You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.31 | বিশ্ব বিবেক কি ইয়াহিয়ার করতলগত? | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বিশ্ব বিবেক কি ইয়াহিয়ার করতলগত?

স্বাধীন বাংলায় আজ প্রায় দু’মাস গত হতে চলল খুনী ইয়াহিয়ার নরঘাতকরা একতরফাভাবে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালীর উপর অবিরামভাবে হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বের সকল দেশের কাছে এই হত্যা যজ্ঞকে রােধ করার জন্য আবেদন জানান হয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই তেমন কোন সাড়া দেন নাই, মনে হচ্ছে যেন বিশ্বের সকলেই পাকিস্তানি খুনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার করতলগত।
পাক বাহিনীর অত্যাচারে বাঙলার প্রতিটি পরিবার আজ তছনছ হয়ে গেছে, সকল শহরবাসী সজান গােছান। ব্যবসা বাণিজ্য অনেকে সুদূর পল্লীতে আশ্রয় নিয়েছে, অনেকে প্রাণের ভয়ে ভারতে চলে এসেছে। আজ বাংলার প্রতিটি পরিবারের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। বিশ্বের বৃহত্তম শক্তিগুরির নীরব দর্শকের ভূমিকা দেখে শুধু আমরা কেন, বিশ্বের সকলেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছে, জানি না এর জের কতদূর? আরাে জানি না আমরা যারা লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য এসেছি তারা সকলেই সুনিশ্চিতভাবে আবার আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারব কিনা? আজ বাংলায় যারা প্রাণ নিয়ে শুধু বেঁচে আছে তারা দুর্ভিক্ষে অনিবার্যভাবে আক্রান্ত হয়েছে, অনেকে না খেয়ে মরতে চলেছে।
বিশ্বের সকল শক্তির কাছে আমরা পুণঃ আবেদন জানাই, আপনারা আমাদেরকে রক্ষা করুন, বাংলাকে রক্ষা করুন, বাংলার রাজনৈতিক সমাধান আন্তর্জাতিকভাবে করুন, খাদ্য ও ঔষধ সাহায্য দিয়ে উপযােগী বাঙালীকে রক্ষা করুন। —এম এ রাজ্জাক; বি-এ; কুষ্টিয়া, বাংলাদেশ।
আমরা কোন পৃথিবীতে বাস করছি? ইহা কি মানবের না দানবের?
শাসন ক্ষমতা হাতে থাকলেই কি নির্বিচারে স্বরাষ্ট্রের শিশু-নারী নির্বিশেষে গণহত্যার অধিকারী হয়? আর চার কোটি মানুষ কি প্রকারে সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর শাসনাধিকার লাভ করল?
গত সাধারণ নির্বাচনে প্রমাণিত হয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের আর বাংলাদেশের উপর শাসন করবার কোনও নৈতিক বা ন্যায়সঙ্গত অধিকার নাই। নির্বাচনে সম্পূর্ণ পরাজিত হবার পর ইয়াহিয়া খান, বিজয়ী বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের উপর দেশ-দ্রোহীতার সর্বৈব মিথ্যাপবাদ চাপিয়ে দিলেন, অগ্রাহ্য করলেন বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের দাবী। বাংলাদেশের উপর শাসনাধিকার বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ দমন ও ঐক্য রক্ষার দোহাই দিয়ে নারকীয় গণহত্যা ও দানবীয় ধ্বংসলীলা চালান হচ্ছে কোন আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে?
যারা মানবতা, ন্যায় নীতি ও ধর্ম সমস্ত বিসর্জন দিয়ে হত্যা ও ধ্বংস কার্যে মেতেছে তাদের নিকট কোন প্রশ্ন করা মুর্খতা মাত্র, তাদের অনুরােধ করা ক্লীবতার পরিচায়ক।
এই পৃথিবীতে পাকিস্তান অপেক্ষা শত শত গুণ শক্তিশালী বহু রাষ্ট্র রয়েছে এবং এই সকল রাষ্ট্রের নায়কগণ জ্ঞানী ও পন্ডিত বলে সমগ্র বিশ্বে বিবেচিত, যারা একটিমাত্র অঙ্গুলী নির্দেশে বা একটিমাত্র কটাক্ষে পাকিস্ত ানে এই নারকীয় হত্যাকান্ড ও দানবীয় ধ্বংসলীলা বন্ধ করে দিতে পারেন; তারা কি কারণে মানবতার ও গণতন্ত্রে এ হেন হীনতম অবমাননা ও লঞ্ছনা দেখে শুনে নীরব রয়েছেন?
পাকিস্তান বাংলাদেশের উপর যে অমানুষিক বর্বরতা চালিয়েছে তাতে সক্রিয়ভাবে বাধা না দিয়ে বিশ্বের সকল দেশ, সকল শক্তি, সমস্ত মানব সমাজের চরম লজ্জা ও গ্লানির বিষয়।
এই নিষ্ক্রিয়তার কারণ কি? আন্তর্জাতিক নিয়ম লংঘনের আশংকা স্বার্থহানির আতঙ্ক? কিসের অলংঘনীয় বাধা বিশ্বের সমস্ত শক্তিমান রাষ্ট্রগুলিকে এমন শক্তিহীন নির্বীয্য করে রেখেছে?
যে রাজনীতিতে মানবতার স্থান নাই গণতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করা হয় সে রাজনীতি কোনদিনই মানব কল্যাণে লাগবে না ইহা ধ্রুব সত্য।
যে রাষ্ট্র, যে মানব সমাজ নিজেদের স্বার্থের খাতিরে মানবতাকে বিসর্জন দেয় তারা মানুষ নামের সম্পূর্ণ অযােগ্য।
যে শক্তি দুর্বলকে রক্ষা করে না, মানবতা ও গণতন্ত্রকে বাঁচাবার জন্য অগ্রসর হয় না সে শক্তি দানবের শক্তি তা কোন দিনই কোন মহৎ কার্যে লাগবে না।
পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নৃশংস বর্বরতা চালিয়েছে, কোন কালের কোন যুগের মানব ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর বাংলাদেশের বুকে বাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের বুকের রক্তে বাঙ্গালীর গৌরবের যে ইতিহাস লেখা হল তার সহিত বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সকল সভা মানব সমাজের কাপুরুষতার ইতিহাস, ক্লীবতার ইতিহাস ও কলংকের ইতিহাস জড়িয়ে রইল।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ মে ১৯৭১