You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.14 | বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম প্রসঙ্গে | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী সগ্রাম প্রসঙ্গে

এ কথা আজ স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের অগণিত মুক্তিকামী মানুষের সামনে যে প্রশ্ন ইতিহাস তুলে ধরেছে, তার উপযুক্ত জবাব দেবার ওপরেই বাংলাদেশের ভাগ্য নির্ভর করছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ হয়তাে ভেবেছিলেন নির্বাচনে বিপুল জয়লাভের পর তাঁরা ছয়দফা দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তানে শাসনক্ষমতা লাভ করতে সক্ষম হবেন। পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের বিপুল সমর্থন তাদের ভরসা জুগিয়েছিল যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
তারা সামজিক আর্থ ব্যবস্থার মালিক শাসকশ্রেণীকে ভুল বুঝেছিলেন। কোনাে শাসকশ্রেণীই স্বেচ্ছায় ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। নির্বাচনের ফলে তাদের শাসনক্ষমতা অক্ষুন্ন থাকলেই তারা গণতন্ত্রের জয়ধ্বনি দেয়, অন্যরকম হলে সংসদীয় নির্বাচনকেই বাতিল করে, গণতন্ত্র ধ্বংস করেও নিজেদের শাসন ক্ষমতা বজায় রাখে। এটাই সবদেশে সর্বকালের ইতিহাসলব্ধ অভিজ্ঞতা।
এই অভিজ্ঞতা মনে না থাকলে, কোনাে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম অথবা বিপ্লবী সংগ্রাম সাফল্য লাভ করতে পারে না।
পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ সামরিক শাসক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে পারেন নি। অথচ পূর্ববঙ্গের ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সাধারণ শত্রুই একচেটিয়া পুঁজি-সামন্ত-শ্রেণীর সামরিক শাসন। এটা হলাে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রথম দুর্বলতা।
আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রধান দুর্বলতা হলাে বাঙালি জনসাধারণের পশ্চিম পাকিস্তানি শােষকদের প্রতি ঘৃণাকে সংগঠিত প্রতিরােধের পথে চালাবার অক্ষমতা। বরং এই প্রতিরােধকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হতে দিয়ে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে তাকে ঠেলে দিয়েছেন।
আজ এই দুর্বলতাকে কাটাতে হলে, প্রতিরােধ সংগঠিত করতে হলে কাজে সরকার গঠনের চাইতেও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সমস্ত দল, শ্রেণী সংগঠনকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করা অনেক বেশি প্রয়ােজন।
ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর আঘাতে প্রথম পরাজয়ের মুখে বাংলাদেশের অসংখ্য প্রতিরােধ সংগ্রামী সম্ভবত বিহ্বল, বিভ্রান্ত হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। বিশেষ করে স্থানীয় নেতৃত্বের অন্তর্ধান এই বিহ্বলতাকে পলায়নমুখী করে তুলতে পারে।
এই হতাশা বিহ্বলতাকে কাটাবার জন্যে যদি এখনই সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তাহলে দীর্ঘকালের জন্যে বাংলাদেশ আন্দোলনকে পিছিয়ে পড়তে হবে।
সঙ্কট যত তীব্র হয়, সুযােগের অজস্র দ্বারও তখন খুলে যায়। নিরস্ত্র জনসাধারণ প্রতিরােধের সংগঠনে উদ্বুদ্ধ হলে শত্রু সৈন্যের অস্ত্রসজ্জা তাদের করতলগত হতে বাধ্য।
যে কোনাে ধরনের যুদ্ধে শত্রু-সৈন্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করার প্রাথমিক প্রয়ােজন। শুধু শত্রু সৈন্যদল সম্পর্কে জানাটাই যথেষ্ট নয়। শত্রু সৈন্যের সংখ্যা অবস্থান, অস্ত্রশস্ত্রের ধরন, সরবরাহ, যােগাযােগ ব্যবস্থা, মনােবল সম্পর্কেও প্রতিরােধ বাহিনীর পরিষ্কার ধারণ থাকা প্রয়ােজন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের সমগ্র অবস্থাও খতিয়ে দেখতে হবে, কারণ শত্রুসৈন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তার না করতে পারলে জয়লাভ করা অসম্ভব। শত্রুকে ভালাে করে জানা এটা হচ্ছে জয়লাভের প্রথম শর্ত। শত্রুর শক্তির চেয়েও অতিরিক্ত শক্তি সমাবেশে না করতে পারলে জয়লাভ করা যায় না।
এই কাজ করতে হলে শত্রু পক্ষকে এড়িয়ে গিয়ে দূর থেকে করা সম্ভব নয়। শত্রু যখন অস্ত্রবলে, সংগঠন বলে শ্রেষ্ঠ, তখন তার সঙ্গে মুখােমুখি লড়াই করতে গেলে বীরত্ব দেখানাে সম্ভব হলেও বিজয়ী হওয়া যায় না। কাজেই অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিরােধ সংগ্রামী কী করবেন? তারা গেরিলা যুদ্ধের, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কৌশল গ্রহণ করবেন। সংখ্যা ও অস্ত্রবলে বলীয়ান শক্রদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মুক্তিযােদ্ধাদের একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের সাফল্যজনক পরিণতিতেই শেষ পর্যন্ত চুড়ান্ত বিজয় সম্ভব।
একজন ব্যক্তি যত বলশালীই হােক, তার আঙুল, চোখ, নাক, কান, পায়ের পাতা এগুলাে সমগ্র দেহের তুলনায় দুর্বল। প্রথমে যদি তার হাতের আঙুল, পায়ের পাতা এবং চোখকে আক্রমণ করা যায়, তাহলে তার বাহুবল, পেশীশক্তি কোনাে কাজেই লাগে না। সুতরাং শত্রুকে ভালাে করে জানার অর্থ শত্রুর সমস্ত দুর্বলতাকে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা। কোথায় আঘাত করতে বেশি জোর লাগে না, অথচ শত্রু দুর্বল হয়, তা খুঁজে বের করা।
স্বভাবতই এ কাজ বিরাট দল বেঁধে করা যায় না। তাই প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধাদের তিন অথবা পাঁচজনের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করতে হবে। এদের মধ্যে একজন রাজনৈতিক শিক্ষক এবং অন্তত দু’জন যােগাযােগ ও আক্রমণের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। এভাবে এই ক্ষুদ্র দলটি অবাধ গ্রামে গ্রামে প্রায় অলক্ষিতভাবে ঘুরে বেড়াতে পারবেন এবং গ্রামের কৃষকদের মধ্যে প্রচার ও সংগঠন গড়ে তুলবেন। অস্ত্রচালনা, সরঞ্জাম ব্যবহার, প্রাথমিক চিকিৎসা ও রাজনৈতিক শিক্ষায় এই দলের প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধাকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
প্রাচ্যের অভিজ্ঞতা থেকে তারা গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামান্তরে সংবাদ আদান প্রদান ও যােগাযােগের ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন। এটাই দীর্ঘকালব্যাপী ধৈর্য ও সহনশীলতার পর্যায়।
এ রকম অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল মানবদেহের অসংখ্য কোষের মতাে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকবেন। শত্রু পক্ষের সৈন্যদলকে ভুলিয়ে বিপথে পরিচালনা, বিচ্ছিন্ন শত্রু সৈন্যকে ঘিরে ধ্বংস করা, যােগাযােগ ব্যবস্থা সেতু, ডাকঘর পুড়িয়ে দেয়া, খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করে দেয়া এসবই এই গেরিলা বাহিনীগুলাের প্রাথমিক দায়িত্ব।
গেরিলা বাহিনীকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রিয় হতে হবে, নম্র সদয় ব্যবহার করে তাদের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়িয়ে তাদের চিত্ত জয় করতে হবে। সব রকম ঔদ্ধত্য, সবজান্তা, হুকুম জারি করার মনােভাব এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ গেরিলা দলের একমাত্র আশ্রয় ও প্রেরণার উৎস সাধারণ জনগণ। সাহসী অথচ , দৃঢ় অথচ বিনয়ী, ক্ষিপ্র অথচ নিশ্চল মৃতের মতাে পড়ে থাকার অভ্যাস তাদের প্রত্যেককে শিখে নিতে হবে।
এই গেরিলাদল কোনাে গ্রামে জনসাধারণের সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হলেই সেখানে ঘাঁটি তৈরি করতে হবে। অত্যাচারী, জমিদার গ্রামীণ শশাষকদের নিশ্চিহ্ন করে গ্রামীণ জনতার হাতে গ্রামের ফসলের জমি, গােচারণের মাঠ, পুকুর প্রভৃতি তুলে দিতে হবে এবং সাহসী জঙ্গি ভূমিহীন কৃষকদের জোয়ান সন্তানদের মুক্তি ফ্রন্টে এবং শেষ পর্যন্ত সক্রিয় গেরিলাদলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
গেরিলা যুদ্ধের মূলনীতি শত্রুর দুর্বল স্থানে আঘাত করা, শত্রুর আক্রমণের মােকাবেলা না করে তার চোখে ধুলাে দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া। বিশ্রামরত শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলা। এই কাজে সাধারণ মানুষের প্রকৃতিদত্ত সৃজনী প্রতিভাকে বিকশিত করা। মূলনীতি হলাে, শত্রু এখন আক্রমণ করে গেরিলাযােদ্ধারা তখন আত্মগােপন করেন, শত্রু যখন বিশ্রাম করে, গেরিলা যােদ্ধা তখন তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলেন, শত্রু যখন পালিয়ে যায়, তারা তখন তার পশ্চাদ্ভাবন করেন।
বাংলাদেশের বিরাট সংখ্যক জনসাধারণ ভােট দিয়ে সমর্থন জানালেও, সাধারণ দাবিকে রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে রূপায়িত করা হয় নি বলে, প্রাথমিক পর্যায়ে শ্রেষ্ঠতর অস্ত্রবল জয়ী হয়েছে। সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বভাবতই এই প্রাথমিক জয়কে রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চাইবে। আর তাদের রাজনীতি হলাে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশের জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির, ধর্মীয় জিগির এবং পশ্চাদপদ মনােভাবকে উসকিয়ে তােলার রাজনীতি। এই ধরনের রাজনৈতিক আক্রমণের মােকাবেলা করতে হলে ব্যাপক অর্থনৈতিক সংস্কার এবং তার ওপর রাজনৈতিক সমর্থনকে দৃঢ় করে তুলতে হবে।
যে ভাবেই হােক শত্রুকে মুখােমুখি লড়াইয়ে টেনে আনার চেষ্টা পরিহার করে, প্রথমত শত্রুর যােগাযােগ সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ চালিয়ে যেতে হবে।
শত্রু সৈন্য এলাকায় প্রবেশ করার চেষ্টা করলে, তাকে এড়িয়ে যাবার কৌশল অবলম্বন করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। গেরিলা দলকে জনগণের মধ্যে ওতপ্রােতভাবে মিশে যেতে হবে। আবার শত্রুসৈন্য বিশ্রাম করতে বসলেই তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হবে। এর জন্য দেশের ভূ-প্রকৃতি, খাল-বিল, নদীনালা, পাহাড়-জঙ্গল এমনকি বিষধর সাপ, সেঁক এদেরও কাজে লাগাবার উপায় অবলম্বন করতে হবে। এভাবে ভূ-প্রকৃতিকে কাজে লাগাতে হলে সাধারণ মানুষের সীমাহীন সৃজনী প্রতিভা ও কৌশল উদ্ভাবনের শক্তির ওপরই নির্ভর করতে হবে। ভিয়েতনামের বীর গেরিলাদল যেভাবে শ্রেষ্ঠ মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত মার্কিন সেনাবাহিনীকে শেষ পর্যন্ত গুটিকয় শহরে আটকে রাখতে পেরেছে, বাংলাদেশের গেরিলাদলেরও তা অনুসরণ করতে না পারার কারণ নেই।
এভাবে বেশ কিছুদিন চলতে পারলে সশস্ত্র শত্রু সেনাদল শহরের ঘাটি ছেড়ে ছােট ছােট দলে আর গ্রামে প্রবেশ করতে চাইবে না। ইতিমধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গেরিলা দল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হবেন, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী হবেন এবং শত্রুর মারণাস্ত্র কেড়ে নিয়ে কীভাবে নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডার বাড়িয়ে তােলা যায় তা শিখে নেবেন।
তখন তাদের ক্ষুদ্র সংগঠন বজায় রেখেই অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর সেনাদল তৈরি করার সুযােগ আসবে। যেমন পাঁচজনের একশ বা পঞ্চাশটি গ্রুপকে অবস্থা বুঝে পাঁচশাে বা আড়াইশাে সুসজ্জিত শিক্ষিত সেনাদলের মধ্যে সংগঠিত করতে হবে। বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতা দৃঢ় হবার সঙ্গে সঙ্গে ছােট ছােট শহরের ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করতে হবে। কিন্তু বৃহত্তর সেনাদল সংগঠনের সময় সেনাদলের দ্রুত চলাচলের শক্তি অক্ষুন্ন রাখতেই হবে।
এভাবে কয়েক বছর চললে দুটি প্রধান সুযােগ মুক্তি সংগ্রামীদের করায়ত্ত হবে। প্রথমত, দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরােধ সংগ্রামের ফলে শহরভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়বে। সামরিক সরকারের আর্থিক ভিত্তি নড়ে উঠবে। আক্রমণকারী সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে এবং এই দুর্বল অবস্থার সুযােগ নিয়ে আরাে অপেক্ষাকৃত বড়াে ধরনের লড়াই, বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন এলাকাকে মুক্তি ফ্রন্টের কার্যকরী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখা দেবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এই বৃথা আক্রমণ চালিয়ে যাবার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হবেন। তাঁদেরও আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি প্রবল হয়ে উঠবে। তাঁরাও শাসকশ্রেণীর স্বৈরাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার প্রেরণা পাবেন। যেমন ভিয়েতনামে মার্কিন আক্রমণের বিরুদ্ধে আজ খােদ আমেরিকায় বিপুল সংখ্যক জনগণ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন, একদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষও এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠবেন। | বাংলাদেশে শ্রমিক, কৃষক মধ্যবিত্তের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ, তার রাজনীতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু, বালুচ, পাখতুন, পাঞ্জাবি কৃষক-শ্রমিক মধ্যবিত্তকে প্রভাবিত না করে পারে না। পাকিস্তানের জাতিগুলাের সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার চাই, এই জাতীয় দাবির ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি ও ঐক্য বজায় রাখা যে সম্ভব ছিল এ কথা যেদিন পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ হৃদয়ঙ্গম করবেন, সেদিন তারাও বাংলাদেশের মুক্তিযোেদ্ধাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের টুটি চেপে ধরবেন।
পাকিস্তানের বাঙালি, সিন্ধী, পাঞ্জাবি, বালুচ ও পাখতুন জনগণের সম্পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি পাকিস্তানের সমগ্র জনগণকে সামরিক ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে টেনে নিয়ে আসতে পারে, এ সম্ভাবনা শুধু বাস্তব তাই নয়, একে বাস্তবে রূপায়িত করে তুলতেই হবে। এ সম্ভাবনার ভিত্তি ইতিপূর্বেই রচিত হয়েছে, এখন তাকে সক্রিয় প্রতিরােধ এবং ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে সংগঠিত হবে।
সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আক্রমণমূলক প্রতিরােধ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিসমূহের সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য স্থাপন এই দ্বৈত নীতিকে রূপায়িত করেই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীরা পাকিস্তানের জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবেন।
দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের রাজনীতি ও রণনীতিকে অনুধাবন করে নমনীয় রণকৌশলের সার্থক প্রয়ােগ করতে সক্ষম হলে বাংলাদেশের বীর জনগণের জয় অনিবার্য, এ কথা শাসকশ্রেণীও বােঝে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আজ ইতিহাসের ইঙ্গিতে যে দায়িত্বভার তুলে নিয়ে অজস্র শশাণিত সিঞ্চনে, অশ্রু, অনশন সুযােগসুবিধার প্রলােভন অগ্রাহ্য করে যে সফলভাবে তা পালন করবেন, এ বিশ্বাস না রাখার কোনাে হেতু নেই।।

সূত্র: দর্পণ
১৪.০৫.১৯৭১