বাংলাদেশের উপর রাহুর দৃষ্টি
পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কস ধর্মাবলম্বীদের মনােগত ভাবটা আস্তে আস্তে ফুটিয়া উঠিতেছে। খ্রিস্টান জগতের ন্যায় বর্তমান বিশ্বে মার্কসীয় জগৎ নামে আর একটা জগৎ গজাইয়াছে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা যেমন দুইভাগে বিভক্ত, মার্কস পন্থীরাও তেমনি দুই ভাগে (রুশ ও চীন) বিভক্ত। ভারতে অবশ্য বর্তমানে তিনটি মার্কসীয় দল হইয়াছে। ধর্মান্ধতায় কিন্তু সকলেই এক ও অভিন্ন। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তাহাদের নীতি এক ও অভিন্ন। মােদ্দা কথা হইল বাংলাদেশ স্বাধীন, স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আজ হউক কাল হউক প্রতিষ্ঠিত যে হইবে সে সম্পর্কে মার্কসীয়রা সকলেই একমত এবং এরা সকলেই বাংলাদেশের মসনদে বসিবার খােয়াব দেখিতেছে। মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হইয়াছে। পত্রিকাটির গায়ে গতরে ডান ক্যুনিস্ট পার্টির মুখপাত্র বলিয়া পরিচয় লিপি আছে। বাংলাদেশের কোনও স্থান হইতে ঐ দেশের ডান কম্যুনিস্টদের দ্বারা উহা মুদ্রিত ও প্রকাশিত। বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) ডান, বাম, উগ্রবাম প্রভৃতি কোনাে পার্টিরই প্রকাশ্য অস্তিত্ব ছিল না। গুপ্তভাবে তাহারা তথায় মহান সংগঠন গড়িয়া তুলিয়াছে বলিয়া হালে দাবি জানাইয়াছে সি.পি.আই। মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকায় বলা হইয়াছে বাংলাদেশে মুজিবর রহমানের কোনাে সংগঠন নাই, পূর্বেও ছিল না, সংগঠন, শক্ত সংগঠন একমাত্র তাহাদেরই। একটি নহে, বেশ কয়েকটি দল গজাইয়াছে, যাহারা বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতায় ভাগ বসাইবার নিমিত্ত আওয়ামী লীগকে হেয় প্রতিপন্ন করিতে উঠিয়া-পড়িয়া লাগিয়াছে। প্রকারান্তরে যে তাহারা মুক্তিযুদ্ধকে বিড়ম্বিত ও বিলম্বিত করিতে সচেষ্ট ও তৎপর উহার প্রমাণ পাওয়া যায় বাম ক্যুনিস্টদের দাবি-দাওয়ার মধ্যে। তাহাদের দাবি হইল (১) ভারতের উচিত কালবিলম্ব না করিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া, (২) পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে বাংলাদেশ হইতে বিতাড়নের নিমিত্ত ভারতের পাকিস্তান আক্রমণ করা কখনই উচিত নহে (৩) বরং মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রাদি দিয়া সর্বরকম সাহায্য দান করাই ভারতের উচিত। অস্ত্রশস্ত্রাদি দানের ব্যাপারে একমাত্র মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগকে অধিকার না দিয়া সমস্ত দলের (হালে গজাইয়া ওঠা) মুক্তি সংগ্রামীদের সমান অধিকার দিতে হইবে। মার্কস ধর্মাবলম্বী সকল দলগুলােও এই মতের তথা দাবি-দাওয়ার সমর্থক। অর্থাৎ পূর্ব বাংলা হইতে আগত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও হাফ গৃহস্থ হাফ রাজনৈতিক সুযােগ সন্ধানী ও সুবিধাবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে আসিয়া প্রাক্তন যােগসূত্রের সম্পর্ক টানিয়া বিভিন্ন দলে ভিড়িয়া পড়িয়াছে। অতএব সহজেই পশ্চিমবঙ্গের অনুকরণে বাংলাদেশের তথাকথিত রাজনৈতিক ধুরন্ধরগণ আট নয়টি বামমার্গী রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব ঘােষণা করিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বামাচারীরা যেমন শাসন ক্ষমতা দখলের নিমিত্ত বামপন্থী যুক্তফ্রন্ট গঠন করে তাহারাও তেমনি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়া গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করিয়া ফেলিয়াছেন। এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ অতি সামান্য। পশ্চিমবঙ্গের বামাচারীরা যুক্তফ্রন্ট করিয়াছে স্বগৃহে বসিয়া; নির্বাচনে জয়লাভ করিয়া শাসনক্ষমতা দখল করাই তাহাদের মূল লক্ষ্য। আর বাংলাদেশের বামমার্গীরা গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট করিয়াছে স্থানচ্যুত হইয়া; তাহাদের লক্ষ্য ঘােলা জলে মাছ শিকার। অর্থাৎ কিনা আওয়ামী লীগের বাংলাদেশকে তাহারা পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় চৌদ্দ দলের ভাগাভাগির রাজ্যে পরিণত করিয়া খুনাখুনির মাধ্যমে সন্ত্রাস কায়েম করিতে চায়। ইহাদের মূল নেতৃত্বের গােড়াঘর কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ।
বাংলাদেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র হইতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করিয়া কাগজে-পত্রে সংগ্রাম চালাইতেছেন। লভ্যাংশে ভাগ বসাইতে প্রত্যেকেই কাগজের বাঘ। এইখানেই ইহাদের চারিত্রিক তথা দলীয় বা ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যের শেষ নহে।
(আগামী সংখ্যায় দ্রষ্টব্য)
সূত্র: ত্রিপুরা
২৮ জুলাই, ১৯৭১