অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের দায়িত্ব
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে ভূতের নৃত্য চলছে। এদেশের এমন কোন গ্রাম প্রায় নেই, যেখানে পাকিস্তানি হানাদারেরা আগুন লাগায়নি, চালায়নি হত্যাযজ্ঞ। তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার প্রয়াস পেয়েছিল। তারা জানতো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিতে রয়েছে গ্রাম বাংলার চাষীকুল। তাই তাদের রোষবহ্নি গ্রাম-বাংলাকেই বেশি করে পুড়িয়েছে। তারা চাষির ঘরে অগ্নিসংযোগ করেছে, ক্ষেতখামার নষ্ট করেছে, গবাদিপশু ধ্বংস করেছে, তাদের ভয়ে চাষী মাঠে নামতে পারেনি, পারেনি ফসল কেটে ঘরে আনতে। গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে যে আধুনিক চাষের যে সূচনা হয়েছিল তার ভিত্তিমূলেও তারা আঘাত করেছে। নানা জায়গায় পাওয়ার পাম্পের সংরক্ষণাগারে তারা অগ্নিসংযোগ করে পাম্প ও খুচরা যন্ত্রপাতি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পাইপগুলিও এখন আর যথাস্থানে নেই। পাকিস্তানি বাহিনী সেগুলো বিছিয়ে সেতু তৈরি করেছে। সারের বস্তা লুট করে সেগুলো দিয়ে বাঙ্কার সাজিয়েছে। সেগুলো বিছিয়ে খাল ভরাট করে তার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় সারের বড় বড় গুদামের ওপর আকাশ থেকে বোমা ফেলেছে। বোমা ফেলে ট্রাক্টর ট্রেলর ধ্বংস করেছে। কৃষিকার্য তত্ত্বাবধান ও মাল সরবরাহের জন্য যেসব যানবাহন নিয়োজিত ছিলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেগুলোও নিয়ে নেয়। তার অনেকগুলো বিনষ্ট হয়েছে, অনেকগুলোর হদিস নেই। রাস্তাঘাটও অনেক জায়গাতে নেই। এক কথায় বলা যায়, বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী গ্রাম বাংলাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ক্ষয়-ক্ষতির পুরো হিসাব পেতে সময় লাগবে। কিন্তু এটা আজ আর হিসাবের বিষয় নয় যে, বাংলার চাষির জীবন আজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। অথচ এই চাষীকূলকেই গড়ে তুলতে হবে সোনার বাংলা। বাংলাদেশের গণতন্ত্রী সরকার দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের যে সংকল্প নিয়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর মুক্তি-উত্তর প্রথম ঐতিহাসিক ভাষণেই সে কথার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “পুনর্গঠনের কাজে আপনারা আত্মনিয়োগ করুন।” তাঁর এই আহবানে সাড়া দিয়ে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, সরকারি চাকুরে অর্থাৎ সমাজের সর্বস্থরের মানুষকে পুনর্গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কৃষকদের জন্য পুনর্গঠনের অর্থ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি আমাদের দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে না তুলতে পারি তবে দেশের কোন উন্নতি সম্ভব হয়ে উঠবে না। কৃষির ত্বরিত এবং ব্যাপক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যতীত শিল্প বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়ন সম্ভব নয়। পুনর্গঠনের অর্থ শুধু এই নয় যে, আমরা আমাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্পদই পুনরায় উদ্ধার করবো, বরং সেই সঙ্গে চাষাবাদের মধ্যে আমরা সুদূরপ্রসারী সংস্কারও সাধন করবো যাতে আমাদের অর্থনীতির ভিত্তিটি হয়ে ওঠে অত্যন্ত মজবুত। বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি যে চাষাবাস তার মূল শক্তি হলেন কৃষক। এই কৃষককেই আজ অর্থনীতির পুনর্গঠনে প্রধান ভূমিকা নিতে হবে। সরকার কৃষির পুনর্গঠন ও উন্নতির জন্য যখন যে ব্যবস্থা করবেন, কৃষককে সর্বান্তকরণে তার সঙ্গে সহযোগিতা করতে হবে। এজন্য কৃষকদের সমবায়ের ভিত্তিতে সংগঠিত হওয়া আবশ্যক। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে চাষবাসের উপকরণ কৃষকদের হাতে পৌছাবার জন্য সকল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দিয়েছেন। এখন বোরো ফসলের মৌসুম। সকল অসুবিধা সত্ত্বেও চাষিকে বোরো ফসল ফলাতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সেচের। আমাদের কৃষক যথাসত্ত্বর সম্ভব সেচের কাজে পাওয়ার পাম্প লাগাবার জন্য এগিয়ে আসবেন। সরকার পাওয়ার পাম্প কিংবা গভীর নলকূপের ভাড়া এখন নিচ্ছেন না, ফসল তোলার পর চাষি তা পরিষোধ করবেন। জ্বালানির বেলায়ও সুবিধা দেয়া হচ্ছে। আগেই বলেছি, বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা সার ও সার গুদামে ক্ষতি হয়েছে। তবুও কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন যানবাহন এবং রাস্তাঘাটের অসুবিধা সত্ত্বেও যথাসত্ত্বর সম্ভব বিভিন্ন কেন্দ্রে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে। চাষিগণ রাসায়নিক সার ও গোবরসহ প্রভৃতি সার ব্যবহার করে ফসলের পরিচর্যায় নিজেদের নিয়োজিত করবেন। মনে রাখতে হবে, যত অসুবিধাই দেখা দিক, আমরা নিরস্থ হব না; দেশকে গড়ে তোলার জন্য আমরা প্রাণপণ করে কাজ করব। বাংলাদেশকে আমরা সত্য সত্যই সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করে ছাড়বো। একটা কথা বলা আবশ্যক। ঔপনিবেসিক শাসনের খোঁয়ারী হিসেবে দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে কৃষক সমাজ এবং সরকারি কর্মচারিদের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান ছিল তা দূর করা আবশ্যক। দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কারণেই সাধারণ মানুষ সরকারি কর্মচারী থেকে সাধ্যমতো দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। সরকারী কর্মচারীও যে মনোভাব নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে মিশেছেন তাতে প্রভুত্বের ভাবটা এমন বিকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে তাতে আর যাই হোক, সরকারের বা সরকারি কর্মচারীর ওপর আর কারো আস্থা রাখা সম্ভব ছিলো না। এই মনোভাবটি অবিলম্বে ত্যাগ করতে হবে। আমাদের সরকারি কর্মচারীরা এ দেশেরই অধিবাসী, এদেশের জনসাধারণের সেবার জন্যই তাঁদের নিযুক্ত করা হয়েছে। কাজেই ধমক দিয়ে কাজ নেওয়া বা হুকুম দিয়ে কর্তব্য সম্পাদনের চেষ্টা এখন ব্যর্থ হবে। জনসাধারণের সাথে এক হয়ে মিশে যেয়ে তাদের আস্থা ও নেতৃত্ব অর্জন করতে হবে। যদি কোন অভাব বা অসুবিধা দেখা দেয়, তবে সেটি লুকিয়ে রেখে লাভ রেখে নেই। জনসাধারণকে বুঝিয়ে বললে তারা বুঝবেন। তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে অসুবিধা বা সমস্যা সমাধানের পন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সরকারি চাকুরি পেলেই কেউ সবজান্তা হয় না- এটা সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক।৪৩
Reference:
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
ইত্তেফাক, ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২
Unicoded by Tushar Mondal