জাতির গৌরব
ভারতের সেনাবাহিনী জাতির গৌরব, দেশের অমূল্য সম্পদ। তাহাদের শৌর্য, বীর্য, রণকৌশল এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা সম্পর্কে দেশবাসীর রহিয়াছে গভীর বিশ্বাস। আর বারে বারে তাহারা সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করিয়াছে। এবারের যুদ্ধে আমাদের বাহিনীর রণকৌশল সম্পর্কে ত্রিপুরাবাসীও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযােগ পাইয়াছে। আমাদের বাহিনী যেরূপ কৃতিত্বের সহিত রাজধানী আগরতলাকে রক্ষা করিয়াছে রণনীতির ইতিহাসে তাহা অভূতপূর্ব। সর্বোপরি এইবার যে ধরনের যুদ্ধ সংগঠিত হইয়াছে তাহাতে ত্রিপুরার একাংশ পাক বাহিনীর কবলিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আমাদের বাহিনী সুকৌশলে পাকিস্তানি অপচেষ্টাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ করিয়া দেয়। তাই আমাদের সেনাবাহিনীর প্রতি ত্রিপুরাবাসীর কৃতজ্ঞতার অন্ত নাই। ১৯৪৭ সাল হইতেই আমাদের সেনাবাহিনীর ইতিহাস গৌরবােজ্জ্বল। এই বছর তাহারা কাশ্মীরে পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করে। দেশ বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে যে ভারতের উপর আক্রমণ চালাইবে তাহা। ছিল কল্পনাতীত। আর ইহারই সুযােগ গ্রহণ করিয়াছিল পাকিস্তান। ১৯৬৪ সনের কচ্ছের যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সনের কচ্ছকে কেন্দ্র করিয়া সমগ্র সীমান্তে যুদ্ধ বিস্তার কাহারও অজানা নয়। আমাদের সেনাবাহিনী দক্ষতার সহিত প্রতিটি আক্রমণ মােকাবিলা করে। আর ১৯৬২ সনে বন্ধুর বেশে চীন চরম বিশ্বাসঘাতকতা না করিলে আমাদের বাহিনী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হইত না। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দি-চীনি ভাই ভাই স্লোগান তুলিয়া চীন অতর্কিতে আমাদের উত্তর সীমান্তে হামলা চালায়। আজ আমাদের বাহিনী উত্তর সীমান্তে সদা সতর্ক এবং সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ মােকাবিলায় প্রস্তুত। অদূর ভবিষ্যতে যদি চীন আবার ভারত আক্রমণের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে তবে তাহাদের সমুচিত শিক্ষা পাইতে হইবে।
মুক্তিযোেদ্ধা হিসাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর রহিয়াছে অপূর্ব ভূমিকা। তাহারা কৃতিত্বের সহিত হায়দ্রাবাদ এবং গােয়া মুক্ত করিয়াছে। এইবার বাংলাদেশ মুক্ত করিয়া নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিল। যে ধরনের রণকৌশলের মাধ্যমে ভারতীয় বাহিনীত্রয় বাংলাদেশে দখলদার পাক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করিয়াছে রনণীতির ইতিহাসে তাহা অভূতপূর্ব। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর শক্তি নেহাতই কম ছিল না। কিন্তু আমাদের বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাহারা হাজারে হাজারে আত্মসমর্পণ করিতে বাধ্য হয়। নিয়মিত এবং অনিয়মিত মিলাইয়া বাংলাদেশে আত্মসমর্পণকারী পাক সেনার সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। তাহাদের সঙ্গে আছে প্রচুর রসদ ও গােলা বারুদ। একটি যুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক সৈন্যের আত্মসমর্পণ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা। ইহার জন্য অবশ্য আমাদের বাহিনীকেও কিছু মূল্য দিতে হইয়াছে। যে সমস্ত বীর জওয়ান ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং বাংলাদেশের মুক্তির জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়াছে আমরা তাহাদের জানাই আমাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা।
পশ্চিম রণাঙ্গণেও আমাদের বাহিনীত্রয় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। সেখানে ভারতীয় বিমান এবং নৌবাহিনী পাকিস্তানের সুদূর প্রান্তে আক্রমণ চালাইয়া পাকিস্তানের প্রভূত ক্ষতি সাধন করিয়া, তুলনায় আমাদের ক্ষতি নগণ্য। তদুপরি ছাম্ব ছাড়া পশ্চিম রণাঙ্গণের সর্বত্র আমাদের বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করিয়া পাকিস্তানের বেশকিছু ভূখণ্ড দখলে আনিয়াছে। ভারতের এই প্রান্তে প্রচণ্ড যুদ্ধ হইয়াছে এবং এখানেও আমাদের কিছুসংখ্যক বীর জওয়ান দেশমাতৃকার চরণতলে জীবন উৎসর্গ করিয়াছেন। আর তাহাদের জীবনের বিনিময়ে পশ্চিম সীমান্ত হইয়াছে শত্রু কবল মুক্ত আমরা তাহাদের প্রতিও জানাই শ্রদ্ধা।
পক্ষকালব্যাপী তুমুল লড়াইয়ের পর পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান হইয়াছে। কিন্তু বিপদ এখনও কাটে নাই। হঠকারী পাকিস্তান আবার আমাদের সীমান্তে আক্রমণ চালাইতে পারে এবং অন্যদিকে উত্তর সীমান্তে চীনও যুদ্ধের হুমকি দিতেছে। তাই আমাদের সেনাবাহিনীর সম্মুখে রহিয়াছে বিরাট কর্তব্য।
আমরা বিশ্বাস করি, পঞ্চান্ন কোটি মানুষের শুভেচ্ছাকে পাথেয় করিয়া তাহারা যে কোনাে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরােধে সক্ষম। আমাদের অতুলনীয় বাহিনীত্রয়কে আমরা জানাই আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন।
সূত্র: জাগরণ
১৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১