আগরতলা মামলার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে
মুজিবর রহমানের লিখিত জবানবন্দী
স্বাধীনতা পূর্ব ভারতীয় ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে আমার বিদ্যালয় জীবনের সূচনা হতেই আমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে সংগ্রাম করিয়াছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমাকে আমার লেখাপড়া পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হইয়াছে।
স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এর ফলে ১৯৪৯ সালে আমরা মরহুম জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গঠন করি। আওয়ামী লীগ পূর্বেও ছিল এবং এখনও সেইরূপ একটি নিয়মতান্ত্রিকতার প্রথানুসারী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান।
১৯৫৪ সালে আমি প্রথমে প্রাদেশিক পরিষদে এবং জাতীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হই। আমি দুইবার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রিত্ব লাভ করি। জনসাধারণের কল্যাণার্থে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিরােধী দল গঠন করার জন্য আমাকে ইতিমধ্যেই কয়েক বছর কারা নির্যাতন ভােগ করিতে হয়। সামরিক শাসন প্রবর্তনের পর হইতেই বর্তমান সরকার আমার উপর নির্যাতন চালাইতে থাকে। ১৯৫৮ সালের ১২ই অক্টোবর তাহারা পূর্ব পাকিস্তান জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে আমাকে গ্রেফতার করে এবং দেড় বৎসর কাল বিনা বিচারে আটক রাখে। আমাকে এইভাবে আটক রাখাকালে তাহারা আমার বিরুদ্ধে ছয়টি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে, কিন্তু আমি ঐ সকল অভিযােগ হইতে সসম্মানে অব্যাহতি লাভ করি। ১৯৫৯-এর ডিসেম্বর কিংবা ১৯৬০-এর জানুয়ারিতে আমাকে উক্ত আটকাবস্থা হইতে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তিলাভ কালে আমার উপর কিছু কিছু বিধি-নিষেধ জারি করা হয়- যেমন: ঢাকা ত্যাগ করিলে আমাকে গন্তব্যস্থলের সম্বন্ধে লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাইতে হইবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরও একইভাবে সেই বিষয় তাহাদিগকে অবগত করাইতে হইবে। গােয়েন্দা বিভাগের লােকেরা এই সময় সর্বদা ছায়ার মতাে আমার পিছু লাগিয়া থাকিত।
অতঃপর ১৯৬২ সালে বর্তমান শাসনতন্ত্র জারির প্রাক্কালে যখন আমার নেতা মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয় তখন আমাকেও জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয় এবং ছয় মাস বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। জনাব সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে দেশের উভয় অংশে আওয়ামী লীগকে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্জীবিত করা হয় এবং আমরা সম্মিলিত বিরােধীদলের অঙ্গদল হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সম্মিলিত বিরােধীদল এই সময় প্রেসিডেন্ট পদে জনাব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে মনােনয়ন দান করে। আমরা নির্বাচনী অভিযান শুরু করি। সরকারি কর্তৃপক্ষও আমার বক্তৃতা সম্পর্কে কয়েকটি মামলা দায়ের করিয়া আমাকে মিথ্যা বিরক্ত ও লাঞ্ছিত করিতে থাকে।
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।
যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে।
যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলের সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করিবার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তাহার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় আমি পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও যুদ্ধকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশকে সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অন্য অংশসহ সকল বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল।
আমি তাসখন্দ ঘােষণাকেও সমর্থন করিয়াছিলাম। কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্বশান্তিতে আস্থাবান- আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল আন্তর্জাতিক বিরােধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত।
১৯৬৬ সালের গােড়ার দিকে লাহােরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান ছয় দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করা হইয়াছে।
অতঃপর আমার প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ছয়দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকূলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয়দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রদত্ত হয়।
ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারি নেতৃবৃন্দ ও সরকারি প্রশাসক যন্ত্র আমাকে অস্ত্রের ভাষায়, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি প্রদান করে ও একযােগে আধ ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশাের হইয়া ঢাকায় ফিরিতেছিলাম তখন তাহারা যশােরে আমার পথরােধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযােগে ঢাকা হইতে এক গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বলে এই বারের মতাে প্রথম গ্রেপ্তার করে।
আমাকে যশাের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমায় অন্তর্বর্তীকালীন জামিন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হন কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিন বলে আমি সেই দিনই মুক্তি পাই এবং সন্ধ্যা সাতটায় নিজগৃহে গমন করি। সেই সন্ধ্যায়ই, আটটায় পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে প্রেরিত এক গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেপ্তার করে, পুলিশ সেই রাত্রেই আমাকে সিলেট লইয়া যায়। পরদিন প্রাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিনের আবেদন বাতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করে। পর দিবস সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন প্রদান করেন কিন্তু আমি মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতা প্রদানের অভিযােগে আমাকে কারা দরজায়ই গ্রেপ্তার করে। এবারের গ্রেপ্তারি পরােয়ানা ময়মনসিংহ হইতে প্রেরিতে হইয়াছিল। সেই রাত্রে আমাকে পুলিশ পাহারাধীনে ময়মনসিংহ লইয়া যাওয়া হয় এবং একইভাবে ময়মনসিংহ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিন প্রদানে অস্বীকৃত হন এবং পরে মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তি লাভ করিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করি। উপরিউক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেপ্তারি প্রহসন ও হয়রানি ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত আটই মে নারায়ণগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত একটার সময় পুলিশ ডিফেন্স অফ পাকিস্তান রুল’ এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেপ্তার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহু সংখ্যক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইহাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খােন্দকার মুশতাক আহাম্মদ, প্রাক্তন সহ-সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শ্রমিক সম্পাদক জনাব জহুর আহাম্মদ চৌধুরীসহ বহু অন্যান্য। ইহার অল্প কয়েকদিন পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এম এল এ প্রচার সম্পাদক জনাব মােমেন এডভােকেট সমাজ কল্যাণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শামসুল হক, ঢাকা শহর আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব হাফিজ মােহাম্মদ মুসা, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মােল্লা জালালুদ্দীন আহাম্মদ এডভােকেট, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সহসভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপটেন মনসুর আলি, প্রাক্তন এম এল এ জনাব আমজাদ হােসেন, এডভােকেট জনাব আমিনুদ্দীন আহাম্মদ, পাবনার এডভােকেট জনাব আমজাদ হােসেন, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মুস্তফা সারওয়ার, নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব মহীউদ্দিন আহাম্মদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব মােহাম্মদুল্লাহ, এডভােকেট ও সংগ্রামী নেতা শাহ মােয়াজ্জম হােসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দীন আহাম্মদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব হারুনুর রশীদ, তেজগাঁও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাবুদ্দীন চৌধুরী, ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব আবদুল হাকিম, ধানমন্ডি আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি জনাব রশীদ মােশারফ, শহর আওয়ামী লীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সুলতান আহাম্মদ, অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অস্থায়ী সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান, পাবনার এডভােকেট জনাব হাসনাইন, মােমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিক নেতাকে পাকিস্তান রক্ষা বিধির ৩২ ধারার (নিষ্ঠুর অত্যাচার) বলে কারান্তরকালে নিক্ষেপ করা হয়। আমার দুই ভ্রাতুস্পুত্র- পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহীদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ করা হয়। অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাককেও বর্তমান শাসক গােষ্ঠী নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ইহার একমাত্র কারণ হইল যে, ইত্তেফাক মাঝে মাঝে আমার প্রতিষ্ঠানের নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন সম্পাদক জনাব তােফাজ্জল হােসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ রাখিয়া তাহার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে।
যুগপৎ চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি চট্টগ্রাম পাের্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহসভাপতি ও অন্যতম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধিবলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।
আমাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের সাতই জুন সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রদেশব্যাপী এই হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে এগারাে জন ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশ প্রায় আটশ লােক গ্রেপ্তার করে ও অসংখ্য লােকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জনাব মােমেন খান প্রায়শই তাহার লােজন এবং সরকারি কর্মচারী সমক্ষে উন্মুখভাবে বলিয়া থাকেন যে, যতদিন তিনি গদিতে আসীন থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেই অবগত আছেন। আটকাবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারালয়ের সম্মুখিন হইতে হইয়াছে। প্রায় এগারাে মাস আটক রাখার পর ১৯৬৮ সালের সতেরাে-আঠারাে তারিখ রাত একটার সময় আমাকে তথাকথিত মুক্তি দেয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটক হইতে কতিপয় সামরিক ব্যক্তি দৈহিক বলপ্রয়ােগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি রুদ্ধ কক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহিঃজগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না, বিশ্ব হইতে সকল যােগাযােগ বিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাস কাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযােগ-সুবিধা হইতে বঞ্চিত রাখা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সম্বন্ধে যত অল্প প্রকাশ করিতে হয় ততােই উত্তম।
এই বিচার কার্য শুরু হইবামাত্র একদিন পূর্বে, ১৯৬৮ সালের আঠারই জুন, আমি প্রথমে এডভােকেট জনাব আবদুস সালাম খানের সহিত সাক্ষাৎ করি এবং তাহাকে আমার অন্যতম কৌসুলী নিয়ােগ করি।
কেবলমাত্র আমার উপর নির্যাতন চালাইবার জন্য এবং আমার দলকে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও আমাদিগকে কুখ্যাত করিবার জঘন্য মনােবৃত্তি লইয়া আমাকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলায় মিথ্যা জড়িত করা হইয়াছে। ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, চাকরির সংখ্যা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সততার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা ও নিষ্পেষণ করাই ইহার মূল উদ্দেশ্য।
এই আদালতে আসিবার পূর্বে আমি লে. কর্নেল মােয়াজ্জেম হােসেন এক্সকর্পোরাল আমীর হােসেন, এল এস সুলতান উদ্দিন আহমেদ কামালউদ্দিন আহমেদ, স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান, ফ্লাইট সার্জেন্ট মাহফুজ উল্লাহ ও এই মামলায় জড়িত অন্যান্য স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী কর্মচারীদের কখনও দেখি নাই। জনাব আহমদ ফজলুর রহমান, জনাব রুহুল কুদুস ও জনাব খান মােহাম্মদ শামসুর রহমান- এই তিনজন সি এস পি অফিসারদের আমি জানি। আমি মন্ত্রী হিসেবে সরকারি কার্য সম্পাদনকালে তাহাদিগকে জানিবার সুযােগ পাইয়াছিলাম এবং তাহারাও তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু আমি তাহাদের সঙ্গে কখনাে রাজনীতি বিষয়ক আলােচনা করি নাই কিংবা কোনাে ষড়যন্ত্রেও ব্যাপৃত হই নাই।
আমি কোনােদিন লে. কর্নেল মােয়াজ্জম হােসেনের বাসগৃহ অথবা করাচীতে জনাব কামালুদ্দীনের বাসগৃহে গমন করি নাই কিংবা আমার অথবা লে. কর্নেল মােয়াজ্জম হােসেনের অথবা করাচিতে জনাব কামালুদ্দীনের বাসগৃহে কোনাে সভাও অনুষ্ঠিত হয় নাই। কিংবা এই তথাকথিত ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনাে ব্যক্তির সহিত কোনাে আলােচনা আমার অথবা জনাব তাজুদ্দীনের বাসায় সংঘটিত হয় নাই এবং আমিও ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত কাহাকেও টাকা দেই নাই। আমি কখনও ডা. সাঈদুর রহমান কিংবা মালিক চৌধুরীকে এই তথাকথিত ষড়যন্ত্রে সাহায্য করিতে বলি নাই। তাহারা চট্টগ্রামের আমার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মীদের ন্যায় মাত্র। আমার প্রতিষ্ঠানের তিনজন সহ-সভাপতি, ৪৪ জন নির্দেশনা পরিষদ সদস্য, একজন সাধারণ সম্পাদক এবং আটজন সম্পাদক রহিয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের অনেকেই প্রাক্তন মন্ত্রী, এম এল ও এম পি এ। বর্তমান কেন্দ্রীয় পরিষদের পাঁচ জন ও প্রাদেশিক পরিষদের দশজন সদস্য আমার প্রতিষ্ঠানভুক্ত। চট্টগ্রামেও আমার প্রতিষ্ঠানের জেলা ও শহর সভাপতি ও সম্পাদকগণ, প্রাক্তন এমএলএ এমপিএ অনেক বিত্তশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিগণ বিদ্যমান। আমি তাহাদের কাহারও নিকট কোনাে প্রকার সাহায্যের কথা উল্লেখ করি নাই। ইহা অসম্ভব যে, আমি একজন সাধারণ ব্যবসায়ী মালিক চৌধুরী একজন সাধারণ এল এম এফ ডাক্তার সাঈদুর রহমানকে কোনাে সাহায্যের জন্য অনুরােধ করিতে পারি। ১৯৬৫ সালের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জনাব জহুর আহাম্মেদ চৌধুরীর বিরােধিতা করিবার জন্য ডা. সাঈদুর রহমানকে এবং আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছিল। আমি ডা. সাঈদুর রহমানের গৃহে কদাচিত গমন করি নাই।
আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ইহা নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে যাহার একটি সুনির্দিষ্ট, সুসংগঠিত নীতি ও কর্মসূচি রহিয়াছে। আমি অনিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে কদাপি আস্থাশীল নই। আমি দেশের উভয় অংশের জন্য ন্যায়বিচার চাহিয়াছিলাম— ছয় দফা কর্মসূচীতে ইহাই বিধৃত হইয়াছে। দেশের জন্য আমি যাহাই মঙ্গলকারক ভাবিয়াছি আমি সর্বদাই তাহা নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডির ভিতরে জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছি এবং এই নিমিত্ত আমাকে সর্বদাই শাসকগােষ্ঠী এবং স্বার্থবাদীদের হাতে নিগৃহ হইতে হইয়াছে। তাহারা আমাকে ও আমার প্রতিষ্ঠানকে দমন করিয়া পাকিস্তানের জনগণের, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানিদের উপর শােষণ ও নিষ্পেষণ। অব্যাহত রাখিতে চায়।
আমার উক্তির সমর্থনে আমি মহামান্য আদালতে আরাে নিবেদন করিতে চাই যে, আমাকে প্রতিহিংসাবশত এই মিথ্যা মামলায় জড়িত করা হইয়াছে। পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে অভিযুক্ত বলিয়া কথিত ১৮ ব্যক্তির কথা লিপিবদ্ধ ছিল এবং উহার মধ্যে আমার নাম ছিল না। উক্ত প্রচারপত্রে ইহাও উল্লেখ করা হইয়াছিল যে, সকল অভিযুক্তই অভিযােগ স্বীকার করিয়াছে তদন্ত প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে এবং শীঘ্রই বিষয়টি বিচারার্থে আদালতে প্রেরণ করা হইবে।
একজন প্রাক্তন মন্ত্রী হিসেবে অর্জিত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্বরাষ্ট্র বিভাগের উক্ত প্রচারপত্র সম্বন্ধে এ কথা জানাইতে চাই যে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সেক্রেটারি কর্তৃক ব্যক্তিগতভাবে দলিল পত্র পরীক্ষিত ও অনুমােদিত হওয়া ব্যতিরেকে কোনাে বিভাগ হইতে কোনাে প্রকার প্রচারপত্র প্রকাশ করা যায় না এবং এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ক্ষেত্রে কোনাে প্রচারপত্র প্রকাশ করিতে হইলে প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রেসিডেন্টের অনুমােদন লাভ আবশ্যক।
বর্তমান মামলাও উল্লিখিত নিষ্পেষণ ও নির্যাতন নীতির পরিণতি ছাড়া আর কিছুই নয়। অধিকন্তু স্বার্থবাদী মহল কর্তৃক শশাষণ অব্যাহত রাখার যে ষড়যন্ত্র জাল বর্তমান শাসকগােষ্ঠী বিস্তার করিয়াছে এই মামলা তাহাই বিষময় প্রতিক্রিয়া। আমি কখনাে কিছু করি নাই কিংবা কোনােদিনও এই উদ্দেশে কোনাে স্থল, নেভি বা বিমান বাহিনীর কোনাে কর্মচারীর সংস্পর্শে কোনাে ষড়যন্ত্রমূলক কাজে আত্মনিয়ােগ করি নাই। আমি নির্দোষ এবং এ ব্যাপারে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।
সূত্র: দর্পণ
০৯.০৪.১৯৭১