বাংলাদেশের উপর রাহুর দৃষ্টি
(গত সংখ্যার পর)
মার্কর্ম ধর্মাবলম্বীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম ও প্রধান হইল বিশ্বাসঘাতকতা। বােল পাল্টাইতে ইহাদের নীতি আদর্শে কোনাে বাধা নাই। ইহারা জাতীয়তাবাদের পরম শত্রু। জাতীয় আন্দোলনে এরা অংশগ্রহণ করে জাতীয়তাবাদকে সমূলে ধ্বংস করিবার নিমিত্ত। কোনাে কিছুকে বাহির হইতে প্রকাশ্য শত্রুতার দ্বারা ধ্বংস করা কঠিন কাজ বলিয়া উহারা কৌশল হিসাবে উহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া, অংশীদার অথবা মিত্রতার ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করিয়া সময় এবং সুযােগ বুঝিয়া পৃষ্ঠ রক্ষার নামে পেছন হইতে ছুরি মারিয়া হত্যালীলা সাধন করে। বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বন্যা দেখা দিলে এই মাকর্মপন্থীরা ঐ বন্যার সঙ্গে নিজেদের প্রথমে যুক্ত করিতে পারে নাই। শতকরা তাে দূরের কথা, নির্বাচনে একটি আসনও তাহারা পায় নাই। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের মারফতে সমগ্র বিশ্বকে অবাক ও হতবাক করিয়া দিয়াছে। জাতীয়তাবাদের এতাদৃশ জয় ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। বাংলাদেশে অপাংক্তেয় তথ্য অভিজ্ঞান মার্কসীয়রা ছলায়-কলায় অতি পটু বলিয়া জাতীয়বাদের প্রবল বন্যায় প্রাণে মরে নাই এবং শরণার্থী হইয়া বাংলাদেশের বাহিরে অর্থাৎ ভারতে আসিয়া আবার ছলা-কলার দৌলতে মেরুদণ্ড সােজা করিয়া দাঁড়াইবার অপচেষ্টার সুযােগ পাইয়াছে। আজ তাহারা বুঝিতে পারিয়াছে এই জাতীয়বাদের জয় সুনিশ্চিত; বাংলাদেশের জাতীয় সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ অপ্রতিরােধ্য। বাংলাদেশে মার্কসীয় পন্থায় মার্কসপন্থীদের টিকিয়া থাকিবার কোনাে সম্ভাবনা নাই। অতএব জাতীয়তার আলখাল্লা পরিয়া জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে অনুপ্রবেশের কলাকৌশল তথা মারপ্যচ শুরু হইয়াছে। কী সুন্দর, কী মধুর, কী দেশপ্রেমের বুলি? ‘আমরাও সংগ্রাম করিব, আমাদের সামিল কর, আমরা মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক’। সত্যের প্রতি আগ্রহের (সত্যাগ্রহের) যেন অন্ত নাই। কিন্তু এই আগ্রহ যে কত কপট, উহা তলাইয়া দেখে কয়জনে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস কী বলে? বিশ্বাসঘাতক কমুনিস্টরাই তা ৪২-এর কুইট ইন্ডিয়া’ তথা ভারত ছাড়’ আন্দোলনকে পেছন হইতে ডেগার মারিয়া ঘায়েল করিয়াছিল। ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগির প্রশ্নে মুসলিম লীগের দোসর ছিল কে? এই মার্কস ধর্মাবলম্বীরা। ভারতের জাতীয় আন্দোলনে এরা অংশীদার ছিল বলিয়া জনযুদ্ধের স্লোগান দিয়া সাম্রাজ্যবাদের দালালিতে সফলকাম হইয়াছিল-স্বাধীনতা আন্দোলনকে গলা টিপিয়া হত্যা করিবার সুযােগ-সুবিধা ঘটাইয়াছিল। আজ তাহারা ঐ একই উদ্দেশে মুক্তিযুদ্ধের সামিল হইতে চায়। শঠং মিত্রং’- কথাটা বড় মূল্যবান, অন্তত রাজনীতির ক্ষেত্রে। শঠতায় ইয়াহিয়া আর মার্কসীয়দের মধ্যে কোনাে তফাত নাই। তফাত কেবল আবরণ আর আচরণের। মনােগতভাব উভয়েরই সঙ্গী, গণতন্ত্রের এক নম্বরের শত্রু, জাতীয়তাবাদের যম। ইয়াহিয়ার শঠতা সহজে ধরা পড়ে, ক্যুদের শঠতা সুগার কোটেড কুইনাইনের মতাে সমাজবাদের বুলিতে প্রলিপ্ত। আগুনকে ছাইচাপা দেওয়া বড় কঠিন কাজ, শঠতা ঢাকিয়া রাখা ততােধিক কঠিন বলিয়াই তাে বাংলাদেশের শরণার্থী মার্কস পন্থীরা বোস বলিয়া ফেলিয়াছে মুক্তিযুদ্ধ মেহনতি জনতার যুদ্ধ নহে।’ অর্থাৎ তাহারা যতক্ষণ না এই যুদ্ধের সামিল হইতেছে ততক্ষণ উহা প্রকৃত মুক্তি সংগ্রাম বলে গণ্য হইতে পারে না। যাহার অর্থ আওয়ামী লীগ একটা বুর্জোয়া সংগঠন বা সাম্রাজ্যবাদের দালাল সংগঠন।
শুধু ভারত বা বাংলাদেশে নহে এশিয়ার সর্বত্র এই দল দুষ্টুগ্রহ রাহুর ন্যায় অবস্থান করিতেছে। যে কোনাে অছিলায় অথবা রাজপথে যত্রতত্র অনুপ্রবেশের প্রভাব বিস্তারের সামান্যতম সুযােগ-সুবিধার ব্যবহার করিতে সে এতটুকু কার্পণ্য করে না। এই দুই রাহু সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত করিয়াছে। তাহারা শাসন ক্ষমতায়, স্বাধীনতা অর্জনে ও রক্ষণে আওয়ামী লীগকেই পাইতে চায় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃতুই বাংলাদেশের জনতার সর্ববাদী সম্মত নেতা। মুক্তিযুদ্ধে সৈনিক বা যােদ্ধা হিসেবে তােক নিয়ােগ করিবে বাংলাদেশ সরকার। ইহা সরকারের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। কাহাকে নিয়ােগ করা হইবে বা করা উচিত, সরকার উহা বিবেচনা করিবে। সেই বিবেচনার সময় আমাদের মনে হয় যতক্ষণ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সমর্থকের একান্ত অভাব না ঘটে ততােক্ষণ পর্যন্ত অন্য সকল রাজনৈতিক দলের বিনীত প্রার্থনাও ‘দুঃখিত মন্তব্যের ফাইলে বাংলাদেশ সরকারের বাতিল দপ্তরে প্রেরিত হইয়া উচিত।
সূত্র: ত্রিপুরা
৪ আগস্ট, ১৯৭১
১৯ শ্রাবণ, ১৩৭৮