স্বীকৃতির সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই
ভারত সরকার বাংলাদেশের অস্থায়ী স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছেন। আমরা এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাই।
এই সিদ্ধান্তের মধ্যে ভারতের ৫৫ কোটি জনতার দাবি স্বীকৃত রয়েছে; বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী জনতার আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দেয়া হয়েছে; এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার শক্তির ষড়যন্ত্রকে আঘাত হেনেছে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সাহায্যপুষ্ট পাক সামরিক চক্র ভারতের উপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলাে, দেশ-বিদেশে এবং বিশেষভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জনতাকে বিভ্রান্ত করা; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রগতিকে প্রতিহত করা; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করা। ভারতের সংগ্রামী জনতা ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার সাথে সাথে সারা পৃথিবীর গণতন্ত্র প্রিয় জনতার সামনে এবং বিশেষভাবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতন্ত্রপ্রিয় জনতার সামনে এই যুদ্ধের লক্ষ্য কী তা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবেন। স্বাধীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির মধ্যে এই লক্ষ্যই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ভারতের জনগণ বাংলাদেশের উপর তাদের কোনাে প্রাধান্য স্থাপন করতে চান না। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধাদের সহায়ক শক্তি, তাদের সংগ্রামের সাথী।
তাই ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তির দাবি হলাে, বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দানের সাথে সাথে তাকে এখন আরাে ব্যাপকভাবে অস্ত্র দিতে হবে, ট্রেনিং দিতে হবে। বাংলাদেশের যে লক্ষ লক্ষ যুবক অস্ত্রের ক্ষুধায় ছুটে আসছেন, তাদের মধ্যেই আছেন বৈমানিক, গােলন্দাজ, সৈনিক। তাদের হাতে তুলে দিতে হবে বিমান, ট্যাঙ্ক, বিমান বিধ্বংসী কামান। তারা শুধু বাংলাদেশকে মুক্তই করবেন না; তারা প্রতিষ্ঠা করবেন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতাকামী মানুষ বুঝতে পারবেন, ভারতীয় ফৌজ দখলদার সৈন্য নয়, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের হাতে ন্যাস্ত করে নিজেদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করছেন।
অপরদিকে, ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তিকে লক্ষ রাখতে হবে, যাতে এই যুদ্ধকে দেশের কায়েমী স্বার্থ ও শােষকগােষ্ঠী না ব্যবহার করে তাদের মুনাফা লুটের সুযােগ হিসেবে। সেটা হবে দেশরক্ষার পক্ষে সবচেয়ে ক্ষতিকর ও বিপজ্জনক। ভারত সরকার আহ্বান করেছেন দেশবাসীকে কষ্ট স্বীকার করতে। কিন্তু চা বাগানের মালিক বাগানে লকআউট ঘােষণা করবেন, অথচ শ্রমিক তার প্রতিবাদ করতে পারবে না, তা কি কখনাে সম্ভব? অসাধু ব্যবসায়ী দুই টাকা লিটার কেরােসিন বিক্রি করবে, আর ছাত্ররা পরীক্ষার সময়ও কেরােসিন পাবে না, তা কি কখনাে মেনে নেয়া যাবে? ধান পাটের দর থাকবে না, অথচ বকেয়া খাজনার জন্য গরু ক্রোক হবে তা কি কেউ সমর্থন করবেন? তাই গণতান্ত্রিক শক্তিকে দাবি করতে হবে, দেশ রক্ষার স্বার্থে সরকার ধনিক গােষ্ঠীর উপর চাপ দিন, তাদের মুনাফার হার কমাতে। ভারত রক্ষা আইন ও বিধিকে প্রয়ােগ করুন সমাজ-বিরােধী, মজুতদার, চোরাকারবারী ও শােষকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের উপর থেকে তুলে নিন সকল মামলা। রানীর বাজারের মতাে ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন। গণতান্ত্রিক অধিকার ও ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্প্রসারিত করুন, জনগণের মনােবল বৃদ্ধির জন্যে, যুদ্ধোদ্যমে জনগণকে আরাে বেশি ঐক্যবদ্ধ করতে। দেশের কোটিপতিদের বাধ্য করুন, যুদ্ধের ব্যয়ভার বহন করতে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের ফলে, আমাদের দায়িত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি আমাদের সামনে কঠোর সংগ্রামের দিনও এসেছে। দেশবাসীকে গণতান্ত্ৰিত ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ না করে, সে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। তাই, আমরা আহ্বান জানাই, সর্বত্র গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে আসুন, আমরা দেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তিকে এই মহান দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করি।
সূত্র: দেশের ডাক
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
২৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮