বিদেশী কমিউনিষ্টদের ক্ষমাহীন
অজ্ঞতা পাঁচ সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যা বন্ধ হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মুক্তিফৌজ জান কবুল করে লড়ছেন। হানাদার উচ্ছেদ তাদের সময় লাগবে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন ভারতে। পৃথিবীর বিবেকবান মানুষের কণ্ঠ থেকে উঠছে ধিক্কার। তারা কেউ রাষ্ট্রনায়ক নন। রক্তস্রোত বন্ধের হাতিয়ার তাদের হেফাজতে নেই। অবাক হয়ে প্রশ্ন করছেন বাংলাদেশের আর্ত জনতা, প্রশ্ন করছেন পঞ্চাশ কোটি ভারতীয় এবং আরও কয়েটি বিদেশী কমিউনিষ্ট দুনিয়া এবং আরব জনতা নীরব কেন? ভিয়েতনামে মাইলাই হত্যাকান্ডে তাদের আবেগ ফেটে পড়ে। আর হাজার হাজার মাইলাই সাম্প্রতিককালে সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে। তার জন্য কারও মুখে দেখা যায় না উদ্বেগের চিহ্ন। ইস্রাইল অধিকৃত আরব ভূমিতে অত্যাচারিত আরবদের জন্য মরা কান্না শুরু করে মুসলিম জাহান। দিকে দিকে শুরু হয় নাকি সুরে কলরব। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের দুঃখে তাদের চোখে দেখা যায় না এক ফোটা সহানুভূতির পানি। পশ্চিম ইউরােপ এবং আমেরিকার কথা আলাদা। তাদের অনেকে সাময়িক এবং অন্যান্য জোটে পাকিস্তানের সহযােগী। মানুষের রক্তের চেয়ে বৈষয়িক স্বার্থ তাদের কাছে বড়। কিন্তু কমিউনিষ্ট দুনিয়া? তাদের কি কৈফিয়ৎ আছে? অত্যাচারিতের প্রতি প্রত্যাশিত মমত্ববােধ আজ কোথায়? সংগ্রামী জনতার সঙ্গে একাত্ম হবার আগ্রহ তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না কেন? চীনকে টেনে এনে লাভ নেই। নেতারা সেখানে সুযােগ-সন্ধানী। বাংলাদেশের সংগ্রামে সমর্থন দেওয়া তাে দূরের কথা, তারা ঘাতক ইয়াহিয়া খানকে দিচ্ছেন অস্ত্রশস্ত্র। চীনাদের বৈপ্লবিক মন একটা বিরাট প্রহেলিকা। ওরা কি ভাবেন তা অন্যের পক্ষে বােঝা মুসকিল। পূর্বে ইউরােপের কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রগুলাের সম্পকে একথা বলা চলে না। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে রয়েছে তাঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তবু বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা নির্বিকার।
রহস্যভেদের চেষ্টা করছেন ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সম্পাদক শ্রীরাজেশ্বর রাও। তিনি গিয়েছিলেন সােভিয়েট রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির ২৪তম সম্মেলনে। দেশ-বিদেশ থেকে আগত কমিউনিষ্ট নেতাদের অনেকেই রাখেন। বাংলাদেশের খবর। তাজ্জব বনে গেছেন শ্রীরাজেশ্বর রাও। ইয়াহিয়া খান বন্ধ করেছেন সংবাদ আদানপ্রদানের পথ। কিন্তু ভারতেন দরজা তাে খােলা রয়েছে। দিল্লীর কমিউনিষ্ট পত্রপত্রিকাগুলাে কি প্রকাশ করতে পারত না বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার নারকীয় যজ্ঞের কাহিনী? উটপাখীর মত বালুর মধ্যে মুখ গুজে আসন্ন বিপদ না জানার ভান করা বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। যেকোন দেশের কমিউনিষ্ট নেতা এবং কর্মীদের বাস্তব জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে সবার আছে একটা মর্যাদাসূচক স্বীকৃতি। শ্রীরাকেশ্বর রাও তাদের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে বহু দিনের সঞ্চিত ধারণা পাল্টান ছাড়া উপায় নেই। রক্তের স্রোত বইছে বাংলাদেশে। প্রতিদিন সেখানে সংযােজিত হচ্ছে ইতিহাসের নূতন নূতন অধ্যায়। ইউরােজের কমিউনিষ্টরা খবর রাখেন না তার। পর্বতপ্রমাণ অজ্ঞতা নিয়ে এরাই করবেন মানবমুক্তির সংগ্রাম। হিটলারের স্বৈরাচারী দাপটের জের এখনও চলছে যাদের মধ্যে তারা ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিরাসক্ত দর্শক। এর ব্যাপকতা অনুধাবনেও অনাগ্রাহী। শ্রীরাজেশ্বর রাও-এর অভিযােগ যদি সত্য হয়, তবে ইউরােপের কমিউনিষ্টদের মগজ ধােলাই দরকার। তা না হলে তারা সত্য-সচেতন হবেন না। অজ্ঞতার অন্ধকারে ঢাকা পড়বে দুনিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তনের আসল তাৎপর্য।
আরব রাষ্ট্রগুলাে পাক-ভারত সীমান্ত থেকে খুব বেশী দূরে নয়। ভারতের সাধারণ শিক্ষিত মানুষ খোঁজ রাখেন আরবীয় জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং হতাশার আনুপূর্বিক কাহিনী। আরবের সাধারণ মানুস বাস করেন মধ্যযুগে। কিন্তু শিক্ষিত সমাজ আধুনিক। তারাও বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে অনবহিত। অজ্ঞতায় আরব কমিউনিষ্টরাও কম যান না। পূর্ববাংলা এবং পশ্চিমবাংলা বলে যে দুটি অঞ্চল আছে এ খবরও রাখেন না তারা। বাঙালীরা গােটা পাকিস্তানে সংখ্যাধিক্য—একথা জানা নেই তাদের। ভাষা আন্দোলন, ইয়াহিয়ার গণহত্যা এবং বাঙালীর মুক্তিসংগ্রাম—সব কিছুই তাদের কাছে এক অশ্রুত কেচ্ছা। এই যদি কমিউনিষ্ট দুনিয়ার জ্ঞানের বহর হয়ে থাকে, তবে ধর্মান্ধ এবং নিরক্ষর আরব মুসলমানদের দোষ কি? ইসলামের নামে গোড়ার দল তাদের ছাইভস্ম যা বুঝাচ্ছে, তারা তাই বুঝছে। এদের চোখের সামনে সত্যের বাস্তব ছবি তুলে ধরার উৎসাহ পর্যন্ত নেই কমিউনিষ্ট এবং সমাজতন্ত্রী আরব নেতাদের। তারা নিজেরাই অন্ধ। অপর অন্ধকে পথ দেখাবেন কি করে? স্বাধীন বাংলাদেশের নায়করা হয়ত এখন বুঝতে পারবেন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা। কেন বাংলাদেশের রক্তাক্ত সংগ্রামের কাহিনী সাড়া জাগাচ্ছে না বিদেশী মুসলমানদের মনে। অনুক্ত কাহিনী তাদের কাছে অস্তিত্বহীন। এ থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত ভারতের। জোরদার করা দরকার তার প্রচার অভিযান। বাংলাদেশ লড়বে। ইয়াহিয়ার ঘাতক-বাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু ইউরােপ এবং আরব কমিউনিষ্টদের শােচনীয় অজ্ঞতা ক্ষমা করবে না কেউ। ওরা বাংলাদেশের আস্থা হারাতে বসেছেন। আর হারাতে যাচ্ছেন কোটি কোটি মানুষের অন্তরের সঞ্চিত আশা।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ মে ১৯৭১