বাঙলাদেশের ঘটনাবলী এক নতুন ধরনের ঔপনিবেশিকতার ইঙ্গিতবহ-মাদাগাস্কারের জননেতা
(স্টাফ রিপাের্টার)
কলকাতা, ২৪ সেপ্টেম্বর মাদাগাস্কারের পার্লামেন্ট সদস্য তথা মালাগাসি জার্নালিস্ট এসােসিয়েশন এর সম্পাদক আরাসেনে রাতসিকেহারা উত্তর বঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে কলকাতায় ফিরে এসে আজ কালান্তরকে জানিয়েছেন, “বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে এঙ্গোলা-মােজাম্বিকের মুক্তি সংগ্রামের অনেক মিল আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক তথা গণ-সংগঠনের কাছ থেকে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে আমার ধারণা, বাঙলাদেশের ঘটনাবলী নতুন ধরনের এক ঔপনিবেশিকতার ইঙ্গিতবহ।” তার মতে (ক্ল্যাসিকাল) অর্থে আমরা যাকে ‘ঔপনিবেশিকতা বলে থাকি বাঙলাদেশে তা নেই ঠিকই, কিন্তু আরেক প্রকার ঔপনিবেশিকতায় সেখানকার মানুষ নগড়বদ্ধ। এটা একটা অভিনব ঘটনা। রাত সিকেহারা বিশ্বশান্তি সংসদের এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর ও জলপাইগুড়িতে তিনটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে ছিন্নমূল নরনারীর অসীম দূরবস্থা প্রতক্ষ্য করেছেন। ২১ তারিখ ভােরবেলা প্রতিনিধিদল উত্তরবঙ্গ রওনা হয় এবং আজ বিকেলে ফিরে আসে। প্রতিনিধিদলের একজন সদস্য বিশ্বশান্তি সংসদের প্রেসিডেন্সিয়াল কমিটির সভা এবং সিরিয়ার প্রখ্যাত জননেতা মােরাদ কুয়াটলি-আজই কলকাতা ত্যাগ করেছেন। অন্যান্য সদস্যগণ-রাতসিকেহেরা, ফ্রান্সের লিওন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের পর অধ্যাপক জিন ইয়েডস, জোলি, ভেনেজুয়েলার পালামেন্টের সভ্য ডঃ ফ্রান্সিসকো ফারাকো, ইরাকের বার্থ পার্টির নেতা মুইজ আল খাতীব এবং গণতান্ত্রিক যুব সমাজের বিশ্ব ফেডারেশনের প্রাক্তন সম্পাদক ও ইরাকের কামউনিস্ট নেতা রহিম আজিনা আজ সন্ধ্যায় পশ্চিমবঙ্গ শান্তি সংসদের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মণীন্দ্রলাল বিশ্বাসের সঙ্গে এক ঘরােয়া আলােচনায় মিলিত হন। আগামীকাল তারা সবাই নয়াদিল্লী অভিমুখে যাত্রা করছেন। রাতসিফেহেরা শুধু সাংবাদিক নন, তিনি মাদাগাস্কারের একমাত্র…ডেমােক্রেটিক পার্টি ফর ইন্ডিপেনেডন্স অব মাদাগাস্কার (মাদাগাস্কারের স্বাধীনতার জন্য গঠিত গণতান্ত্রিক পার্টি)-র সহকারী সম্পাদক। উনি শরণার্থীদের আশ্চর্য সাহসিকতার সাথে সমস্যা মােকাবিলার জন্য অভিনন্দন জানালেন। শরণার্থী সহায়তায় ভারত সরকারের ভূমিকারও সপ্রশংস উল্লেখ করলেন। বললেন, “যাবার আগে দিল্লীতে নিখিল ভারত শান্তি সংসদের সাধারণ সম্পাদকের হাতে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে কিছু অর্থ মালাগাসি শান্তি সংগঠন এবং আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের পক্ষ থেকে দিয়ে যাবে প্রতীকস্বরূপ।” উনি এখানে আসার আগে বাঙলাদেশ সগ্রামের প্রায় কিছুই জানতেন না। “গত দু-মাস ধরে বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে কিছু খবরাখবর পাচ্ছি, তা-ও খুবই খাপছাড়াভাবে। এইটুকু বুঝেছিলাম সমস্যাটির সঙ্গে মানবিক ও জাতীয় অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু একবারও শুনিনি যে, বাঙলাদেশের মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা চাইছেন। সেদিক থেকে জানা বােঝার পক্ষে এই সফর খুবই ফলপ্রসু হয়েছে।” অধ্যাপক জোলি বললেন, “সব দেখে শুনে মনে হয়েছে এই শােকাবহ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক অবস্থা পরিবর্তিত না হলে কোন সমাধান অসম্ভব। যে কয়জন শরণার্থীকে প্রশ্ন করেছি তাদের প্রত্যেকে বলেছে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান হতে পারে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ন্যায়সঙ্গত এবং তা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশে ফিরে গিয়ে বাঙলাদেশের জন্য কী করবেন?-এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, “ভিয়েতনামের সংগ্রামের সহায়তায় আমরা পদযাত্রা সংগঠিত করে প্রচুর বস্তু সামগ্রী সগ্রহ করেছিলাম, সেরকম কিছু নিশ্চয়ই করা যেতে পারে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ফ্রান্সের ডাক্তারদের সমিতি ঔষধি পাঠিয়েছিল, আমার আশা সমিতি এক্ষেত্রেও এগিয়ে আসবে। জনমত সংগঠিত করার জন্য আমি সবকিছু ব্যাখ্যা করে নিবন্ধ লিখব, ফ্রান্সের জাতীয় শান্তি কমিটি আহুত জনসভায় ভাষণ দেব। কারণ বাঙলাদেশের বাস্তব অবস্থাটা যথাযথভাবে কেউ জানেন না। ফরাসী শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে এর আগে আমরা গণহত্যাকে ধিক্কার দিয়ে, সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার দাবিসহ সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধানের উপর জোর দিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছি মাত্র।” ইরাকের কমিউনিস্ট নেতা রহিম আজিনা জানালেন, “কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে বলতে পারি আমাদের বক্তব্য বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে অভিন্ন। মুক্তিসংগ্রামের সমর্থনে এর আগে ইরাকের কমিউনিস্ট পার্টি প্রচার করেছে, কিন্তু তবু প্রচুর ভুল বােঝাবুঝির কারণ ছিল। আজিনা ও বার্থ পার্টির নেতা আল-খাতীব উভয়েই বললেন, “ইরাকে পাক প্রচার খুব শক্তিশালী একথাটা ঠিক নয়। আসলে বাঙলাদেশের সংগ্রামের প্রকৃত তথ্য একেবারেই প্রচারিত হয় নি।” ভেনেজুয়েলার নেতা ডঃ ফারাকো লাতিন আমেরিকার পার্লামেন্টেরিয়াল এর (এই সংগঠনটি বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সংগ্রামী এক বিবৃতি দিয়েছে) কার্যকরী সমিতির সভ্য। উনি ইংরেজী বা ফরাসী জানেন না, জানেন কেবল স্পেনীয় ভাষা। অথচ সঙ্গে কোন স্পেনীয় ভাষা জানা দোভাষী নেই। উনি সেটা ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দু’হাত তুলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে চেঁচিয়ে উঠলেন, “উই আর উইথ বাঙলাদেশ।”
সূত্র: কালান্তর, ২৫.৯.১৯৭১