পূর্ব বাংলার মুক্তি সংগ্রাম
শফিকুল হাসান
পূর্ব বাংলার বীর বিপ্লবী জনগণ আজ তাদের জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামকে এক দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। শশাষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার লাঞ্ছিত নিপীড়িত মেহনতি জনগণ সৃষ্টি করে চলেছেন এক যুগান্তকারী সংগ্রামী ইতিহাস। কোরিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বােডিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা ও প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত হলাে আর একটি সংগ্রামী নাম-পূর্ব বাংলা। আজ পূর্ব বাংলার সংগ্রামী জনগণ যে শােষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা করছেন তার চরিত্র কী এবং কোন ধরনের শােষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি জাতি (যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ) সামগ্রিকভাবে অস্ত্র ধারণ করেছেন। এ সম্পর্কে সম্যক ও বাস্তব জ্ঞান না থাকলে শােষক শ্রেণীর সঙ্গে জনগণের সঠিক দ্বন্দ্ব নির্ধারণে ভুল হতে পারে এবং দ্বন্দ্ব নির্ধারণে ভুল হলে এ সংগ্রাম যথার্থ সার্থকতা বহন করতে ব্যর্থ হবে। কারণ জনগণের গণযুদ্ধ হচ্ছে অত্যাচারী শােষক শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে শােষিত নির্যাতিত শ্রেণীর সঠিক বিপ্লবী যুদ্ধ, আপােষহীন সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম- মার্কসবাদ লেনিনবাদ সম্মত একটি প্রয়ােগশীল বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক নিয়মকানুনগুলাে (সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও মূলনীতি, সুস্পষ্ট রণনীতি, সময়ােপযােগী রণকৌশল, যথােপযুক্ত রণক্ষেত্র ও সঠিক শত্রু-মিত্র নির্ধারণে এবং রাজনৈতিক সচেতনসুশৃঙ্খল গণবাহিনী পরিচালনায় সক্ষম সর্বহারা কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর আদর্শনিষ্ঠ একটি বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্ব) অবশ্যই বিপ্লবী জনগণকে মেনে চলতে হবে, তা না হলে সামগ্রিক বিজয় লাভ অসম্ভব হয়ে পড়বে। বর্তম গণযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় লাভের জন্য পূর্ব বাংলার জনগণকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। পূর্ব বাংলার বর্তমান গণযুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমি খুঁজলে দেখা যাবে যে, পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ছিল এই সংগ্রামের সূচনা। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ কবলিত ভারতবর্ষের জনগণের মূল সমস্যা ও করণীয় ছিল- (১) বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শাসন ও শােষণের কবল থেকে জাতীয় মুক্তি তথা পাক-ভারতের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন এবং (২) সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার অভিশাপ থেকে সামাজিক মুক্তি তথা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে জনগণের স্বনির্ভরশীল উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন।
কিন্তু ভারতবর্ষের ধনিক ও সামন্তশ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নিজেদের মধ্যে শােষণের ক্ষমতা ও ক্ষেত্র বণ্টন করে নেবার উদ্দেশে দ্বিজাতি তত্ত্বের উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে আপােসের পথে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপর চাপ সৃষ্টি করে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে শােষণ ক্ষমতাকে পূর্ণভাবে বজায় রেখে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শােষকেরা আপােসের পথে পাকভারতের শাসন ক্ষমতাদের স্বার্থরক্ষাকারী শ্রেণীমিত্র এই দুই প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠী মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের হাতে হস্তান্তর করে। আপােসের পথে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অমার্কসীয় অবৈজ্ঞানিকভাবে অর্জিত পাকিস্তান ও ভারতের তথাকথিত এই স্বাধীনতা জনগণকে বিদেশি পুঁজির শােষণ থেকে বিন্দুমাত্র রেহাই দেয়নি, বরং নয়া ঔপনিবেশিক শােষণের মাধ্যমে শােষকশ্রেণীর সংখ্যা এবং শােষণের তীব্রতাই বৃদ্ধি করেছে।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ক্ষমতাসীন পাকিস্তানের আমলা মুৎসুদ্দি ধনিক শ্রেণী (যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেও স্বাধীন নিজস্ব জাতীয় পুঁজির বিকাশ না করে, স্বীয় স্বার্থে বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিকেই নিজ দেশে বিনিয়ােগ করে তাদের নিজ স্বার্থ রক্ষার খাতিরেই সাম্রাজ্যবাদীদের স্বার্থ রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ফলে পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদী শশাষণ পূর্বের চেয়েও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের ঔপনিবেশিক শােষণকবলিত পাকিস্তান তথাকথিত স্বাধীনতার নামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এক নয়া উপনিবেশ বা আধা-উপনিবেশে পরিণত হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের এই শাসক ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও স্বীয় পুঁজিবাদী শােষণকে বজায় রাখার উদ্দেশে সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাকে উৎখাত করে স্বনির্ভরশীল উৎপাদন ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনাে প্রচেষ্টা করেনি (মুৎসুদ্দি চরিত্র বিশিষ্ট শােষক ও শাসকরা তা করতে পারেও না), কিন্তু জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের নামে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে হিন্দু সামন্তশ্রেণীকে উৎখাত করে নিজেরাই সে শােষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার সংস্কারবাদী প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়। ফলে তৎকালীন জমিদার ও সামন্ত প্রভুদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয় সত্য, কিন্তু সরকার অনুগত জোতদার মহাজন, ইজারাদার, তহশিলদার, ঠিকাদার, মজুদদার ও তাদের তাঁবেদার বাহিনী রূপে ক্ষয়িষ্ণু সামন্তশ্রেণী শতধাবিভক্ত হয়েও সম্মিলিতভাবে রাষ্ট্রীয় সহায়তায় (পুলিশ, মিলিটারি, আইন-আদালত), বাঁচিয়ে রেখেছে সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাকে যার প্রচণ্ড শশাষণ পূর্ব বাংলার জনগণকে এক সর্বহারা জাতিতে পরিণত করেছে। ফলে পাকিস্তানে সত্যিকার জাতীয় মুক্তিবিপ্লব বা গণতান্ত্রিক বিপ্লব কোনােটাই সম্পন্ন হয়নি। এভাবে জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল আধা ঔপনেবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক।
আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আমলা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদীদের দ্বারা কখনােই সে দেশের জাতীয় পুঁজি বিকশিত হতে পারে না। মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা ঋণের মাধ্যমে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি সংগ্রহ করে নিজদেশে খাটিয়ে তার লভ্যাংশ সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে তুলে দেয় এবং এর পারিশ্রমিক হিসেবে নিজেরাও সে লভ্যাংশের কিছুটা পেয়ে থাকে। এভাবে নিজস্বার্থে এরা নিজেদের দেশের জনগণের সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে থাকে। এরা স্বাভাবিকভাবেই প্রতিক্রিয়াশীল, এরা জাতীয় শত্রু তথা জনগণের শত্রু। পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যেই তারা সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের কাছ থেকে মােট পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে (যার পরিমাণ পাকিস্তানের বাৎসরিক জাতীয় আয়ের এক চতুর্থাংশ) এবং পরিণামে বিরাট অংকের সুদ দানের মাধ্যমে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের সেবা করে আসে। অবশ্য এই ফাকে তারা নিজেরাও নিজেদের ব্যক্তিগত পুঁজি গড়ে তােলার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীদের ঋণ গ্রহণ করে তার লভ্যাংশের একটা ক্ষুদ্রতম অংশ ক্রমাগত সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিজস্ব পুঁজি দাঁড় করানাে এক বিরাট কষ্টসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দ্রুত পুঁজি গড়ে তােলার জন্য পাকিস্তানের ক্ষমতাশীন মুৎসুদ্দি পুঁজিপতিরা পুঁজিবাদী কায়দায় নিজ দেশেরই জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা উৎপাদনশীল অংশ পূর্ব বাংলার সকলশ্রেণীর জনগণের উপর চালাতে থাকে প্রচণ্ড এক ঔপনিবেশিক শােষণ। শশাষণের রূপ ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণ তাদের এ একচেটিয়া পুঁজির শােষণ থেকে বিন্দুমাত্র রেহাই পায়নি। ইসলাম, ভ্রাতৃত্ব, সংহতি, শক্তিশালী কেন্দ্র এবং শিশুরাষ্ট্রের নামে এই ঔপনেবিশিক শােষণের মাধ্যমে তারা কেড়ে নিয়েছে পূর্ব বাংলার জনগণের সকল মৌলিক অধিকার-ব্যক্তি-স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মতাদর্শের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, শিল্পীর স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তাদের প্রতিটি আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বুলেট বেয়নেট দ্বারা নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে, পৈশাচিক বর্বরতা স্তব্ধ করে দিয়েছে এ শােষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর প্রতিটি সংগ্রামী কণ্ঠকে। কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতি জনগণ যাতে শ্ৰেণীচেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শ্রেণী সংগ্রাম তথা বিপ্লবী যুদ্ধের সূচনা করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে অকথ্য শশাষণ নিপীড়নের সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নিয়েছে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার অধিকার। কায়েমী স্বার্থবাদী শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে কোনাে প্রকার গণআন্দোলন ও গণসংগ্রাম যাতে সূচিত ও সংগঠিত হতে না পারে সে জন্য মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার জঘন্য উদ্দেশে অতি সুপরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালানাে হয় পূর্ব বাংলার জনগণের ভাষা, শিল্প, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, সংবাদপত্র এবং রাজনৈতিক মতামতের উপর।
পূর্ব বাংলার উঠতি ধনিক শ্রেণী (যারা পূর্ব বাংলার জাতীয় এবং মুৎসুদ্দি ধনিক) ও সামন্ত শ্রেণীর উপর যুগপৎ আক্রমণ করে পূর্ব বাংলার অর্থনীতির উপর হানে মারাত্মক আঘাত। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করে ক্ষমতাসীন প্রতিক্রিয়াশীল সরকার নিজেই সে ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় অতি কদর্য শােষকের চেহারায়। শিল্পকলকারখানাগুলাে থেকে সুকৌশলে বাঙালি মালিকদের অপসারণ করে সেগুলােকেও তারা দখল করে নেয়। নিজেদের পুঁজির বিকাশের জন্য তারা পূর্ব বাংলার কুটির শিল্পকেও ধ্বংস করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। শুধু তাই নয় ক্ষমতাসীন কায়েমী স্বার্থবাদী পাকিস্তানি শাসক ও শােষক গােষ্ঠী সমাজের প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে বিরাট এক বৈষম্যমূলক আচরণে লিপ্ত হয় এবং শশাষণনিপীড়নের বিরুদ্ধে যাতে তারা বিপ্লবী বিদ্রোহ করতে না পারে তার জন্য প্রথম থেকেই অতি সতর্কতার সঙ্গে পূর্ব বাংলার জনগণকে নিরস্ত্র করে রাখে।
কিন্তু শশাষকদের প্রতি ইতিহাসের রায় বড় নিষ্ঠুর। যেখানেই শােষণ-নিপীড়ন সেখানেই শ্রেণীভেদ, আর এই শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণীচেতনাই শােষক ও শশাষিত শ্রেণীর মাঝে প্রথমে শ্রেণীদ্বন্দ্ব এবং পরবর্তীকালে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা করে। পূর্ব বাংলার ইতিহাসও এই একই ধারায় প্রবাহিত। দমন পীড়ন দ্বারা শােষক ও শাসকরা সাময়িকভাবে পূর্ব বাংলার ধনিক ও সামন্তশ্রেণীকে দমন করেছে, পূর্ব বাংলার বাঙালি ধনিক শ্রেণীর (মুৎসুদ্দি বা জাতীয়) পুঁজিকে বিকশিত হতে দেয়নি এবং বাঙালি সামন্ত প্রভুদের হাত থেকে জমি কেড়ে নিয়েছে সত্য, কিন্তু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের দমন বা নিশ্চিহ্ন করতে তারা পারেনি। বরং গত তেইশ বছরের ক্রমাগত শােষণ-নিপীড়নের ফলে পূর্ব বাংলার জাতীয় ধনিকরা তাদের পুঁজি হারিয়ে, সামন্ত ধনী কৃষকরা তাদের জমি হারিয়ে এবং কিছু সংখ্যক ধনী ও মাঝারি কৃষকদের সন্তান সন্ততিরা লেখাপড়া শিখে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ব বাংলার এই জাতীয় ধনিক ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য এবং তাদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অপরদিকে পূর্ব বাংলার মুৎসুদ্দি ধনিক ও সামন্তশ্রেণী তাদের শােষণের ক্ষেত্রকে পুনরুদ্ধারের আশায় তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ ৬ দফার মাধ্যমে পাকিস্তানি ক্ষমতাসীন আমলা মুৎসুদ্দি ধনিকশ্রেণীর সঙ্গে এক আপােসের প্রচেষ্টা চালায়। ‘জয় বাংলার’ উগ্র জাতীয়তাবাদের আড়ালে বিভ্রান্ত করে তারা মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীসহ পূর্ব বাংলার জনগণের একটা বিরাট অংশকে তাদের সপক্ষে টানতে সক্ষম হয়। মুৎসুদ্দি চরিত্রবিশিষ্ট পূর্ব বাংলার ধনিক ও সামন্ত শ্রেণীর রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কখনােই পূর্ব বাংলার জনগণকে পাকিস্তানি ঔপনেবিশক শােষণ, সাম্রাজ্যবাদী নয়া-ঔপনিবেশিক শােষণ এবং সামন্তবাদী শােষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের কোনাে আহ্বান জানায়নি, শ্রেণীগত চরিত্রের জন্য তা জানাতেও পারে না। বাস্তবে পাকিস্তানি শাসক, শােষক গােষ্ঠীর মিত্র রূপেই তারা চেয়েছিল একই পাকিস্তানের কাঠামােতে আপােসের পথে শশাষণের ক্ষেত্রে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা ছিল চরম প্রতিক্রিয়াশীল এবং প্রতিবিপ্লবী। তারা তাদের শ্রেণী চরিত্রের জন্যই সর্বদা শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি-কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র বিরােধিতা করেছে, অনেকক্ষেত্রে তাদেরকে আক্রমণও করেছে, জনগণের সশস্ত্র সংগ্রামের বিরােধিতা করেছে, জনগণতান্ত্রিক চীন ও সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েতের বিরােধিতা করেছে এবং পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী আমেরিকা ও বৃটেনের প্রতি তাদের সৌহার্দ্য, নির্ভরশীলতা এবং আনুগত্য প্রকাশ করেছে। ফলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সশস্ত্র শত্রু হিসেবে চিহ্নিত না করে তাদেরকে দেশের অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে ধরে নিয়ে, তাদের দেয়া তথাকথিত নির্বাচনের প্রহসনে অংশগ্রহণ করে, অহিংসা ও অসহযােগের’ গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহের পথে আওয়ামী লীগ ৬ দফা আদায়ের দাবিতে আত্মনিয়ােগ করে। কিন্তু পূর্ব বাংলার বীর বিপ্লবী জনগণ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে সশস্ত্র গণযুদ্ধের পথে অগ্রসর হতে থাকে। ফলে আওয়ামী লীগের ৬ দফার আপােস ফর্মুলার দফারফা করে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী তাদের সামগ্রিক মারণাস্ত্র নিয়ে পূর্ব বাংলার জনগণের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় গেরিলা পদ্ধতিতে জনগণের প্রতিরােধ যুদ্ধ, যা বর্তমানে দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র গণযুদ্ধের রূপ লাভ করেছে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তানি শাসক ও শােষক গােষ্ঠী মেহনতি জনগণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, কৃষক শ্রমিক শ্রেণীর মৈত্রীর সেতুবন্ধ কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘােষণা করে তাদের শ্রেণী সংগ্রামের পথে সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। গােপনে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টিগুলােও বাস্তবতার কষ্টিপাথরে সামগ্রিক পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে জনগণকে পরিচালনা করার পরিবর্তে তারাই জনতা দ্বারা বাহিত হতে থাকে এবং ঘটনার পেছনে লেজুড় বৃত্তিই তাদের প্রধান কর্ম হয়ে দেখা দেয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে দেউলে নীতির পরিচয় দেয় মস্কোপন্থী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (বর্তমান বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি)। প্রথম থেকেই এরা আওয়ামী লীগের লেজুড় বৃত্তি করতে থাকে। বাস্তবিকপক্ষে তাদের ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্টির নাম’, ‘কমিউনিজম’, ‘মার্ক-লেনিন ইত্যাদি প্রয়ােগহীন শব্দসমষ্টি ছাড়া আর কোনাে পার্থক্যই ছিল না। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম. এল.) নামধারী পার্টি পূর্ব বাংলার সামগ্রিক ও বাস্তব অবস্থার সঠিক বিশ্লেষণ না করে পূর্ব বাংলায় ভারতের বিপ্লবী রাজনীতিকে অন্ধভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করে এবং তা যান্ত্রিকভাবে প্রয়ােগের চেষ্টা করে। তারা বিভক্ত পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশে পূর্ব বাংলার জনগণের উপর পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ট সেনাবাহিনীর ইতিহাসের ঘৃণ্যতম কার্যাবলীকে প্রগতিশীল বলে বর্ণনা করে। জনগণের শত্রু হানাদার সেনাবাহিনীর ঘৃণ্যতম কার্যাবলীকে তাদের নিঃশর্ত সমর্থন পূর্ব বাংলার জনগণেরই বিরুদ্ধে কার্যকরী হয়েছে এবং তারা তাদের এ বামপন্থী বিচ্যুতির জন্য পূর্ব বাংলার ইতিহাসে সেনাবাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ এবং নারী ধর্ষণের মতাে ঘৃণ্যতম কার্যাবলীর সমর্থনকারী সহযােগী হিসেবেই পূর্ব বাংলার জনগণের ঘৃণা কুড়াবে। মহামতি লেনিনের বক্তব্য :
“Ii is beyond doubt that any national movement can only be a bourgeois democratic movement, since the overwhelming mass of the population in the backward countries consist of peasantry who represent bourgeois-capitalist relationships. It would be utopian to believe that proletrian parties in these backward countries can pursue communist tactics and a communist policy, without establishing definite relations with the peasant movement and without giving it effective support… We, as the communists, should and will support Liberation movements-only when they are genuinely revolutionary, and when their exponcuty do not hinder our work of educating and organising in a revolutionary spirit the peasantry and the masses of the exploited -(Lenin, Collected Works, Vol-31, P-241 on Report of Commission on the National and the Colonial Questions.)
একে তারা উপলব্ধির অভাবে নীতিগতভাবে বর্জন করে মহান লেনিনের মূল্যবান উপদেশ তথা লেনিনবাদের যৌক্তিকাতেই অস্বীকার করে চলেছে।
আবার পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট সমন্বয় কমিটি এবং বাংলার শ্রমিক আন্দোলন এই উভয় গ্রুপই শুধুমাত্র পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে সামন্তবাদী শােষকদের বিরুদ্ধে তাদের কোনাে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ফলে তারাও দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতিতে নিপতিত এরাও মহান মাও সে তুংএর মূল্যবান উপদেশাবলী
“In a struggle that is national in character, the class struggle takes the form of national struggle, which demonstrates the identity between the two. On one hand, for a given historical period the political and economic demands of the various classes must not be such as to disrupt cooperation; on the other hand, demands of the national struggle should be the point of departure for all class struggle. Thus there is identity in the united front between unity and independence and between the national struggle and class struggle.” (Selcted Works, Vol. 2, P-215),
এবং অন্যত্র
“The Same is true of the relationship between the class struggle and the national struggle. It is an established principle that in the war of resistance everything must be subordinated to the interests of resistance. Therefore the interests of the class struggle must be subordinated to and must not be conflict with, the interests of the war of resistance. But classes and class struggles are facts, and those people who deny the facts of class struggle are wrong, we do not deny the class struggle, we adjust it.” (Selected Works, Vol. 2, P-200)
একে উপলব্ধির অভাব হেতুই বাস্তব প্রয়ােগে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়ে বস্তুত বর্তমান যুগের মার্কসবাদলেনিনবাদকেই অস্বীকার করে চলছে।
পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতিতে বামপন্থী নামধারী এ সকল সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এখনাে অনুধাবন করার প্রচেষ্টা করছেন না যে, পাকিস্তানি শাসক ও শােষক সাম্রাজ্যবাদী শােষক ও সামন্তবাদী শােষকগােষ্ঠী পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে আক্রমণ চূড়ান্তভাবে বিপ্লবের সাফল্য আনতে সক্ষম হবে না। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীকে অক্ষত রেখে যেমন সাম্রাজ্যবাদী শশাষণকে উৎখাত করা সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় সামন্তবাদী শােষণকে বজায় রেখে পাকিস্তানি শশাষণ ও সাম্রাজ্যবাদী শশাষণকে উৎখাত করে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এ তিন শত্রুর যে কোনাে একটির বর্তমান থাকার অর্থই হলাে শােষণের অবস্থান তথা জনগণের দুঃখ-দুর্দশার উপস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে শ্রেণীসংগ্রামকে অবশ্যই চালিয়ে নিতে হবে এবং শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিতেই এই তিন শােষক শক্ত শ্রেণীকে মােকাবিলা করতে হবে। অথচ বামপন্থী নামধারী উপরােক্ত পার্টি ও গ্রুপগুলাে তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ও সামগ্রিক পরিস্থিতির বাস্তব বিচার বিশ্লেষণের দূরদর্শিতার অভাবে পূর্ব বাংলার জনগণের সামগ্রিক মুক্তির সঠিক পথে অগ্রসর না হয়ে দক্ষিণ ও বামপন্থী বিচ্যুতিতে ভুগছেন।
১৯৬৮ সালের শেষভাগে মার্কর্সবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সে তুং-এর চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে পূর্ব বাংলার শ্রমিক কৃষক সর্বহারা শ্রেণীর রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি। পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে, গেরিলা পদ্ধতিতে সশস্ত্র গণযুদ্ধের পথে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়। এতদসত্ত্বেও এই পার্টির কর্মীদের মধ্যে, পাকিস্তানি শােষণের চরিত্র, জনগণের সঙ্গে শােষক শ্রেণীর মূল দ্বন্দ্ব, বিপ্লবের চরিত্র, বিপ্লবের অবস্থা পরিস্থিতি, বিপ্লবের সঠিক পথ ও রণনীতি রণকৌশল নির্ধারণে ছিল দোদুল্যমানতা। তারাও পূর্ব বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তথাপি তারা পূর্ব বাংলার জাতীয় স্বাধীনতা ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে জনগণের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু প্রথম থেকেই জাতীয় মুক্তির প্রশ্নকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি, আবার অনেকেই শুধুমাত্র জাতীয় মুক্তির উপর সর্বাধিক গুরুত্ব অর্পণ করেন। ফলে পার্টির ভিতরেই বামপন্থী ও ডানপন্থী বিচ্যুতি বিরাজ করতে থাকে। তবে বেশ কিছু সংখ্যক বিপ্লবী কর্মী সঠিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ও গণতন্ত্রের সংগ্রামকে একটি সঠিক মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথে পরিচালনা করার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন।
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টদের এমনিতর সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোেগ পূর্ব বাংলার সামন্তধনিক শ্রেণী তথা আওয়ামী লীগ পুরােপুরি গ্রহণ করে এবং উগ্রজাতীয়তাবাদের আড়ালে পূর্ব বাংলার জাতীয় ধনিকসহ মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদেরকে তাদের নেতৃত্বে সমবেত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু জাতীয় মুক্তি ও জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র গণযুদ্ধের সূচনা হতেই নেতিবাচক আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব জনগণের নিকট মর্যাদা হারাতে থাকে। পূর্ব বাংলার সর্বহারা জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে এমনি এক সমস্যাপূর্ণ বিপ্লবী অবস্থায় পূর্ব বাংলার জনগণের এই সংগ্রামকে সশস্ত্র দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী গণযুদ্ধে রূপ দেবার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সঙ্কল্পে সশস্ত্র শত্রু শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাজনীতি সচেতন জনগণকে সশস্ত্রভাবে পরিচালনা করে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হচ্ছে একটি প্রয়ােগসাপেক্ষ সৃজনশীল বিজ্ঞান। সঠিক পথে পরিচালিত হলে ইহা অবশ্যই সাফল্য লাভ করবে। তাই জনগণের বিজয় অর্জনের জন্য চূড়ান্ত সফলতার জন্য, মার্কসবাদীলেনিনবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে পূর্ব বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতি, জনগণের সঙ্গে মূল দ্বন্দ্ব, বিপ্লবের চরিত্র, শত্রু মিত্র ও কর্তব্য নির্ধারণ ইত্যাদি অবশ্যই বিশ্লেষণ করতে হবে।
পূর্ব বাংলার বর্তমান সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা হলাে পাকিস্তানি শাসক-শােষকদের প্রেক্ষিতে ‘ঔপনেবিশক’, সাম্রাজ্যবাদী শােষকদের প্রেক্ষিতে ‘আধা বা নয়া ঔপনেবিশক এবং অভ্যন্তরীণ বহু বিভক্ত সামন্তবাদের প্রেক্ষিতে আধা সামন্ততান্ত্রিক। এরূপ সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থায় পূর্ব বাংলার বর্তমান বিপ্লবের চরিত্র দুটি (১) পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শােষণ থেকে মুক্তির প্রশ্নে ইহা ‘জাতীয় মুক্তি বিপ্লব’ এবং (২) অভ্যন্তরীণ সামন্তবাদের শােষণ থেকে মুক্তির প্রশ্নে ইহা ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতিতে এর একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি পরিচালনা করা অসম্ভব এবং এই দুই বিপ্লবকে একই সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে বলে একত্রে একে পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বলা যেতে পারে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব মূলত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’, যা জাতীয় বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে সম্পন্ন হবার কথা। কিন্তু বহুদিন আগে থেকেই বিশ্ব পরিসরে এই বুর্জোয়া শ্রেণী সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে নিজস্বার্থে উক্ত বিপ্লবী দায়িত্ব পালনের নেতৃত্ব থেকে সরে গেছে। পূর্ব বাংলার জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীও এই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে পারে না এবং ঐতিহাসিকভাবেই দায়িত্ব পালনের ভার মেহনতি জনগণের পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির উপর অর্পিত হয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী ও তার পার্টির নেতৃত্বে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় উহা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরই একটি স্তর। কমরেড মাও সে তুং এ বিপ্লবকে ন্যায়গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বা ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পূর্ব বাংলার এই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের শত্রু প্রধানত তিন গােষ্ঠী (১) পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক শােষক গােষ্ঠী, (২) নয়া ঔপনিবেশিক শােষক গােষ্ঠী তথা সাম্রাজ্যবাদ বিশেষত : মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং (৩) দেশীয় সামন্তবাদ তথা জোতদার, মহাজন, ইজারাদার, তহশীলদার, মজুদদার ইত্যাদি।
এই তিন শত্রুর পরস্পরের স্বার্থ কিছুটা ভিন্ন হলেও শশাষণের ক্ষেত্রে এরা অভিন্ন। পূর্ব বাংলার জনগণের দুঃখ কষ্টের মূল এই তিন শত্রুকে একই সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করতে হবে, সমাজ জীবন থেকে সমূলে উৎখাত করতে হবে, চূড়ান্তভাবে নির্মূল করতে হবে। একমাত্র তখনই পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সাফল্য লাভে সক্ষম হবে। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী মুক্তিযােদ্ধাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে এই তিন শত্রু পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, পরস্পর পরস্পরের মিত্র। এদের যে কোনাে এক গােষ্ঠীকে আঘাত করার উপর কম গুরুত্ব অর্পণ করলে সমগ্র শত্রুগােষ্ঠীকেই বাঁচিয়ে রাখা হবে, যার অর্থ হবে বিপ্লবী শক্তির মৃত্যু, বিপ্লবের পরাজয়। কিন্তু এই তিন শত্রুর মধ্যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক ও শােষকগােষ্ঠীর সঙ্গে বর্তমান মুহূর্তে পূর্ব বাংলার সর্ব শ্রেণীর জনগণের সংঘাত সবচেয়ে তীব্র। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের রক্ষক ও সাহায্যপুষ্ট পকিস্তানি এই মুৎসুদ্দি শােষক ও শাসক শ্রেণীকে অবশ্যই বর্তমান মুহূর্তে পূর্ব বাংলার জনগণের মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে বর্তমান মুহূর্তে মূল দ্বন্দ্ব নিঃসন্দেহে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক ও শােষক গােষ্ঠীর। যারা পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সামান্যতমও অবহিত আছেন এ বিষয়ে তাদের দ্বিমত পােষণ করার কোনাে অবকাশ নেই।
শুধু এই তিন শত্রুই নয়, এই শত্ৰুত্রয়ের দেশি বিদেশি সকল সহযােগিরাও (তা তারা যে শ্রেণীরই হােক না কেন) পূর্ব বাংলার জনগণের শত্রু। এই প্রসঙ্গে পূর্ব বাংলায় এই শত্রুদের সহযােগী তাঁবেদার বাহিনী মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পি. ডি. পি. ইত্যাদি গণবিরােধী ফ্যাসিস্টদের বিভিন্ন সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘রাজাকার বাহিনী ও তথাকথিত শান্তি কমিটি (এরা কোনাে সুনির্দিষ্ট শ্ৰেণী নয়), যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহায়তায় ক্রমাগত গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে তাদের নির্মূল করার প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী বাহিনীকে সর্বাধিক গুরুত্ব অর্পণ করতে হবে। হানাদার পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী অতর্কিতে পূর্ব বাংলার জনপদ আক্রমণ করে কিছুক্ষণ ধরে চালিয়ে যায় তাদের ধ্বংসলীলার কুকীর্তি। তাদের এই বর্বর সামরিক আক্রমণের হাত থেকে যারা অব্যাহতি পায় তাদেরকেও উক্ত রাজাকার বা শান্তিকমিটি নামধারী ফ্যাসিস্ট বাহিনীর ক্রমাগত নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হতে হয়। নিজেদের হীনস্বার্থ করার উদ্দেশে এরা নিজ এলাকারই জনগণকে ঠেলে দেয় তীব্র অত্যাচার-নিপীড়নের মুখে। হানাদার দস্যু সেনাবাহিনী অপসারণের পরও এরা জনগণের উপর যে অত্যাচার সর্বক্ষণ চালিয়ে যায়, স্থানীয়ভাবে ক্রমাগত উত্তেজনা বজায় রাখে। শােষক শাসক শ্রেণীর অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে এরা জনগণকে সংগঠিত হতে দেয় না, বরং অত্যাচারী শােষকদের এরাই সংবাদ সরবরাহ করে, পথ দেখায়। জনগণের মনােবলকে উগ্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে এরা ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়, বিপ্লবী জনশক্তিকে নির্মূল করতে এরা খুবই সচেষ্ট এবং সক্রিয়। এই সকল প্রতিক্রিয়াশীল গণদুশমনরা পূর্ব বাংলার জনগণের ভয়ঙ্কর বিষাক্ত শত্রু এবং জনগণের শত্রু পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শােষক সাম্রাজ্যবাদী শােষক শ্রেণীর ও সামন্তবাদী শােষক শ্রেণীর বিশ্বস্ত মিত্র। পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল ঘটি হবে গ্রামাঞ্চল, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এই ভয়ঙ্কর বিষাক্ত স্থানীয় শত্রুদের বাঁচিয়ে রেখে সত্যিকারের বিপ্লবী ঘাঁটি এলাকা গড়ে তােলা কোনাে ক্রমেই সম্ভবপর হবে না। পূর্ব বাংলার বিপ্লবী জনগণের প্রাথমিক কর্তব্য হবে, পাকিস্তানি হানাদার শত্রুসেনাদের আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে বা তার পূর্বে তাদের স্থানীয় সহযােগী মিত্রদের সমূলে খতম করা। মনে রাখতে হবে স্থানীয় শত্রুদের বাঁচিয়ে রেখে দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ পরিচালনা করা কোনাে প্রকারেই সম্ভব নয়।
পূর্ব বাংলার জনগণের এই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবী যুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনাে ঘটনা নয়, দীর্ঘদিন ধরে শাসক ও শােষকগােষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শােষণ-নিপীড়ন-অত্যাচার ও লাঞ্ছনার যে কলঙ্কময় অধ্যায় সৃষ্টি করেছে, তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য মুক্তিপাগল জনগণের আজ এই অস্ত্রধারী গৌরব-উজ্জ্বল ইতিহাসের এক নব সূচনা। এই ঐতিহাসিক বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শােষিত শ্রেণীর এক আপােষহীন শ্রেণী দ্বন্দ্ব-পরস্পর হিংসাত্মক রক্তপাত যা দ্বারা লাঞ্ছিত শােষিত জনগণ উগ্র বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে তাদের শত্রু শশাষক শ্রেণীকে সমূলে উৎখাত করে অর্জন করবে নিজেদের জাতীয় স্বাধীনতা, প্রতিষ্ঠা করবে জনগণের গণতন্ত্র, শােষণহীন সুখী সমাজ ব্যবস্থা। নিঃসন্দেহে এটা হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রাম এবং বর্তমান বিপ্লবী যুদ্ধ হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামেরই এক পর্যায়।
এই বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য পূর্ব বাংলার জনগণকে সঠিক শত্ৰুশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত আক্রমণ চালানাের উদ্দেশে, দেশি-বিদেশি সকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে সমূলে উৎখাত করে জনগণের সামগ্রিক বিজয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে প্রয়ােজন সঠিক পথে পরিচালিত একটি বিপ্লবী নেতৃত্বের। ঐতিহাসিকভাবে একমাত্র শ্রমিক শ্রেণীই কৃষক-শ্রমিকের সুদৃঢ় মৈত্রীর ভিত্তিতে এই নেতৃত্ব দিতে পারে। অবশ্যই এই নেতৃত্ব হতে হবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মাও সে তুং-এর চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে কৃষক শ্রমিক সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক। এই বিপ্লবের নেতৃত্ব সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণীর হাতে থাকলেও এর মূল শক্তি হচ্ছে পূর্ব বাংলার ভূমিহীন ক্ষেতমজুর ও গরিব কৃষক সমাজ। বুদ্ধিজীবী, কুটির শিল্পী, মাঝারি কৃষক ও বিপ্লবী নারীসমাজ এই বিপ্লবের দৃঢ় মিত্র হিসেবে কাজ করবে। পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক (যারা কোনােমতেই মুৎসুদ্দি নয়) এ ধনী কৃষক সম্প্রদায়ের ভূমিকা সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। এরা শ্রেণী হিসেবে শােষক এবং শােষিত উভয়ই। এরা কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতি জনগণকে নির্মমভাবে শশাষণ করে, আবার মুৎসুদ্দি একচেটিয়া পুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির শােষণে নিজেরাও জর্জরিত। তাদের নিজস্ব পুঁজির বিকাশে সামন্তবাদসহ এই দুই শশাষক শ্ৰেণীই হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা। সে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে তাদের একটা বড় অংশ আংশিকভাবে হলেও (জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে সক্রিয়ভাবে এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সাময়িকভাবে বা নৈতিকভাবে) বিপ্লবের সহযােগিতা করবে, কিন্তু নিজস্ব শ্রেণীস্বার্থেই চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য এরা সামগ্রিক বিপ্লবী ক্রিয়াকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে পারে না। পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত না হলেও বর্তমান পর্যায়ে তাদের এই সহযােগিতা বিপ্লবী জনগণের গ্রহণ করা উচিত এবং নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব বা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ভূমিকায় বর্তমান পর্যায়ে তাদের দোদুল্যমান মিত্র হিসেবে স্থান দেয়া উচিত। কিন্তু বিপ্লবী জনগণকে অবশ্যই তাদের প্রতি সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে তারা তাদের স্বার্থে প্রতিক্রিয়ার পুনর্জন্ম না দিতে পারে, শ্ৰেণী হিসেবে যা তারা করতে চেষ্টা চালাবে। যখনই তেমন কোনাে পথ তারা গ্রহণ করবে ঠিক তখনই তাদের বিপ্লবী জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত, তাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে। কিন্তু যে পর্যন্ত তারা পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পথে আপােসহীন লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করবে ততদিন পর্যন্ত তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার কোনাে অবকাশ নেই এবং তা করলে মারাত্মক ভুল করা হবে। পূর্ব বাংলার প্রতিটি বিপ্লবীকে মনে রাখতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে মধ্যবিত্ত সুলভ অস্থিরতা, তাড়াহুড়া, একগুয়েমি, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, অপরের বক্তব্যকে উপেক্ষা বা যান্ত্রিকভাবে অনুসরণ এবং নানা প্রকারের দোদুল্যমানতার ফলে বিপ্লবে সমূহ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। সুতরাং প্রতিটি বিপ্লবীকে কঠোর বাস্তবতার ভিত্তিতে খুব ধীর স্থিরভাবে এই সকল পরিস্থিতির মােকাবেলা করতে হবে। সে দিকে দৃষ্টি রেখে জাতীয় ধনিকরা আগামী দিনে যাতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি হিসেবে মাথাচাড়া দিয়ে না উঠতে পারে তার জন্য এখন থেকেই জনগণের রাজনৈতিক চেতনার স্তরকে উন্নত করার জন্য বিপ্লবী ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক রাজনৈতিক প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এই রাজনৈতিক সচেতন জনগণকে আরাে সক্রিয়ভাবে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করার স্বপক্ষে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আর একটি ব্যাপারে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখা এবং যথার্থ সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়ােজন। সেটি হচ্ছে কিছু সংখ্যক দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও সংস্থা, বিদেশি কিছু রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত বা জাতিগত স্বার্থে পাকিস্তানি সামরিক শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্ৰেণীগতভাবে এদের অধিকাংশই প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী, কিন্তু পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে স্বীয় স্বার্থের দ্বন্দ্বই তাদেরকে পূর্ব বাংলার জনগণের বিপ্লবী মিত্র শিবিরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি বিপ্লবের একটি স্তর পর্যন্ত তারা মিত্র হিসেবে কাজ করে যাবে এবং পরবর্তীকালে এরাই বিপ্লবের বিরােধিতা করতে পারে এবং করবে। সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে বর্তমান মুহূর্তে বিপ্লবের এই সকল দোদুল্যমান মিত্র শক্তিকে যথাসম্ভব ব্যবহার করা উচিত। প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে তীব্রতর করে, সে সুযােগকে পুরােপুরিভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে নিয়ােজিত করে সামগ্রিকভাবে জনগণের বিপ্লবকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছে দেয়া অন্যতম বিপ্লবী রণকৌশল। কিন্তু এই রণকৌশল প্রয়ােগ করতে বিপ্লবী জনগণকে অবশ্যই যথােপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে বিপ্লবের বর্তমান দোদুল্যমান মিত্ররূপী এসকল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি পরবর্তীকালে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাব বিস্তার না করতে পারে। এখন থেকেই এই সমস্যার রাজনৈতিক মােকাবিলা করার উদ্দেশে প্রয়ােজন মার্কর্সবাদ-লেনিনবাদ ও মাও সে তুংএর সঠিক চিন্তাধারায় আদর্শনিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণীর একটি বিপ্লবী পার্টি, যা কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতি জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করে সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবী যুদ্ধ পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এই উদ্দেশে প্রতিটি বিপ্লবীকে অবশ্যই ধৈর্য ও মনােযােগ সহকারে অধ্যয়নের মাধ্যমে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল শিক্ষা- ‘জনগণের সেবা করার মনােবৃত্তি গ্রহণ করতে হবে এবং বাস্তব বিপ্লবী জীবনে কঠোর আত্মত্যাগের মাধ্যমে তা প্রয়ােগ করতে হবে। মনে রাখতে হবে কমরেড স্তালিনের সতর্কবাণী- বিপ্লবী অনুশীলনের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। এই মহান আত্মত্যাগের আদর্শে সুসজ্জিত হয়ে গ্রামের কৃষক, শহরের শ্রমিক তথা পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণ এবং অন্যান্য মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদিগকে শ্রেণী সংগ্রামের বৈপ্লবিক রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করে তাদের রাজনৈতিক চেতনার স্তরকে উন্নততর করে, শােষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গণযুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল করে, তাদের উপর নির্ভরশীল ও আস্থাবান হয়েই কেবল এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। কমরেড মাও সেতুং বলেছেন, বিপ্লবী যুদ্ধ হচ্ছে জনসাধারণের যুদ্ধ, কেবলমাত্র জনসাধারণকে সমাবেশ করে এবং তাদের উপর নির্ভর করেই এ যুদ্ধকে চালিয়ে নেয়া যেতে পারে। সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধে অবশ্যই বিপ্লবীদের জনগণের উপর আস্থা রাখতে হবে, নিভরশীল হতে হবে, তাদের অফুরন্ত সৃজনী শক্তিকে দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে বিপ্লবী কর্মে নিয়ােজিত করতে হবে, এককথায় সর্বকাজে তাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শত্রুদের নির্মূল করে জনগণের বিজয়কে সুসম্পন্ন করতে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হবে। পূর্ব বাংলার বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই হচ্ছে সঠিক মার্কসবাদী লেনিনবাদী পথ। পূর্ব বাংলার জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ সুসম্পন্ন করতে, স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে সকল প্রতিক্রিয়াশীল শাসক ও শােষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শােষিত শ্রেণীর জনগণের শ্রেণীসংগ্রামকে চূড়ান্তভাবে সফল করে তুলতে কৃষক-শ্রমিক সর্বহারা মেহনতি জনগণের পার্টি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিসহ পূর্ব বাংলার সকল শ্রেণীর দেশপ্রেমিক জনগণকে এই সঠিক পথেই এগিয়ে আসতে হবে। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধ একমাত্র এই পথেই বিজয় অর্জন করবে। এছাড়া পূর্ব বাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তির দ্বিতীয় কোনাে পথ খােলা নেই।
সূত্র: দর্পণ
১৭.০৯.১৯৭১