চাঙ্গা হয়ে উঠেছে উ থান্টের চেতনা
বাংলাদেশের শরণার্থীদের কথা মনে পড়েছে উ থান্টের। তাদের সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছেন তিনি বিশ্বময়। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট। মাথায় কিলবিল করছে গােটা দুনিয়ার ভাবনা চিন্তা।
নিবদ্ধ মূল্যায়ণ করে তারা। উ থাল্ট দেন সেগুলাের উপর আনুক্রামিক ছাপ। এরই নাম রাষ্ট্রসঙ্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যা শুরু হয়েছে প্রায় দু’মাস আগে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। তাদের আসার বিরাম নেই। বারবার প্রসঙ্গটি তােলা হয়েছে উ থান্টের। দরবারে। তিনি শুধু বলেছেন— পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। রাষ্ট্রসঙ্ঘের চার্টারের মানবিক ধারাটি তিনি একেবারে ভুলে যেতেই বসেছিলেন। ফ্যাসাদ বাধিয়েছিলেন শরণার্থীরা। সীমান্ত পেরিয়ে আশ্রয়ের জন্য ঢুকেছেন তারা ভারতে। চোখেমুখে ভূমিতে বইছে রক্তধারা। ইয়াহিয়ার ঘাতকরা তাড়া করছে তাদের সর্বত্র। প্রাণের দায়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটেছেন অসহায় মানুষগুলাে। পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যার একটি শাখা অতিক্রম করেছে ভৌগলিক সীমান্ত। তিরিশ লক্ষ শরণার্থীর চাপে হিমসিম খাচ্ছে ভারত। আগামী ক’সপ্তাহের মধ্যে তাদের সংখ্যা হয়ত ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। বৃহৎ শক্তিগুলাের টনক নড়েছে। উ থান্টেরও মানবিক চেতনা জেগে উঠেছে।
যারা গণহত্যা এবং মানুষ খেদার জন্য দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ধিক্কার ইেন বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের মুখে। উ থান্টও তাই নীরব। বৃটেন, আমেরিকা এবং সােভিয়েট রাশিয়া ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্য উদ্বিগ্ন। তারা দুর্গত মানুষগুলাের সেবা করতে চান। অতএব উ থান্টও সেবারতী হতে ইচ্ছুক। হরেক রকমের পর্যবেক্ষক দল আসছেন এবং যাচ্ছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিনিধিরাও আছেন তাদের মধ্যে। হিসাব-নিকাশ হয়েছে অনেক। নয়াদিল্লী বলছেন তিরিশ লক্ষ শরণার্থীর ছ’মাসের সেবায় দরকার দু’শ কোটি টাকা। সম্ভাব্য বাড়তি সংখ্যা ধরা হয়নি এ হিসাবে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে ভারত সাহায্যের দাবীদার। সমস্যাটি তার একলার নয়, গােটা দুনিয়ার উ থান্টের আবেদন বিশ্বজোড়া। সরকারি এবং বেসরকারি কোন সংস্থঠন বাদ পড়েনি। সাহায্য হয়ত আসবে। বাংলাদেশ থেকে জান নিয়ে পালাতে পেরেছেন তারা কোনমতে হয়ত বেঁচে থাকবেন। তাদের ভরণপােষণের ব্যবস্থা খুবই সাময়িক। যারা জান হাতে করে এখনও পড়ে আছেন বাংলাদেশে তাদের কি গতি হবে? ছ’মাস পর শরণার্থীরাই বা যাবেন কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব দেননি বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে। সুতরাং তা দিতে পারবেন না রাষ্ট্রসঙ্রে সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্ট। অন্ধকারে পথ খুঁজছেন নয়াদিল্লী। আসল প্রশ্নের জবাব তাদেরও অজানা।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী হুশিয়ারী দিয়েছেন পাকিস্তানকে। সারা বিশ্বে চালাচ্ছেন কূটনৈতিক তৎপরতা। বাংলাদেশ থেকে বাঙ্গালী খেদান ইয়াহিয়ার সুচিন্তিত পরিকল্পনা। অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে যা পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা ভারতের কাছে তা বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কারণ, তার ঘাড়ে পড়েছে শরণার্থীর ভার। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসা প্রয়ােজন। তা না হলে শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারবেন না নিজেদের বাড়ীঘরে। ইসলামাবাদ এ দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে নয়াদিল্লী নেবেন তাদের নিজস্ব পথ। শ্ৰীমতী গান্ধীর হুমকীতে কোন কাজ হবে কিনা সন্দেহ। ঘাতকদল খাড়া ছেড়ে বলির পাঠাগুলােকে কোনদিনই আদরে বুকে জড়িয়ে ধরে না। শরণার্থীরা এই পদবাচ্য নন, রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ। ওরা কখনই বিশ্বাস করবেন না জল্লাদদের। বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসার অর্থ ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। এই অবসান ঘটাতে পারেন বাইরের সাহায্যপৃষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। বৃহৎ শক্তিগুলাে নিষ্ক্রিয় থাকলে নিষ্ক্রিয় থাকবে রাষ্ট্রসঙ্। এ অবস্থায় পথ দেখাতে হবে ভারতকে। যতদিন ইয়াহিয়া বুঝতে না পারবেন, নয়াদিল্লীর কথায় এবং কাজে নেই কোন গরমিল ততদিন তাঁর কানে জল যাবে না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মানবতার জবাই করছেন ইসলামাবাদ। তাদের হাতের ছুরি কেড়ে নিচ্ছেন না কেউ। ভাগ্যহীন আহত দেহে প্রলেপ মাখিয়ে এবং কাটা মুন্ডে জল ঢেলে মানবতার সেবা করছেন রাষ্ট্রসঙ্ এবং তার স্তম্ভ সাদৃশ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে। উ থান্টের আবেদন তারই করুণ প্রকাশ।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ মে ১৯৭১