে কতটা নাড়িয়েছে, কতটা ভাসিয়েছে, আতিশয্যের আড়ালে তার চারিত্র্য নির্ণয় করা সহজ নয়। মাটি মায়ের প্রতি অন্তরের টান তাে আজ হঠাৎ জাগেনি বাংলাদেশে। সেখানে পশ্চিমা প্রভু সােচ্চার বিদ্রোহ ভাষাকে নিয়েই শুরু হয়েছিল। সেদিন কিন্তু নিদ্রালস কলকাতার কুম্ভকর্ণ দ্রিায় এতটুকু টোল পড়েনি। বাংলা ভাষা নিয়ে এপার বাংলায় কারও যে সামান্যতম মাথাব্যথা ছিল মনেও হয়নি। রাজ্যে বাংলা ভাষা ব্যবহার সরকারি অনুমােদন পর্যন্ত পেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় কিন্তু মাতৃভাষা চালু করার জন্য কোথাও এতােটুকু উৎসাহের লক্ষণও প্রকাশ পায়নি। দু-একজন মাতৃভাষা-প্রেমিক অফিসী কাজে বাংলাকে চালু করতে গিয়ে বাঙালি আমলার নাক উঁচু অসহযােগিতা লক্ষ্য করে বৃথা চেষ্টার বিরত হলেন। ইংরেজি মিডিয়ামে ছেলেপুলে পড়ানাের জন্য ক্ষেপে উঠলেন তাবৎ কলিকাতাবাসী। পশ্চিমবঙ্গ যে বহুকাল তার ন্যায্য প্রাপ্য থেকে নির্মমভাবে বঞ্চিত, ওপার বাংলার মতাে এই উপলব্ধিও কারাে মনে জাগ্রত হওয়ার কোনাে কালে কোনাে কারণ ঘটল না। আজকের উৎসাহী দৈনিকগুলাে সর্বভারতীয় রাজনীতির কচকচিতেই কাল কাটিয়েছে। আজ আতিশয্যের বিড়ম্বনায় সবার আধপাগল অবস্থা। কেন? না, ওপারে বিজয় দুন্দুভির জয়ধ্বনি শােনা যাচ্ছে। ইয়াহিয়া ট্যাঙ্ক যদি গুড়িয়ে দিত জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ ওপার বাংলাকে, তখন এখানে হয়ত মুখ মুচকে হেসে অনেকেই আমরা বলতাম, ওরা প্রাদেশিক হয়ে যাচ্ছিল। আরে বাবা, সবটাই কি অত সহজ ব্যাপার! মাজাকি!’
ভাগ্যগুণে বাংলাদেশের জয় আজ অপ্রতিরােধ্য। দুর্বল দেউলিয়া মানুষ সব সময়ই সবলের পরাক্রমে চকিত উচ্চকিত। বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ পরাক্রমে এপার বাংলার অসহায় প্রবঞ্চিত মানুষও তাই হঠাৎ উৎফুল্ল। কিন্তু দেউলিয়া উচ্ছ্বাসের আয়ু বড় স্বল্পমেয়াদী। দেউলিয়া চরিত্রের প্রধান লক্ষণই আতিশয্য বিলাসী। কথায়, কর্মে তাই তার আসমান জমিন ফারাক। মুজিবুরের মতাে নেতা এখানে জন্মাবে না; কারণ বাংলাদেশের মতাে জনতা এখানে নেই। নেতাজীর মতাে নেতাকে ঘরের দুয়ারে এসেও ফিরে যেতে হয়েছিল; কারণ জীবন্ত কণ্ঠস্বরকেও আমরা সেদিন বিশ্বাস করিনি। যেমন বােঝানাে হয়েছিল তেমনি বুঝেছি। মহাবিশ্বে বিশ্বপথিক সুভাষচন্দ্রকে হারিয়ে যেতে দিয়েছি। আবাহন নয়, নির্মম প্রত্যাঘাতের অসহ্য বেদনা নিয়ে বিপুল দেশপ্রেমের ভার একা বহন করে তিনি বিদেশ বিভুঁয়ে কোথায় হারিয়ে গেছেন, কেউ জানি না। জানবার চেষ্টাও করিনি। তখন অনেক কাজ। দেশ কেটে ভাগ করা। মানুষকে পাঠার মতাে বলি দওয়া। তাকে ভিটে ছাড়া করা এবং নিজের নিজের কাজ গুছানাের ব্যস্ততায় কুঁদ হয়ে ছিলাম। ফলে এই বাংলার সমস্ত অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবন দারুণ হতাশা আর প্রতিকূলতার স্রোতে ভেসে গেছে। কারণ পর্যন্ত অনুসন্ধান করিনি। আজও তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। এহেন আমি। এ হেন তুমি। আজ উচ্ছ্বাসে দেশপ্রেম উথলে উঠল ব্যাপারটায় সততা কতখানি?
কী জানি কেন, আমার বােধহয় এসব কথা মনে পড়েই লজ্জা করছিল। আমি উৎসাহের অতিরিক্ত প্রকাশ করতে গিয়ে অদৃশ্য আয়নায় নিজের মুখ দেখে দারুণ লজ্জা ও ক্ষোভে ছটফট করে বের হয়ে এসেছি একা একা। এই মুহূর্ত যেন আমারই আত্ম-সমীক্ষার মুহূর্ত। এখন উচ্ছাস নয়, স্থৈর্য চাই। আমি ঠিক এখনাে কী করছি, সেই কথাটাই ভাবা চাই। ওদের জয়ই আমার জয়, এ কথা বলতে বাধছে আমার। ওদের জয় আমার হিমালয়ান পরাজয়টাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি, এই পশ্চিম বাংলাকে আমি শুধু ভাঙছি, জ্বালাচ্ছি, নিঃস্ব আর নিঃসম্বল করছি। শিক্ষার ক্ষেত্রে, রাজনীতির ক্ষেত্রে, চিন্তার দিগন্তে, মননের মহাকাশে আমি আজ সর্বস্বান্ত। মুজিবুরের বাংলাদেশ আমাকে সেই চরম সত্যের মুখােমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমার তাই উৎসাহের অতিরেকে নিজের অপকীর্তিকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাটা সর্বনেশে বলেই বােধ হয়। মুজিবুরের বাংলাদেশে আজ প্রাকৃতিক বন্যা হচ্ছে না যে, কেবল ত্ৰাণকার্যের আত্মমুখী উদ্দীপনায় মহান কিছু করার তৃপ্তি পাব। ওখানে উঠেছে আত্মপ্রত্যয়ের তরঙ্গ তুফান। তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হলে আমাকেও সেই মহান যােগ্যতা নিয়েই যেতে হবে। ত্রাণ কার্যের মতাে তুরীয় কর্তব্যানন্দ আজ আমার প্রাপ্য নয়। বাংলাদেশের প্রােজ্জ্বল আলােয় নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়া, জ্বালিয়ে নেওয়ার সময় এটা। কিছু গঠনমূলক কর্মোদ্যোগের সময় এটা। আমার চরিত্রের সমস্ত ক্লীবত্ব পরিহারের এইটাই ব্রাহ্ম মুহূর্ত। পূর্বাঞ্চলের অরুণ আভায় প্রদীপ্ত ভাস্বর সেই ইঙ্গিত। আমাকে ফিরে ভাবতে হবে, আমি কোন অন্ধ গলিপথে পা বাড়িয়েছি? যে আমি নিজে অন্ধকারে নিমজ্জিত, সেই আমায় আলােকাভিসারের জয়গান গাইতে হবে খুব দায়িত্বের সঙ্গেই আত্মহননের পথ ছেড়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার ও আত্মােন্নয়নের পথে পা ফেলেত হবে। কিন্তু ঠিক এই সব কথা চাপা পড়ে যাচ্ছে আতিশয্য নগরীর এলােমেলাে উত্তেজনায়। আমার কেমন বিশ্বাস, আমাদের এই উত্তেজনার মধ্যেও হালকা ভাব-প্রবণতাই বর্তমান। বাংলাদেশ বাস্তবিক পক্ষে আমাদের এখনাে নাড়াতে পারেনি। সেই একই অন্তঃসার শূন্যতা আর কিছু না হােক, এপারকে তাই বাচাল করেছে। আমরা এলোেমলাে বকছি। নরম গরম ফিচার সম্পাদকীয় ঝাড়ছি। বক্তৃতার কম্পটিশন করছি। অরন্ধন, বন্ধে’র বাহ্যাড়ম্বরের মধ্যেই তৃপ্তি খুঁজছি। পরমুহূর্তেই বাস জ্বালাচ্ছি, ট্রাম পােড়াচ্ছি, খােলা ছুরি আর উদ্যত রিভলবার নিয়ে চতুর্দিকে বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা অসম্ভব সেই আনপ্রােডাক্টিভ ত্রাসের সঞ্চার করছি। আমাদের অভাব-অভিযােগ বস্তুত কী, তাই ভুলে বসেছি আজ। সাধারণ আমরা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং আর আর সমস্ত নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন একদল ব্রাসিত মানুষ, অসহায়ের মতাে অনেক মূল্যবান মুহূর্তকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখছি। কলকাতার মাথায় খুন চেপেছে। সে তার নিজের মুখ দেখতেই ভুলেছে। আতিশয্য নগরী তাই অন্যমুখে মুক্তির উদ্ভাস লক্ষ করে উত্তেজিত। কিন্তু এই উত্তেজনার মূলেই গলদ। এই উত্তেজনা মেকী। বন্যাত্রাণের বক্তৃতার মতােই এও হলাে আত্মবিস্মৃত অথচ আত্মতৃপ্ত কলকাতার আর এক আতিশয্য ব্যামাের হিস্টোরিক’ তড়কা। কলকাতা নিজেকে গােছাতে চায়নি, চায় না।
কিন্তু এসব চিন্তা আমার পক্ষে সঠিক কি না জানি না। বস্তুত একমাত্র দু’পাতা ডায়রি লেখা ছাড়া আমি নিজেও তাে আর কিছুই করিছ না।
পাড়ার ছেলেরা দোরে দোরে চাঁদা তুলতে বেরিয়ে পড়েছে। ওরা সীমান্তের অপর পারে শুকনাে খাবার, নুন, কেরােসিন তেল, ওষুধপত্র পৌছে দেবে বলে জানিয়েছে। আমি শুধু ভাবছি। কটা টাকা চাঁদা দিচ্ছে এবং ডায়রি লিখছি। আমার এই ডায়রি কোথাও ছাপা হবে না। অবশ্য দুঃখ নেই তাতে। ঢের লেখক তৈরি আছেন। তাঁরা কত কথাই বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে ছাপিয়ে দিচ্ছেন। তাদের মনেও অনেক অভিযােগ। হয়তাে লিখছেন : ওপারে যখন লড়াই, এপারে তখন আমরা সিনেমা থিয়েটার দেখছি, রেস্টুরেন্টে খাচ্ছি। কী উপলব্ধি! আর কী সাঘাতিক দামি দামি বক্তব্য।
আমি মাথা নেড়ে তাই প্রশান্তকে বলেছিলাম, “দেখ, কী চমৎকার লিখেছেন উনি। বাস্তবিক, আমরা কি সত্যিই যতটা একাত্মতা দেখছি, মনে মনে ততদূর ঐকান্তিক? আমরা রেস্টুরেন্টেও খাচ্ছি, সিনেমাও দেখছি।’
প্রশান্ত বলেছে, ‘দারুণ ফিলজফি তাে! তাহলে ও দুটো বন্ধ করলেই মুক্তি? আর কিছু ভেবে পাওয়া গেল না বুঝি? আসলে, বাঙালি, তুমি নিজেকে নিয়ে চিন্তাই করনি; হঠাৎ সাক্ষাৎ কর্ম দেখলেই তােমার ঐকান্তিকতা এসে যাবে, এও আবার হয় নাকি? আমরা ভিয়েতনাম টিয়েতনাম নিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত, পাশের বাড়ি নিয়েও ঠিক সেই রকম। কিছু বলার নেই, বাজে বকছি। ব্যবসা চাই, তাই সীমান্তের যুদ্ধকালীন গােপন সংবাদও ছেপে চারিদিক গরম করে তুলছি।’
আমি খুশি হতে পারিনি, বলেছিলাম, কিন্তু আমাদের দেশের সাহিত্যিক, শিল্পীরা বস্তুতই চিন্তিত। এসব লেখা তার প্রমাণ। তাছাড়া রােজ স্টেটমেন্ট বের হচ্ছে ওঁদের।’
প্রশান্ত হেসে বলেছে, তবে শােন, কাল স্পেনসেস বড়ে কাবাব’ বার থেকে রাত দশটায় যখন টেবিল ছেড়ে উঠলাম, তখন বাংলাদেশে যাই-যাই-মন অন্তত একজন উদীয়মান লেখককে তখনও বসে থাকতে দেখে এলাম। উনি বােধহয় বন্দুক কাঁধে স্বপ্নের রথে চেপে ওপারে যাচ্ছিলেন হালকা অবয়বে। বলা যায় না, পরবর্তী কোনাে ইনস্টলমেন্টে বার’ ব্যায়রামের ওপর তরুণ কলমের কড়া ধমক দিয়ে কিছু লিখে ছেপে পাঠাবেন হয়ত আমাদের কাছে।’
সাধারণ বাঙালির মতাে আমারও ‘নােজ ফর নিউজ’ (অর্থাৎ সংবাদসংগ্রাহী মন) জেগে উঠল এ কথায়। প্রশান্তের পাশে বসে পড়ে দুর্লভ সংবাদ সংগ্রহের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, তাই নাকি, কে রে? নিজের চোখে তুই অমন একজন লেখককে দেখে এলি? প্রশান্ত হেসে বলেছে, দেখলাম। তাই বলছি, বেশি চিন্তা করিস না। চিন্তা চালাক লােকে করবে।’
ঢাকার ঘটনা সম্পর্কে অপ্রকাশিত তথ্য ‘পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদারদের কবলে ঢাকা শহরের পথঘাট বেলা দশটার পরই জনশূন্য হয়ে পড়ে। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় যে ক’জন লােক এখনও শহরে আছেন তারাও বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েন। রাস্তায় শুধু ঘুরে বেড়ায় মিলিটারির সাঁজোয়া গাড়ি।’
মৃতপ্রায় ঢাকা শহরের এই বর্ণনা দেন ওখান থেকে আগত জনৈক ছাত্র দর্পণের সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে। তিনি বলেন, সদরঘাট, শাখারি বাজার, শান্তিনগর বাজার ইত্যাদি জায়গাগুলাে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। প্রচণ্ড গােলাবর্ষণের ফলে সেখানে আর কেউই জীবিত নেই।
গত চব্বিশে মার্চ রাত্রি এগারটা নাগাদ পাক সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সংখ্যক সঁজোয়া গাড়ি এসে দাঁড়ায় রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকের সামনে। তাদের তরফে পুলিশবাহিনীকে ‘ফল ইন’ করতে বলা হয়। উদ্দেশ্য এদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া। পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে এই নির্দেশের উত্তর দেয়। অপরপক্ষ থেকে গুলি ছুটে আসে এবং তিন-চার ঘণ্টাব্যাপী খণ্ডযুদ্ধ চলে। এরপর পুলিশ বাহিনী বুঝতে পারে যে, আর বেশিক্ষণ ব্যারাক ধরে রাখা যাবে না। তারা তখন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পেছন দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়।
রাজারবাগের লড়াইয়ে পাক সেনাবাহিনীর বেশ কিছু মারা যায় এবং জানা গেছে যে, তাদের মধ্যে একজন উচ্চপদস্থ অফিসারও ছিল। এ খবর পাওয়া যায় কমলাপুর স্টেশনের জনৈক রেল পুলিশ কর্মচারীর কাছে। তিনি সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেনকে বলতে শােনেন যে, একজন ব্রিগেডিয়ার রাজারবাগে মারা গেছে। সৈন্যরা কমলাপুর স্টেশনও আক্রমণ করে ও বাঙালি স্টেশন মাস্টারকে মেরে ফেলে।
রাজারবাগ থেকে সৈন্যদল যায় পিলখানায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ই পি আর) ক্যাম্পে। এখানে লড়াই চলে একটানা তিন দিন যার পর গােলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিফৌজ পিছু হটে যায়। মর্টারের প্রচণ্ড আঘাতে ক্যাম্পটি গুড়িয়ে দেয়া হয়। এই মুক্তিফৌজের যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন তারা এখন শহরের বাইরে থেকে নতুন আঘাত হানতে প্রস্তুত হচ্ছেন।
এর পর আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলগুলাের পালা। ছাত্ররা অবশ্য অধিকাংশই আগে পালিয়ে গিয়ে গ্রামাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়েছিল। যারা তখনও ছিল নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জগন্নাথ হলের একশত ছাত্রকে সারি বেঁধে দাঁড় করানাে হয় ও তারপর একজনকে সরিয়ে নেয়া হয়। এরপর চলে গুলি এবং নিরানব্বইটি দেহ লুটিয়ে পড়ে। যাকে আলাদা করে রাখা হয়েছিল তাকে বাধ্য করা হয় মাটি খুঁড়ে এদের কবর দিতে। সেই কাজ হয়ে যাবার পর একেও গুলি করে মারা হয়।
শেখ মুজিবর কোথায় আছেন এর উত্তর এই ছাত্রটি দিতে পারে না। তবে জানা যায় যে, ধানমন্ডিতে শেখ সাহেবের বাড়ি অক্ষত আছে এবং সেটি এখন দখল করেছে সেনাবাহিনী। ওপরে উড়ছে পকিস্তানি পতাকা। শেখ সাহেবের পরিবারের অন্যদেরও কোনাে খবর নেই। রােকেয়া হলের (মেয়েদের) আবাসিকদেরও কোনাে সঠিক খবর পাওয়া যাচ্ছে না। শেখ মুজিবরের ছেলে শেখ কামালকে শেষ দেখা যায় চব্বিশে রাতে রাজারবাগে পুলিশদের তৈরি থাকার জন্য নির্দেশ দিতে।
সৈন্যদল এখন ঢাকা শহরে যে কিছু সংখ্যক লােক আছে তাদের বাধ্য করছে জিন্নার ছবি টাঙাতে এবং গাড়ির নম্বর প্লেট বাংলা থেকে উর্দুতে পাল্টে ফেলতে। পথচারীদের বাধ্য করছে তাদের জিপে উঠতে এবং তারা যে বাংলাদেশ আন্দোলন বিরােধী প্রচার চালাচ্ছে তা বাংলায় ঘােষণা করতে। ব্যাঙ্ক, অফিস ইত্যাদি সেনাবাহিনী খুলিয়েছে বটে কিন্তু লােকের অভাবে এগুলােতে কোনাে কাজই হতে পারছে না। পদস্থ কর্মচারীদের মধ্যেও মুষ্টিমেয় কিছু লােক ছাড়া কাজে আসেন না। বাকিরা শহরের বাইরে চলে গেছেন এবং অনেকেই মুক্তি ফৌজের সঙ্গে সহায়তা করছেন।
সূত্র: দর্পণ
১৬.০৪.১৯৭১