মননশীলতা
কাজের চাপই কর্মক্ষমতার মাপকাঠি। কাজের চাপ না পড়া পর্যন্ত কাহারও কর্মক্ষমতা সম্পর্কে নির্ভুল তথ্য সংগ্রহ করা যায় না। কী ব্যক্তি, কী সংগঠন, কী বস্তু সবকিছুরই কর্মক্ষমতা কাজ দ্বারা যাচাই করা যায়। বাংলাদেশ হইতে শরণার্থী আগমনের ফলে ত্রিপুরা তথা সমস্ত ভারতের উপর চাপ পড়িয়াছে। এই চাপের কথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী হইতে আরম্ভ করিয়া দেশের গণ্য নগণ্য জনসাধারণ পর্যন্ত সকলেই কমবেশি বলিয়া থাকেন; চাপের ভার সকলকেই কিছু না কিছু বহন করিতে হইতেছে। কেহ প্রত্যক্ষভাবে কেহ বা পরােক্ষভাবে এই চাপের অংশীদার হইয়াছেন। রাজ্য হিসেবে চাপের মাত্রাটা পশ্চিমবঙ্গে আর ত্রিপুরাতেই অধিক। তুলনামূলকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায় ত্রিপুরার উপর চাপ সর্বাধিক এবং অস্বাভাবিক। সবদিক দিয়া উন্নত ও সমৃদ্ধ চারকোটি অধিবাসীর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী প্রবেশ করিয়াছে; অনুন্নত, অনগ্রসর ও দরিদ্র পনের ষােল লক্ষ লােকের বাসস্থান ক্ষুদ্র ত্রিপুরায় আসিয়াছে প্রায় দশ লক্ষ শরণার্থী। অর্থাৎ মােট লােক সংখ্যায় এক অষ্টমাংশ শরণার্থী গিয়াছে পশ্চিমবঙ্গে আর ত্রিপুরায় আসিয়াছে তাহার মােট লােক সংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ। এক অষ্টমাংশের চাপে পশ্চিমবঙ্গ যদি ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়িতে বাধ্য হয়; তবে দুই তৃতীয়াংশের চাপে ত্রিপুরার কী হওয়া স্বাভাবিক? প্রাণান্ত হওয়া, হার্টফেল করা, অথবা ভাঙিয়া পড়াই স্বাভাবিক। এইখানেই দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ত্রিপুরা স্বাভাবিকের উর্ধ্বে-অস্বাভাবিক। ত্রিপুরায় সব কিছুই অস্বাভাবিক। শরণার্থীর চাপে ত্রিপুরা ভাঙিয়া পড়ে নাই, এমনকি আর্তনাদও করিতেছে না। বাংলাদেশের মানুষ যে মনােবল লইয়া দেশ ছাড়িয়াছে, ত্রিপুরাবাসী। মনােবৃত্তিতেই তাহাদিগকে আপ্যায়ণের চেষ্টা করিতেছে। পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ত্রিপুরার সম্বল ও সঙ্গতি অতি নগণ্য। ত্রিপুরার একমাত্র অবলম্বন কেন্দ্রীয় সরকার। স্বাভাবিক অবস্থায় এই অবলম্বন ঢিমে তেতালা গতিতে ত্রিপুরাকে বাঁচিয়া থাকিবার ব্যবস্থাপনা নেহাৎ কম করে না। কিন্তু জরুরি বা অস্বাভাবিক অবস্থায় এই অবলম্বন যে ত্রিপুরাকে নাকানি-চুবানি খাওয়াইতে ওস্তাদ-উহার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এবং ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে চীন ও পাকিস্তানের ভারত আক্রমণের সময় এবং আজ আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাইতেছে ত্রিপুরার অবলম্বন কেন্দ্রীয় সরকার কতদূরে- দিল্লী অনেক দূর।
শরণার্থী আসিতেছে আজ তিন মাস যাবত। আগমনের সূচনাতেই একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসাম হইতে কেন্দ্রের নিকট ত্রাণ সামগ্রীর (বিশেষ করিয়া ওষুধ ও পথ্যের) চাহিদা পেশ করা হইয়াছিল। যথাসময়ে ত্রাণ সামগ্রী কোথাও আসে নাই। পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম যেহেতু সম্বল ও সঙ্গতি সম্পন্ন সেইহেতু ত্রাণসামগ্রী শরণার্থী আসার সঙ্গে সঙ্গে না আসিলেও অন্তত দুই তিন মাস নিজেদের সম্বল দিয়াই চলার কথা। অসুবিধা হইল ত্রিপুরার। ত্রিপুরার সম্বল সঙ্গতি নিতান্তই সামান্য। সামান্যের উপর অসামান্যের চাপ কোথাও কোনাে দিন স্বাভাবিকতা বজায় রাখিতে পারে কি? কার্যত দেখা যায় অনুকূল এবং তুলনামূলক সমৃদ্ধ পরিবেশ ও পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা ত্রিপুরা প্রতিকূল পরিবেশ এবং দারিদ্রের মধ্যে থাকিয়াও শরণার্থী আপ্যায়ণে অধিক কর্মক্ষমতার নজির স্থাপন করিতে সক্ষম হইয়াছে।
তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গ আর ত্রিপুরার মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গ উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিক দিয়া সমগ্র ভারতে প্রথম শ্রেণীর রাজ্য, আর ত্রিপুরা রাজ্য হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসে এখনও কোনাে স্থান পাইবার যােগ্যতা অর্জন করিতে পারে নাই। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষায়দীক্ষায় অগ্রগতির পুরােধা, ত্রিপুরা এখনও হাঁটি হাঁটি পা পা করিতেছে। শরণার্থীর সংখ্যা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ত্রিপুরায় অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি আট জনের মধ্যে একজন শরণার্থী, আর ত্রিপুরার প্রতি তিন জনের ঘাড়ে ভর করিয়াছে দুইজন শরণার্থী। ত্রিপুরার ওষুধ, পথ্য ও খাদ্যভাণ্ডার মাত্র ষােল লক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পশ্চিমবঙ্গের ভাণ্ডার ত্রিপুরার প্রায় পঁচিশ গুণ। শরণার্থীর চাপে ত্রিপুরার হাটবাজারে অতি উষ্ণ প্রবাহ বহিতেছে; পশ্চিমবঙ্গে হাটবাজারে কোনাে বিশেষ ব্যতিক্রম দেখা দেয় নাই। এক কথায় শরণার্থী সমস্যায় প্রতিটি ত্রিপুরাবাসী যতটা অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন হইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গে উহার এক দশমাংশও হয় নাই। সবচাইতে বড় কথা হইল কণামাত্র ত্রুটি-বিচ্যুতিতে পশ্চিমবঙ্গ দিল্লীর মসনদকে কাপাইয়া তােলে, আর ত্রিপুরার বেলায় দেখা যায় অবজ্ঞা উপেক্ষার বাড়াবাড়ি। ত্রাণসামগ্রী পশ্চিমবঙ্গে না পৌছিলে অন্তত দুই তিন মাস চলিতে পারে, চলা উচিত; কিন্তু ত্রিপুরার বেলায় ঐ নজির চলে না, কারণ ত্রিপুরার মজুতের পরিমাণ মােল লক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কার্যত দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীরা যথাযথ আপ্যায়িত হয় নাই, বেঘােরে কয়েক সহস্র মারা গিয়াছে এবং মৃত দেহগুলাে সকারের অভাবে কুকুর, শৃগাল ও শকুনের ক্ষুধা মিটাইয়াছে। ত্রিপুরায় কিন্তু এই দৃশ্যের অবতারণা হয় নাই। এখানে কলেরা বা পেটের রােগের আবির্ভাব যে ঘটে নাই তাহা নহে। ছাউনির অভাবে এখানেও সহস্র সহস্র লােক উন্মুক্ত আকাশ তলে বা গাছতলায় দিন কাটাইয়াছে এবং কাটাইতেছেও। খাদ্য, পথ্য, পানীয় পর্যাপ্ত নাই, ওষুধ তাে দূরের কথা। পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসকের অভাব নাই। ওষুধও অপ্রাপ্য নহে। ত্রিপুরায় নাই তাে নাই কিছুই নাই। এখন পর্যন্ত শিবিরগুলােতে ওষুধ বা চিকিৎসক দেওয়া সম্ভব হয় নাই। ভ্রাম্যামাণ হাসপাতালের কথা শােনা মাত্রই সার, এখন পর্যন্ত চোখে পড়ে নাই। প্রতিটি শিবিরেই অসুখ-বিসুখ আছে এবং মৃতের সংখ্যাও কমবেশি বিদ্যমান। তবে তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা অনেক কম। ওষুধ, পথ্য, পানীয়, প্রতিষেধক এবং চিকিৎসক যদি পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় ত্রিপুরাতে পাওয়ার উপায় থাকিত, তবে ত্রিপুরার শরণার্থী শিবিরসমূহ মৃতের হার অতি নগণ্যই হইত। পশ্চিমবঙ্গের সুযােগ-সুবিধার অভাব নাই। পূর্ণাঙ্গ রাজ্য সরকার ক্ষমতার দিক দিয়া স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজেদের ইচ্ছা এবং প্রয়ােজন মতাে আয়ােজন করিয়া শরণার্থী সমস্যার সমাধানের পথ তথা উপায় উদ্ভাবন ও অবলম্বন করিতে পারে। প্রশাসনের সর্বস্তরে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও পারদর্শী বঙ্গ সন্ত নিগণ রহিয়াছেন। সরকারি ও প্রশাসন যন্ত্রের বাহিরেও প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞের অভাব নাই। যে কোনাে ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ যথাযােগ্য ব্যবস্থা অবলম্বনের যােগ্যতা ও ক্ষমতার অধিকারী। সেই তুলনায় ত্রিপুরা সরকার সর্ব বিষয়ে সর্বদার তরে পরমুখাপেক্ষী। কেন্দ্র শাসিত ত্রিপুরার কেন্দ্রের অনুমতি ছাড়া মশামাছি তাড়াইবারও ক্ষমতা নাই। প্রশাসন যন্ত্রটা পর্যন্ত টেরিটরি সরকারের ধার ধারে না। গােটা প্রশাসনিক কাঠমাের উচ্চতম গুরুদায়িত্ব পূর্ণ পদগুলােতে কেন্দ্রের মনােনীত টাইম সার্ভারের বাড়াবাড়ি। ত্রিপুরার মাটির সহিত তাহাদের কোনাে সম্পর্ক নাই বলিয়া স্থানীয় সমস্যা যথাযথ অনুধাবনই করিতে পারে না; সমাধানের প্রয়ােজন-অপ্রয়ােজনও হয় তদনুরূপই। যােগ্যতার দিক দিয়া প্রায় প্রত্যেকেই আন্ধাবােট সদৃশ। আন্ধাবােট না হইলে কি মন্ত্রিপরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত পর্যন্ত ফাইল চাপা পড়ে! এই একটি মাত্র কারণেই ত্রিপুরার অভাব-অভিযােগ ও ন্যায়সঙ্গত চাহিদা যথাসময়ে যথাযথভাবে দিল্লীর দরবারে পেশ হয় না। রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্ব ন্যস্ত আছে উপ-রাজ্যপালের উপর। তিনিও হাতিয়ার গুণে সিপাই; পদস্থ আমলাবর্গের উপরেই নির্ভরশীল। অতএব ত্রিপুরার জনপ্রতিনিধিমূলক সরকারের দায়-দায়িত্বের তুলনায় অধিকার নাই বলিলেও চলে। তবেই দেখা যায় ত্রিপুরাকে সব কিছুতেই বিলম্বিত ও বিড়ম্বিত পথে অগ্রসর হইতে হয়। বিড়ম্বিত ও বিলম্বিত পন্থা অবলম্বন ব্যতিরেকে যদি ত্রিপুরা রাজ্য চলিতে পারিত, তবে আজ আমরা গর্ব করিয়াই বলিতে পারিতাম সমগ্র ভারতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর মানবতাবােধকে একমাত্র ত্রিপুরাই সার্থক রূপ দিতে তথা কার্যকরী করিতে সক্ষম হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সভ্যতার পীঠস্থান কলিকাতা মহানগরীতে শরণার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। শরণার্থীরা কি অচ্ছুৎ? ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা শহর শুধু উক্তই নহে, অভ্যর্থনা জানাইয়া শহরের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত শরণার্থীদের ঠাই দিতেছে।
পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় ত্রিপুরাতেও আশ্রয় শিবিরের অভাব। শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগ শরণার্থী শিবিরে স্থানাভাব হেতু মানবতার সম্বন্ধ সূত্রে ত্রিপুরার ঘরে ঘরে আশ্রয় পাইয়াছে এবং একমাত্র এই কারণেই কলেরা মহামারিতে (ওষুধ, চিকিৎসক, পানীয়ের একান্ত অভাব থাকা সত্ত্বেও) মৃতের সংখ্যা উন্নত ও সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা কম।
অনুমান করিতে বােধ হয় বাধা নাই যে, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আর ত্রিপুরার মানুষের মানসিক প্রস্তুতির মধ্যে যথেষ্ট তারতম্য রহিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীরা অবাঞ্ছিতের অভ্যর্থনা পাইতেছে, আর ত্রিপুরায় পাইতেছে অতিথি অভ্যাগতের আপ্যায়ণ। পশ্চিমবঙ্গ দীনতাকে অতিক্রম করিতে যাইয়া রাজনৈতিক আবর্তে হীনতাকে সম্বল করিয়াছে আর দৈন্যের মধ্যেও হীনতাকে জয় করিয়া ত্রিপুরার অবলম্বন হইয়াছে মননশীলতা।
সূত্র: ত্রিপুরা
২৩ জুন, ১৯৭১