You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.22 | সম্পাদকীয়: রাষ্ট্রনীতি: দূরদর্শিতা | ত্রিপুরা - সংগ্রামের নোটবুক

রাষ্ট্রনীতি: দূরদর্শিতা

বাংলাদেশ মুক্ত। পাকিস্তান লুপ্ত। পূর্বখণ্ডে পাকিস্তানের বিলুপ্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বাংলাদেশ। এশিয়া তথা পৃথিবীর মানচিত্র হইতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির একটি বৃহদাংশ একেবারে মুছিয়া গেল। অবশিষ্টাংশ, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানও মৃত্যুশয্যায়। নিক্সন আমেরিকা ও মাও চীন অবিরাম অক্সিজেন প্রয়ােগ করিয়া উহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতেছে। বাঁচা অসম্ভব। যাবতীয় মৃত্যু লক্ষণ এবং উপসর্গ অতি উৎকটভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে, করিতেছে এবং আরও করিবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে প্রথমে সমর্থন, দ্বিতীয়ে স্বীকৃতি এবং সর্বশেষ পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সহযােগিতা দান করিতে যাইয়া পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির সর্বগাত্রে, শিরায়-উপশিরায় এবং শেষ পর্যন্ত মগজাভ্যন্তরে গণতন্ত্র নামক সর্বব্যাধি নাশক, সমাজতন্ত্র নামক পুষ্টিকারক এবং ধর্মনিরপেক্ষ নামক মৃত্যুঞ্জয়ী শাস্তি বিধায়ক তথা অতি আধুনিক মারণাস্ত্র অপেক্ষাও অধিক শক্তিশালী ও অমােঘ কার্যকরী রাজনৈতিক দাওয়াইগুলাে স্মৃতি বিচক্ষণ চিকিৎসকের ন্যায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে প্রয়ােগ করিয়াছেন। এই বিচক্ষণতা এবং সুক্ষ্ম প্রয়ােগ পদ্ধতি স্ফীতােদর নিক্সন এবং গোয়ার গােবিন্দ লাল চীন অনুধাবন করিতে পারে নাই। তাহারা উভয়েই শ্রীমতী গান্ধীকে তথা ভারতকে আন্ডার ইস্টিমেট করিয়াছিল; এখন তাহারা আহাম্মকির জন্য আক্ষেপ আপসােসও করিতে পারিতেছে না। ইহাদের বর্তমান অবস্থা ঠিক চোরের রমণীর (পত্নীর) মতাে। চোর ধরা পড়িলে মার খায়, জেলে যায়, বিচারে শাস্তি হয়, সেই জন্য ‘চোরের রমণী চোরের লাগিয়া ফুকারি কাঁদিতে পারে। কাঁদিতে না পারিয়া সে কিন্তু সৎ হইতে পারে না। অবরুদ্ধ ক্রন্দনের ফলই হইল ‘চোরের মায়ের বড় গলা। পশ্চিম পাকিস্তানের শাহান শা বাদশা জনাব ভুট্টো পাকিস্তানের অন্তিম দশা সম্পর্কে নিক্সন সাহেবের সঙ্গে বােঝাপড়া করিতে গিয়াছিলেন। নিক্সন সাহেব জনাব ভুট্টোর গণ্ডপৃষ্ঠস্থ চড় লাথির উপর হাত বুলাইয়া, ধুলাবালি ঝাড়িয়া দিয়া বলিলেন, ‘ভাগিনা, ঘাবড়াও মৎ। জবরদস্ত হাতিয়ার লে লও, রুপেয় লেও- ফির লড়নে কি লিয়ে তৈয়ার হাে যাও! বদলা লেনে কি লিয়ে, দুশমন কো খতম করনে চাহিয়ে’। জনাব ভুট্টো বেশি কিছু বলেন নাই। মামুর পদ চুম্বন করিয়া বিদায় ভাষণ দিলেন- “আমরা মারাত্মক ঘায়েল হইয়াছি, এখন রেহাই দিন। অতঃপর জনাব মাও সে তুং এবং চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার জন্য চীনেও যাইবেন। তালাতাে মামুদেরও তিনি সাফ জবাব দিতে চান। কারণ তাহারাও আমেরিকার ন্যায় সৈন্য দিয়া সাহায্য করিতে অক্ষমতা জানাইয়াছেন। ভুট্টো সাহেব আশা করিয়াছিলেন মামুরা সৈন্যসহ সমরােপাকরণ ও অর্থ দিয়া ভারত ধ্বংস করিয়া তাহাকে দিল্লীর মসনদে বসাইবেন। তিনি খােয়াব দেখিয়াছিলেন, যে বিশ্বশক্তি জোট পাকিস্তান পয়দা করিয়াছে, সেই বিশ্বশক্তি জোট (বৃটেন, ফ্রান্স ও আমেরিকা) নিজেদের গরজেই (স্রষ্টা তাহার সৃষ্টিকে রক্ষা করিতে বাধ্য) পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করিয়া ভারত জয় না করুক, অন্তত বাংলাদেশ সৃষ্টির সমস্ত সম্ভাবনাকে সমূলে বিনাশ করিবে। বৃটেন ও ফ্রান্স জনাব ভুট্টোর বিচারে বিশ্বাসঘাতক অপদার্থ ক্লীবের ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছে এবং চীন ও আমেরিকা করিয়াছে খেলা। সেই খেলায়, পাক সামরিক শক্তি পরাজিত ও অপদস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীন আমেরিকাকেও ললাটে কলঙ্ক তিলক পরিধান করিতে হইয়াছে। তাই চোরের মায়ের ন্যায় একজন বলিতেছে এখনই বাংলাদেশের অভ্যন্তর হইতে ভারতীয় সৈন্য অপসারণের কথা, অন্যজন বলিতেছে ঢাকার পতন ভারতের জয়ের স্বাক্ষর নহে, বরং গভীর সঙ্কট ও ভারতের পরাজয়েরই সূচনা। প্রথম ব্যক্তি (আমেরিকা) বড় গলায় ইহাও বলিতেছে যে, যুদ্ধ বিরতির কৃতিত্ব নিক্সন সাহেবের। মার্কিন সরকারের দৌলতেই পাকিস্তানের বাকি অংশটুকু রক্ষা পাইয়াছে। তাহা না হইলে উহাও যাইত। বাংলাদেশ মুক্তির পর পশ্চিম পাকিস্তানকে খতম করিবার পরিকল্পনা ভারতের ছিল বলিয়া মার্কিন সরকার প্রচার করিতেছে; বিশেষ করিয়া ভুট্টো মিঞাকে বুঝাইতে চেষ্টার অবধি রাখে নাই। দ্বিতীয় জনও (চীনও) ছােটখাটো পেপার টাইগার (কাগুজে বাঘ) নহে; একেবারে সুন্দরবনের ডােরা কাটা বাঘের ন্যায় পাকিস্তানকে অভয় দিতে যাইয়া বলিয়াছে, চিন্তার কোননা কারণ নাই; তামাম দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ (ভারতকে গিলিয়া খাইবার জন্য) তাহাদের সাথে আছে।
আমেরিকা এবং চীন ঠিকই বলিয়াছে। মানবিকতা বর্জিত সামরিক শক্তিতে শক্তিমান এবং একান্ত নির্ভরশীল এই রাষ্ট্র দুইটি রাষ্ট্রনীতি। আদর্শের প্রশ্নে অন্য কোনাে রাষ্ট্রকে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত বলিয়া ভাবিতেই পারে না। ইহাদের মগজের দৌড় আত্মবৎ মন্যতে পরম— অর্থাৎ সকল মানুষের মধ্যেই ইহারা নিজেদের প্রতিচ্ছবিই দেখিতে পায়। অতএব বাংলাদেশকে মুক্ত করার ব্যাপারটা উহাদের বিচারে ভারতীয় বাহিনীর পূর্ব পাকিস্তান জয় বলিয়া বিবেচিত হইবে। ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছুই নাই। তাহারা যদি খােয়াব দেখে যে, ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পর পশ্চিম পাকিস্তান খতম করিবে- তাহাতে বাধা দিয়েও কোনাে লাভ হইবে না। কিন্তু তাহারা যখন বলে, চাপ দিয়া ভারতকে যুদ্ধ হইতে বিরত করা হইয়াছে, এখনই বাংলাদেশ হইতে ভারতীয় সৈন্য অপসারণ করিতে হইবে- তখন নিশ্চয়ই আমাদের বক্তব্য আছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পূর্বাপর সর্বদাই বলিয়া আসিতেছেন, চাপের নিকট কখনই কোনাে অবস্থাতেই নতি স্বীকার করিব না। আদর্শের জন্য যদি মৃত্যু হয় সেও ভালাে। নতি স্বীকার করা অপেক্ষা মৃত্যুই শ্রেয়। সৈন্য অপসারণ কাহারাে নির্দেশের অপেক্ষা রাখে না। ভারত আমেরিকার ন্যায় ভিয়েতনাম জয় করিবার জন্য বাংলাদেশে সৈন্য পাঠায় নাই, পাঠাইয়াছে বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করিতে। জয় করা আর মুক্ত করার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তাহা অনুধাবন করা চোরের মায়ের পক্ষে অসম্ভব। যুদ্ধবিরতি! ভারত যুদ্ধ ঘােষণা করে নাই বিরতির দায়িত্বটা তাঁহার পক্ষে নেহাতই অনুকম্পা। প্রতিরক্ষার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে যাইয়া যখন সে বুঝিতে পারিয়াছে পাকিস্তানের বিষ দাঁত ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, মরণ আসন্ন- তখন খেমা দিয়াছে। আরও পরিষ্কার করিয়া বলা যায় যে, উহা বিচ্ছিন্ন হইলে দেহি যেমন প্রাণে বাঁচিতে পারে না। সেইরূপ পূর্ব পাকিস্তান বিলুপ্তির দ্বারাই পশ্চিমের হৃদস্পন্দন আপনা হইতেই বন্ধ হইতে বাধ্য। অতএব পাকিস্তান খতম করার বদনামের বােঝা বহনের দায় এড়াইবার জন্যই ভারত যুদ্ধ বিরতি ঘােষণা করিয়াছে। ভারতীয় রাষ্ট্রনীতির দূরদর্শিতা ইহা। পাকিস্তান টিকিবে না, টিকিতে পারে না। ইহা জাতীয়তার প্রশ্ন। যে জাতীয়তার প্রশ্নে বাংলাদেশ সৃষ্টি হইয়াছে সেই জাতীয়তাই সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও পাকতুনিস্থান সৃষ্টি করিয়া পাকিস্তান খতম করিবে।

সূত্র: ত্রিপুরা
২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
৬ পৌষ, ১৩৭৮