পাঠকের মতামত
ওপারে যা ঘটছে তাতে এপারের সমস্ত সমস্যাই এখন চাপা পড়ে গেছে। নিজেদের অভাব অভিযােগের কথা তুলতে সত্যিই লজ্জা হয়। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না যে ক্ষুদ্র কর্পোরেশন নামক যে সংস্থাটি আমাদের অন্নদাতা সেজে সিন্ধবাদ নাবিকের ভুতের মতাে বিশেষ করে এই হতভাগ্য বাঙ্গালী জাতটার স্কন্ধে চেপে আছেন তারা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের খাদ্য মন্ত্রীও কি এই সুযােগ নিচ্ছেন? নৈলে কেন আজ মাসের পর মাস পূর্ব বঙ্গে সিন্ধ চাল নিষিদ্ধ করা হয়েছে? আগে দেওয়া হত এক সপ্তাহ অন্তর এখন বােধহয় আমাদের ভিক্ষের চাল শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধের ফলে গােটা জ্জ সপ্তাহই আপত দেওয়া হচ্ছে। আর সেটাকে আতপ চাল না বলে ধানশুদ্ধ আতপের গুড়াে বা খুদ বলাই ভাল। ছেলে বুড়াে রােগী কারুরি নিস্তার নেই, অজীর্ণ, রক্তআমাশা, যাই হােক না কেন। না খাও, খােলাবাজার বা কালােবাজার খােলা আছেন’সিকে থেকে আড়াই টাকার মধ্যে যত চাও অটের সিদ্ধ চাল এবং সেটা চোখে পড়বে সর্বত্র। দেখতে পান না খালি ক্ষুদ্র কর্পোরেশন। পঃ বঙ্গে তাে নয়ই– (যেখানে রেকর্ড প্রােডাকশন হয়েছে), এমনকি উড়িষ্যাতে তথা গােটা ভারতবর্ষে। খাদ্যটা কেন্দ্রের ব্যাপার। তাই রাজ্য সরকারেরও বােধহয় কোন দায়িত্ব নেই, বেশ খানিকটা আত্মসন্তুষ্টির ভাবও যেন রয়েছে। কেন না খােলাবাজার রয়েছে গমও রয়েছে প্রচুর, আর বাঙ্গালী তাে খাদ্যভাগ পাল্টে ফেলেছে। সুতরাং ওটা বােধহয় আর একটা সমস্যাই নয়। দেশ তাে খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছেই! দেশে খাদ্যের খাদ্যের অভাব নেই, অভাব শুধু চালের জনৈক স্বনামধন্য খাদ্যবিশারদের উক্তি। অর্থাৎ বাঙ্গালীর প্রধান খাদ্য যে চাল সেটা নাকি তাঁর মতে একটা খাদ্যই নয়। ধরমবীর ৫০০ থেকে খাদ্য বরাদ্দ ৯০০ এয় এনেছিলেন। এক কেজি করবার ইচ্ছেই ছিল। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্টের ভুইফোড় খাদ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ তিনি ৫০ গ্রাম অর্থাৎ সপ্তাহে তিন কাচ্চা মত বাড়িয়ে দিলেন। তাও কেন্দ্রকে ১০০ গ্রাম গম ঘুষ দিয়ে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারকে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ওদের খাদ্য দেওয়া মানে তাে মাইলাে, ভুট্টা, আর গম। আমরা পাট চাষ বন্ধ করে ধান চাষ করবাে। পাট চাষ অবশ্য বন্ধ হয় নি, তবে হয়ত হবে যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পাট শুধু পঃ বঙ্গের নয় সারা দুনিয়ার চাহিদা মেটাবে। সেদিন সম্ভবতঃ বেশী দূরে নয় এবং তখন পঃ বঙ্গের খাদ্যের জন্যে কি ক্ষুদ্রকর্পোরেশন, কি খাদ্যমন্ত্রী কাউকেই মাথা ঘামাতে হবে না। তাই এপারের লােক চেয়ে আজ দিল্লীর দিকে নয়, ওপারে সত্যিকারের বাংলাদেশের দিকে। কিন্তু বর্তমানে বাঁচবার উপায় কি? পঃ বঙ্গে নাকি ইতিমধ্যেই বিশ লাখ আশ্রয়প্রার্থী এসেছেন এবং দৈনিক অর্ধ লক্ষেরও বেশী কোন কোন দিন আসছেন। সংখ্যাটা কোটিতে পৌছান অসম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকার নাকি তাদের খাওয়াবার দায়িত্ব নেবেন। কিন্তু কি করে? তাঁদের পুজি তাে ঐ আলােচনা। তবে কি এদের ভাঁড়রে যথেষ্ট চাল আছে? তা হলে এতদিন পঃ পঙ্গকে বঞ্চনা করা হচ্ছিল কেন? ধাওয়ান পূর্বে একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, রেশনের বরাদ্দ ১৯০০ গ্রাম হবে, এখন বুঝছি সেটা নিছক রসিকতা নয়। কিন্তু সে কথা যাক বাংলাদেশের অগণিত শরণার্থীর খাদ্য সমস্যার যদি সমাধান করতে হয়, তা হলে আমার মতে শুধু এই একটি মাত্র কারণেই ভারত সরকারের উচিত সমস্ত দ্বিধাসঙ্কোচ কাটিয়ে এখনই বংলাদেশকে রাজনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে তাদের সঙ্গে বিনিময়ের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চালু করা। মুক্তাঞ্চল থেকে আসুক চাল এবং বিনিময়ে আমরা পাঠাই তাদের একান্ত আবশ্যকীয় দ্রব্যসামগ্রী। বাংলা দেশের নামে ভিক্ষা বন্ধ হােক। পাকিস্তান কিম্বা যে সব শক্তি প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ বাংলার ধ্বংসযজ্ঞে তাদের মদৎ যােগাচ্ছে তাদের ভয়ে আমরা ডুবতে পারি না। অন্য দেশের পক্ষে বাংলা দেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নটা শুধু আদর্শগত। তাদের গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি লাগবেও না। কিন্তু ভারতকে বাঁচাতে হলে বাংলা দেশকে বাঁচাতে হবে এ কথা আজ অস্বীকার করার অর্থ বালিতে মুখ গুজে থাকা। বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের হাতছাড়া হয়ে পাকিস্তানের কুক্ষিগত হলে এপারের আমরা এবং ওপারের ওরা দশ কোটির বেশী কোথায় দাঁড়াবাে? এবং তখন ভালােচালেও কুলুবে না। শ্রীপ্রভাস ঘােষাল, আড়িয়াদহ।
হের হেস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক রক্তাক্ত নাম। অ্যাডলফ হিটলারের প্রাক্তন সঙ্গী এই হের হেস। যে হেস ছিলেন একদিন বিশ্ববিজয়ী হিটলারের প্রধান অনুচর, যিনি ছিলেন একদিন সমগ্র দুনিয়ার ভীতি, সেই হেস আজ স্পিনের কারাগারে ৩০ বছর ধরে পচছেন। আজ তার মুক্তির দাবী উঠেছে সমগ্র বিশ্বে। আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে সেইদিন অনুশােচনায় দগ্ধ এই হের হেস বৃটেন ছুটে গিয়েছিলেন বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে। হিটলারের এই বিশ্বব্যাপী রক্তাক্ত ধ্বংসলীলা তার মনে এনে দিয়েছিল এক গভীর সমবেদনা। তাই হিটলারের ডান হাত—তার বহু কুকর্মের প্রধান স্বাক্ষী এই হেস হের ১৯৪১ সালের ঐ বিশেষ দিনটিতে ছুটে গিয়েছিলেন। স্কটল্যান্ডে তার এক বিশেষ বন্ধু উইলি মেজার স্মিটের (একজন বিখ্যাত বিমান প্রস্তুতকারক) কাছ থেকে একখানি বিমান ধার করে। তার হঠাৎ ঐখানে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বশান্তি আলােচনা। তার এই আকস্মিক যাত্রা ছিল হিটলারের অজানা। তিনি যখন জানতে পারলেন যে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে শত্রুর দেশে যাত্রা করেছেন হেস তখন তিনি রাগে ফেটে পড়লেন। মনে মনে এও তিনি ঠিক করেছিলেন যে তার বিরুদ্ধাচারণের জন্য চরম শাস্তি, হেস ফিরে এলেই তাকে দেবেন। হের হেস নিশ্চয়ই হিটলারের বিরুদ্ধাচরণের ভবিষ্যৎ জানতেন, কিন্তু তার সমব্যথী মানবাত্মাকে কোনরকম বিচলতি করতে পারে নি। হের হেসই ছিলেন সর্বপ্রথম যিনি হিটলারের বিরুদ্ধাচরণ করে বৃটেনের সামনে সরাসরি শান্তি প্রস্তাব পেশ করেন। এবং নিজের জীবন বিপন্ন করেও শত্রুর দেশে পদার্পণ করেন। তার শাস্তি প্রস্তাবের মূল বক্তব্য ছিল বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীকে বদলাতে হবে এবং জার্মাণকে তার কেড়ে নেওয়া উপনিবেশগুলাে ফেরত দিতে হবে। বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল হেসের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। এই ঘটনার পরেই হের হেসকে গ্রেফতার করা হয়। হেসের বর্তমান বয়স ৭৭ বছর। তাকে আটক রাখার জন্য যত টাকা খরচ হচ্ছে, সারা বিশ্বে অন্য কোন বন্দীর জন্য এত ব্যায়ের কোন নজীর নেই। তার জন্য বছরে ১০ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। স্পেনের এই কারাগারে তিনিই একমাত্র বন্দী। ১৯৪৬ সালে নুরেম বারগে তার বিচার হয় এবং বিচারে তার প্রতি যাবজ্জীবন কারাজীবনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কারাজীবনের ২৮ বছর তিনি তার পরিবারের লােকদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। ইদানীং অবশ্য তিনি তার আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে দেখা করছেন। আশ্চর্য! ক্রেমলিনের কর্তারা কিন্তু ভিন্ন মত পােষণ করেন। তারা মনে করেন নুরেমবাগের আদালতে হেসকে যে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা মকুবের কোন প্রশ্ন ওঠে না। রাশিয়ার একজন কূটনীতিবিদ নাকি পশ্চিম জার্মাণীর একটি পত্রিকায় মন্তব্য করেছেন, হেসকে আটক রাখার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু হেস যে যুদ্ধ লাগিয়েছিল, তাতে শুধুমাত্র বিপুল অর্থ ব্যয়ই হয় নি, লক্ষ লক্ষ লােকের জীবনহানিও হয়েছিল। ৭৭ বৎসর বয়স্ক এবং ৩০ বৎসর ধরে বন্দী সে বৃদ্ধ, তার সম্পর্কে এই ধরনের মন্তব্য করতে রুশ কূটনীতিবিদের বিবেকে লাগল না এতটুকু। অবশ্য বর্তমানে এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানুষটিকেল মুক্তি দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। অবশ্যই এটা আনন্দের সংবাদ। এই আন্দোলনে বর্তমানে বিচারপতি, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যক ও সাংবাদিকরাও যােগ দিয়েছেন। হেসের মুক্তির জন্য বৃটেন থেকেই অধিক চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাংলার দুই তরুণ সাংবাদিক হিসেবে আমরা ভারতের সর্বস্তরের পক্ষে জনমত গঠন করতে অনুরােধ করি এবং ভারত সরকারও এই বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য উত্থাপন করুন যাতে করে হের হেস অন্ততঃ কবরে যাওয়ার আগে ক’দিনের জন্য মুক্ত আকাশের তলায় এসে দাঁড়াতে পারেন। দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত ও অচ্যুতকুমার সিংহ, কলকাতা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ মে ১৯৭১