You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | ভারত মহাসাগরে ক্ষমতা রাজনীতির প্রসার- রমাপ্রসাদ মল্লিক | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

ভারত মহাসাগরে ক্ষমতা রাজনীতির প্রসার
রমাপ্রসাদ মল্লিক

ভারতের ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী সম্প্রতি তাদের সরকারি যন্ত্রকে পারস্পরিক সংঘর্ষ সম্ভাবনাপূর্ণ টানাপােড়েন, উত্তেজনা এবং তিক্ততার পরম্পরা থেকে সরিয়ে পারস্পরিক বােঝাপড়া এবং আপােসের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টিত হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশকে উপলক্ষ করে কূটনৈতিক লড়াই চলেছে, যার কারণ এবং উদ্দেশ্য দু’তরফেই সুদূরপ্রসারী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মহাশয়ার সূক্ষ্ম চাতুর্যপূর্ণ উক্তি- (এক) ভারত কাউকে ভয় পায় না, না পাকিস্তান না চীন; (দুই) বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে ভারত সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে; (৩) স্বীকৃতি প্রদানের প্রশ্ন বিবেচনাধীন এবং উপযুক্ত সময়ের প্রতীক্ষায়—খতিয়ে দেখলে পরিষ্কার বােঝা যায় যে, বাংলাদেশ সম্বন্ধে ‘সহানুভূতি’র প্রবল বন্যা সত্ত্বেও ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক তথা বিত্তপতি বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্ৰেণীকে এবং তস্য মুরুব্বি ডলার সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার শাসকচক্রকে ঘটাতে চায় না। তাদের পেছনে যে বিত্ত-পুঁজি-শিল্পপতি তথা আমলাতন্ত্রীরা রয়েছে, তারা পাকিস্তানে ক্ষমতাধারী অনুরূপ শ্রেণী অপেক্ষা আরও দৈত্যাকার, আরও শক্তিশালী এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার মানদণ্ডে আরও নির্ভরযােগ্য।
সুতরাং চতুর্থ যােজনা পরিপূরণের অভিযানে পুঁজি-উপচী ভারত সরকার আমেরিকান সাহায্যের ব্যাকুল প্রত্যাশী থাকবে, তাতে আশ্চর্যের কী? তাই, বর্তমান ডলার সঙ্কটে উক্ত মুদ্রার স্থিতিশীলতাই যখন বিপন্ন তখনও ভারতের সরকারি প্রবক্তাকে বলতে হয়, ডলার-মূল্য সম্পৃক্ত য়ুরােপীয় মুদ্রাবাজারের ডামাডােল অবস্থা সত্ত্বেও ভারতীয় মুদ্রা নাকি অবিচল। অর্থাৎ ভারতের রুপী এবং আমেরিকার ডলারের বিনিময় হার কেবল নয়, পারস্পরিক সহযােগিতা অব্যাহত থাকবে। ভারতের ধনতন্ত্রী অর্থনীতি সম্প্রসারণ যাকে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে পাকিস্তানের সমচারিত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে একই ডলারের জাহাজে বিচরণশীল। ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় স্তরে সম্বন্ধকে সে কারণে বিপর্যস্ত হতে দেয়া যায় না বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার মতাে এক অহেতুক পদক্ষেপ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী মহাশয়া তাই ঝুঁকি নিতে চান না পাকিস্তানকে চটানাের। তিনি ঝুঁকি নিতে চান না, আমেরিকার শাসক মহলে বিরক্তি উৎপাদনের। জেনারেল কারিয়াপ্পা (ইয়াহিয়া খার আর্মি-আমলাতন্ত্রী মহাশয়ার এই স্বীকৃতি না দেয়ারূপী ‘সুবিবেচনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। দুই রাষ্ট্রের শাসকবর্গের যােগসূত্র কোথায় তা এই প্রাক্তন কমান্ডার ইন চিফ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
ভারতের সমরকৌশল নীতি এবং প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র উত্তর-পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমে কয়েকটি কেন্দ্রবিন্দুর ওপরে সন্নিবদ্ধ। ভূটান, আসাম, নেফা, নাগাল্যান্ড, কাছাড়, ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর কলকাতা শিল্পাঞ্চল তথা উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি কোচবিহার সিকিমের সংযােজক ত্রিকোণাঞ্চল- এই ক্ষেত্রগুলাের নিরাপত্তাভিত্তিকে ব্যবস্থা গ্রহণ ভারতের রণনীতির এক মুখ। অপরমুখ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে রূপায়িত। অবশ্য হিমালয়ী উত্তর সীমান্ত ১৯৬২ সালের সংঘর্ষের তিন বছর আগে থেকেই সরগরম; কিন্তু এ সীমান্তে ভারতের কল্পিত প্রতিপক্ষ যে রাষ্ট্র তার সঙ্গে মুখােমুখি রয়েছে আন্তর্জাতিক স্তরে পৃথিবীর দুই বৃহৎ বিশ্বশক্তি আমেরিকা এবং সােভিয়েত রাশিয়া। এই রাষ্ট্রদ্বয় ভারতের আন্তর্জাতিক রাজনীতি তথা সমরকৌশল ও পদ্ধতির প্রয়ােগ সমস্যা অনেক সরল ও সংক্ষিপ্ত করেছে এই হিসেবে যে, এদের বিপুল নৌবাহিনী ও আকাশবাহিনীর সাহচার্য যে কোনাে সঙ্কটমুহূর্তে ভারত সরকারের প্রয়ােজনে হাজির হতে পারে। ১৯৬২-র শেষভাগে আমেরিকান নৌ-শক্তির দ্বারা এমনি সাহায্যের সম্ভাব্যতা বাস্তবে রূপায়িত করেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পিতার জবাহরলাল (জওয়াহেরলাল) নেহরু স্বয়ং। অবশ্য তা যুদ্ধের ঘটঘটায় প্রধৃমিত হয়নি।
সত্তর দশকের গােড়া থেকেই কিন্তু আন্তর্জাতিক সামরিক ভারসাম্য বিষমভাবে নাড়া খেয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তেই আর বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারেনি। এডেনের পূর্বে তাই ব্রিটেনের নৌবাহিনীর বিচরণ ও সক্রিয় প্রভাব ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর থেকে অবক্ষীণ ব্রিটেন তার সামরিক উপস্থিতি ও ভূমিকাকে শেষ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয় মূলত অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে। এই সঙ্কট আজ প্রায় চরমে যখন বিরােধী লেবরপ্রবক্তদের ভাষায় মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার প্রয়াসে ব্রিটেনের কনসারভেটিভ দলীয় সরকারকে কৃত্রিমভাবে বেকারত্ব বৃদ্ধি করতে হয়; অর্থাৎ এক উপসর্গ দিয়ে মূল রােগের আর এক উপসর্গকে ঠেকানাে। এ হেন ব্রিটেন দ্বারা পরিত্যক্ত ভারত মহাসাগরের বিশাল এলাকার শূন্যতা পরিপূরণের কথা উঠবে বৈ কি! শূন্যতা শুধু যে অনুপ্রবেশকারীকে আমন্ত্রণ করে আনে তাই নয়, অনিবার্য করে তােলে শক্তি-সংঘর্ষের ঝড়।
ভারত সরকার অবশ্য বার বার প্রতিবাদ করেছে, জানাতে চেয়েছে যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শূন্যতা পরিপূরণের নাকি প্রশ্ন ওঠে না। তথাপি, বাস্তব ঘটনাবলী এবং বিকাশমান রাজনৈতিক তথা সামরিক পরিস্থিতি প্রমাণ করে ঠিক উল্টো সত্য। ভারত মহাসাগর এক বহুবিস্তৃত অঞ্চল। পশ্চিমে আরব উপসাগরের মুখে গুরুত্বপূর্ণ এডেন এবং সেকোট্টা দ্বীপ, দক্ষিণে মরিশাস, মধ্যে সিচিলিস-ম্যালডিভ-ল্যাকডিভ দ্বীপপুঞ্জগুলাে সিংহল এবং আন্দামান-নিকোবার, দক্ষিণ পূর্বে সিঙ্গাপুর। এছাড়া রয়েছে ভারতের সুদীর্ঘ সমুদ্র উপকূল এবং পূর্ব পাকিস্তানেরও।
ভারত মহাসগার অঞ্চলে কয়েক বছর যাবত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তৎপরতা বাড়িয়ে চলেছে। সিচিলিস দ্বীপপুঞ্জকে নৌঘাটি হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা নতুন নয়। এখানে ব্রিটেন একটি তথাকথিত স্বাধীন অথচ বশংবদ সরকার স্থাপন করেছে। এর রাজধানীকে তেল রসদ ইত্যাদি নেবার একটি সুবিধাজনক নৌবাহিনী কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিঙ্গাপুর এবং জাভা থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত একাধিক আশ্রয়স্থল এবং বন্দর ব্রিটেন এবং আমেরিকা প্রভাবাধীন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকান সেনাবাহিনীকে একদিন না একদিন ফেরত নিতেই হবে; তখন থাইল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূল এবং মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরের পােতাশ্রয়গুলােতে ডকিং, মেরামতি এবং নৌবাহিনীর পক্ষে অপরিহার্য প্রয়ােজন মেটানাের ব্যবস্থা চলবে, চাই কি আণবিক শক্তিচালিত দূরপাল্লায় সাবমেরিনের যাত্রাবিরতিস্থল হিসেবে কাজে লাগানও। ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ মধ্যাঞ্চলে ভারত তার দীর্ঘ তটরেখা সমেত বিদ্যমান।
পশ্চিম উপকূলে বম্বে গােয়া এবং কোচিন; পূর্বে মাদ্রাজ পারাদ্বীপ বিশাখাপত্তনম এবং কলকাতা ব্যারাকপুর (আকাশ তথা নৌবাহিনীর আড্ডা) কেন্দ্রগুলাে ভারতমহাসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি ভারসাম্যের টানাপােড়েনে যথেষ্ট অবস্থান গুরুত্ব রাখে।
ভারতের পার্লামেন্টে প্রতিরক্ষামন্ত্রী অস্বীকার করা সত্ত্বেও বার বার খবর রটছে যে, সােভিয়েত নৌবাহিনীর কতিপয় যুদ্ধ জাহাজ এই অঞ্চলে ঘােরাফেরা করছে, যুদ্ধ মহড়া দিচ্ছে, বয়াপেতে চলমান অবস্থায় রণপােতগুলাের তেল রসদ ইত্যাদি নেবার অভ্যাস চালাচ্ছে। এছাড়া আর এক টাইপের নির্দেশক বয়া ব্যবহার করে রাশিয়া তার সাবমেরিনাগুলাের যাতায়াতের সুবিধা করে দিচ্ছে। বলা বাহুল্য, নিকট প্রাচ্যঅবধি সর্বত্র আমেরিকা এবং রুশী নৌবাহিনীর রেষারেষি এবং সামরিক প্রস্তুতির প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। ভারত মাহসাগর এলাকায় প্রথমােক্তের প্রাথমিক সুবিধা দু’দিকে (এক) ব্রিটেনের প্রভাবাধীন এবং প্রতিষ্ঠিত নৌকেন্দ্রগুলােতে যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয় সাজ সরঞ্জামের সুযােগ সুবিধা; (দুই) নয়া ঔপনিবেশী কায়দায় বিভিন্ন দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রগুলােকে তথাকথিত সাহায্যের রশিতে বেঁধে পরােক্ষভাবে সেখানকার বন্দর এবং ঘাঁটিগুলােতে অবস্থিত সামরিক য়ুনিট এবং প্রতিষ্ঠানের সাহায্য লাভ।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত সরকার উপরােক্ত বৃহৎ শক্তিদ্বয়ের মাঝে একজনের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারে না। তবে ঘটনাচক্রে প্রতীয়মান হয়ে যে, ভারত বরঞ্চ রাশিয়াকে সামরিক সহযােগিতা দেবে। এর কারণ- (এক) ভারতকে রাশিয়া চারটি সামেরিন সরবরাহ করেছে এবং সেই সঙ্গে সাবমেরিন নাবিকদের প্রশিক্ষণ, বিশাখাপত্তমে সাবমেরিন ঘাঁটি গড়ে তােলার ব্যাপারে সহযােগিতাও দিচ্ছে। এছাড়া মিগ বিমান, বিমান ইঞ্জিন, জটিল ও ভারি ইঞ্জিনিয়ারিং যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা উৎপাদনক্ষম করে তােলার ব্যাপারে রুশি সাহায্য ভারতকে ক্রমশই রুশিয়ার মুখাপেক্ষী করে তুলছে বাণিজ্যগত ব্যাপারে দুই দেশের অর্থনীতি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে।
কেবল বিশাখাপত্তমে নয়, শােনা যায় যে, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জেও রুশীয় নৌবাহিনীর বন্ধুত্বপূর্ণ উপস্থিতি ক্রমবর্ধমান। যুদ্ধজাহাজের শুভেচ্ছা সফর এমন এক মাধ্যম যার দৌলতে বিদেশি রাষ্ট্রের নৌবহর এ দেশের নৌ-অফিসার, এমনকি আর্মির উচ্চ পদাধিকারী মহলেও দহরম-মহরম বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ইদানিং আমেরিকান রণতরীর উপস্থিতি যেমন তেমনি রুশীদেরও ঘটছে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ। উক্ত মহাসাগর অঞ্চলে রুশী যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা, শস্ত্রসজ্জা, একবার মাত্র তেল নিয়ে পরিক্রমার পরিধি এ সকল বিষয়ে তথ্যাদি নানা মহল থেকে পাওয়া যাচ্ছে। হালে পাওয়া খবরে জানা যায় যে, সাতটি যুদ্ধজাহাজ, চারটি সাবমেরিন এবং নয়টি ট্রলার জাতীয় জাহাজ রুশী নৌবাহিনীর এই অঞ্চলে নিয়ােজিত শক্তি। এডেন খাঁড়ির মুখে য়িমেনের হচ্ছাইডা, এডেন বন্দর এবং নিকটবর্তী সেকোট্টা দ্বীপে রুশীরা তাদের নৌশক্তির কেন্দ্র গড়ে তুলতে ব্যস্ত। আমেরিকানরা এই অঞ্চলে ঠিক কী জাতের যুদ্ধজাহাজ মােতায়েন রেখেছে তা বলা যায় না। আমেরিকার রণনীতি অত্যন্ত কঠিন গােপনীয়তায় নিরুপিত হলেও পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সঙ্গে যােগাযোেগ (তুরস্কের মাধ্যমে সাহায্যদান যার অঙ্গ) প্রকাশ হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশে নিপীড়নকারী সামরিক অভিযান পাকিস্তানের সফল হবার মূলে আছে এমনি বকলমে আমেরিকার সাহায্যলাভ।
ভূমধ্যসাগরে যেমন, ভারত মহাসাগরেও তেমনি, আমেরিকা ও রুশী নৌবাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ভারত এবং পাকিস্তানকে আশ্রয় করে শক্তিদ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে। তবে এই দ্বন্দ্ব ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ বাধাবে না। কেননা তাহলে ভারতের শাসকবর্গের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে পড়বে পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর সঙ্গে অর্থক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। যদিও সম্ভাব্য ভারত পাকিস্তান সংঘর্ষের প্রথম অধ্যায়ে ভারতীয় নৌবহর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নৌকেন্দ্রগুলােকে (যথা চালনা, চট্টগ্রাম, নােয়াখালি, ভােলা এবং সন্দ্বীপ) অকেজো এবং বর্তমান পাকিস্তানি সেনা সমাবেশকে পর্যুদস্ত করে দেবার ক্ষমতা রাখে, সে ক্ষমতা আদৌ কাজে লাগানাে হবে কিনা সন্দেহ। কারণ, আমেরিকা তা হতে দেবে না। পাকিস্তানকে প্রভাবাধীন ক্ষেত্রে ধরে রাখার জন্য এবং পাকিস্তানের সামরিক শক্তিকে ভবিষ্যতে স্বপক্ষে পাওয়ার উদ্দেশে আমেরিকা পাকিস্তানের বর্তমান শাসকচক্রকে সমর্থন করে যাবে; অবশ্য একনায়কতন্ত্রের ব্যক্তি বিশেষকে সরিয়ে ভিন্ন ধাঁচের সরকারি যন্ত্র গড়ে উঠতে সাহায্য করাও আমেরিকার অন্যতম উদ্দেশ্য। ফলে চীনকে ঠেকানােও হবে সম্ভব। চীনকে দু’মুখাে নীতির শিকার বানিয়ে পাকিস্তান ধোঁকা দিয়ে যেতে চায়, তবে এ ধোঁকা কতদিন টিকবে বলা যায় না।
আমেরিকার শাসকশ্রেণীর একাংশ আজ ধীরস্থির রাজনৈতিক হিসাব অনুসারে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রতীক্ষায়। পাকিস্তানের শিল্প, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য এবং বিকাশ স্তম্ভিত, রুদ্ধ অবস্থায়; তার বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল আজ এতই ব্যয়িত এবং বিপজ্জনক রেখার নিচে যে বৈদেশিক ঋণ পরিশােধের দেয় কিস্তি ও সুদ চুকোতেই তা ফাঁক হয়ে যেতে পারে। দেনার দায়ে যুদ্ধের খরচ মাথায় ওঠবার উপক্রম হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনিক ছাঁদকে পুনর্বার সাজিয়ে তোেলা দূরে থাক। এমনি পর্যায়ে পাকিস্তানি শাসকমহলের সামনে রয়েছে দুটি রাস্তা-(এক) পূর্বাঞ্চলের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগের দায় ও দায়িত্ব, মায় সম্পত্তি এবং প্রতিষ্ঠান ঐ অঞ্চলের বাইরে থেকে আসা উদ্যোগপতিদের হাতে সমর্পণ; (দুই) নতুবা, ক্রমশ চীনের সাহায্য নির্ভর হয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের সকল দিকগুলাে চৈনিক অর্থনীতির (এবং স্বতই রাজনীতির সঙ্গে গ্রন্থন করা। প্রথম পথ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর মনপুত হলেও বিত্তপতিদের মাঝে যারা শীর্ষস্থানীয় তারা তাদের দূরপ্রসারী স্বার্থের মুখে চেয়ে এমনি অবিমৃষ্যকারী নীতি গ্রহণ করবে না, কারণ তাহলে স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে ধনতন্ত্রী ঠাটে সহযােগ লাভের আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। দ্বিতীয় পথও উক্ত বিত্তপতিদের তীব্র বিরােধিতার সম্মুখীন হবে; পেছনে সমর্থন জোগাবে আমেরিকার বিরাটকায় ধনিক মুরুব্বিরা। ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের সরকারের ওপর আমেরিকার উক্ত জোটের দৈত্যাকার শিল্প-বিত্তসংস্থার মালিকবর্গ তথা সামরিক আমলাতন্ত্রের যারা মাথায় তাদের চাপ আমেরিকা সরকারের সূক্ষ্ম অথচ প্রচণ্ড প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের সমস্যার এক রাজনৈতিক সমাধানের দিশায় কাজ অবশ্য আমেরিকার বিশ্ব রাজনীতি করতে শুরু করেছে। এই সমাধান তথা রণকৌশলগত লক্ষ্য এবং উদ্দেশের অনুকূল যাতে হয় সে চেষ্টাও চলছে, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের উপকূলরেখা বরাবর একসারি নৌঘাটি আমেরিকা নৌবহরের ভবিষ্যত বিচরণ এবং মহড়ার জন্য আশ্রয় ও শক্তির ভিত্তি দুই যাতে জোগায় তারই প্রয়াস।
এমনি আন্তর্জাতিক ক্ষমতা রাজনীতির গােপন ক্রিয়ার কথা খেয়ালে রেখে সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করছেন যে, বাংলাদেশে এমন অবস্থা সৃষ্টি হবে যখন সেখান থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুরা ফিরে যেতে পারবে এবং তাদের গণতান্ত্রিক ইচ্ছা পূর্ণ হবে।
কিন্তু এ ধরনের রাজনৈতিক রফায়— যাতে পাকিস্তানের বর্তমান স্বৈরাচারভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামাে বজায় রেখে বাংলাদেশে লাগাম পরা গণতন্ত্র কায়েম করা চলবে আমেরিকা নব-সাম্রাজ্যবাদের নিট মােটা লাভ হলেও রুশিয়ার স্বার্থ এ অঞ্চলে হবে বিপন্ন এবং চীনেরও ঘটবে কূটনৈতিক পরাজয়!

সূত্র: দর্পণ
০৪.০৬.১৯৭১