You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.30 | ভাসানীর চোখের জল মুছাবেনা পিকিং | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ভাসানীর চোখের জল মুছাবেনা পিকিং

চোখের জলে ভাসছেন মৌলানা ভাসানী। দৃষ্টি তার ঝাপসা। বৃদ্ধ বয়সে পেয়েছেন তিনি নিদারুণ আঘাত। ছারখার হয়ে যাচ্ছে সােনার বাংলা। মুসলীম লীগ এবং আর ক’টি ধর্মীয় রাজনৈতিক সংস্থার সমর্থক ছাড়া বাঙলীমাত্রই ইয়াহিয়ার সৈন্যদের শিকার। মৌলানার ঘর-বাড়ী চুরমার হয়ে গেছে। চীনা সমর্থক বলে তিনি রেহাই পান নি চীনাদোস্ত ভুট্টো-ইয়াহিয়ার হাত থেকে। ইসকান্দার মির্জার তাড়া খেয়ে মৌলানা ভাসানী একবার আশ্রয় নিয়েছিলেন ভারতে। ইয়াহিয়ার ঘাতকদের খাড়া থেকে গলা বাচাবার জন্য এখন তিনি। তাকাচ্ছেন আবার সেই ভারতের দিকে। ঔশ্লামিক জাহান নীরব। বাংলা দেশের গণহত্যায় তাদের নেই কোন বিবেক দংশন। অথচ চৈনিক প্ররােচনায় এই ভাসানীই একসময় করেছেন ভারতকে কটুক্তি। বাস্তবের কঠিন আঘাতে মােহ ভেঙ্গেছে। তার বাঙালীতু তাঁকে পাক-ঘাতকদের বধ্য করে তুলেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে তিনি মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের ভাগ্য। স্বাধীন বাংলাদেশের অনুকূলে আন্তর্জাতিক আলােড়ন। তার সরকারের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি। রাজনিতিতে ভাবাবেগের স্থান নেই। বৃদ্ধের কান্নায় গলবে না বড় বড় রাষ্ট্রের নায়কদের পাষাণ হৃদয়। তাদের মধ্যে নেই অত্যাচারিত মানুষের প্রতি মানবীর দরদ। জাতীয় স্বার্থের নিমিত্তে মাপজোকা ওদের কথাবার্তা। পিকিং-এর অনেক নেতাকেই চিনেন মৌলানা ভাসানী। এক সময় তিনি ছিলেন সম্মানিত সহযােগী। তাঁর কাঁধে ভর করে অনেকেই চালিয়েছেন পূর্ববাংলায় চৈনিক রাজনীতি। ভারত বিশ্বের প্রচারের জন্য তাঁকে ব্যবহারের চেষ্টার বিন্দুমাত্র ক্রটি ঘটেনি। মূলতঃ কিষাণ নেতা মৌলানা ভাসানী। ঐস্লামিক আওতায় কিষাণ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। কিন্তু তার মধ্যে ছিল আত্মসমর্পণ করেছেন মৌলানা ভাসানী। তিনিই প্রথমে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের ডাক। নির্বাচন করেছিলেন বয়কট। স্বাধীন বাংলাদেশ যখন বাস্তব যখন বাস্তব তখন পিছিয়ে থাকা মৌলনার পক্ষে সম্ভব নয়। চীনের কাছে তার প্রত্যাশা অফুরন্ত। এই চীনই এখন মদৎ দিচ্ছে স্বৈরাচারী এবং প্রতিবিপ্লবী ইয়াহিয়া খানকে। রাজনীতির এই অপ্রত্যাশিত ওলট-পালটে ভাসানী দিশাহারা। তাঁর মনে জমে উঠেছে নিদারুণ সংশয়। হয়ত তিনি ভাবছেন, আসল খবর জানেন না পিকিং। ভুল বুঝান হয়েছে তাদের তাই নিজে তিনি যাবেন চীন সফরে। চাঙ্গা করে তুলবেন পিকিং-পর বিপ্লবী সত্তাকে। ইয়াহিয়া খানকে দাঁড় করাবেন আসামীর কাঠগড়ায়।
ভুল বুঝছেন মৌলানা ভাসানী। পিকিং-এর নায়কেরা ভালভাবেই জানেন কি ঘটেছে বাংলাদেশে। তাঁদের তাত্ত্বিক বিচারে মুজিবর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার জাতীয়াবাদী বুর্জোয়া। এদের সংগ্রামে চীনা মার্কা বিপ্লব নয়। মুজিবর এবং ইয়াহিয়া—এই দুই বুর্জোয়ার দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া তাদের বৈপ্লবিক পরিকল্পপনারা অঙ্গ। মুজিবর বাহিনীকে জিততে দেবে না চীন। এদের শাসন বাংলাদেশে কায়েক হলে লাভবান হবে ভারত। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তিতে পড়বে ভাটা। চারদিক থেকে নিতে পারছে না। কোন মতে। যতই দিন সঙ্কট ততই ঘােরাল হয়ে উঠছে।
মৌলানা ভাসানী সত্যিই যদি পিকিং যান তবে তাকে মনে রাখতে হবে এই বাস্তব সত্য। বাংলাদেশে কতকগুলাে মানুষ মরল, কতগুলাে জনপদ উজার হয়ে গেল এবং রক্তগঙ্গা কতদিন বইবে তা নিয়ে মাথা ঘামাবে না চীন। পদ্মা-মেঘনার জলধারা স্থিতিলাভ করে বঙ্গোপসাগরে। এই জলধারা ইয়াংসি নদীতে পৌছন না পর্যন্ত পিকিং এর মধ্যে দেখা যাবে না কোন মানবীয় উত্তেজনা। মুজিবরকে সমর্থন জানিয়ে বুর্জোয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছেন মৌলানা ভাসানী। তাঁর জীবনদর্শন গড়ে উঠেছে বাস্তবের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ। এর উপর যখনই তিনি দিতে চেয়েছেন দার্শনিক প্রলেপ তখনই এসেছে নিদারুণ ব্যর্থতা। তার তত্ত্বের মধ্যেই ছিল গোঁজামিল। ঐশ্লামিক ভ্রাতৃত্বের দোহাই দিয়েছিলেন তিনি। কোন সাড়া মিলেনি। ঐশ্লামিক জোটের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। সেখানে নেই কোন মানবীয় ভ্রতৃত্ব। আছে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থ। ওদের চোখে বাঙালী মুসলমানরা খাটি মুসলমান নন, ধর্মান্তরিত হিন্দু। এমন কি ইস্কান্দার মির্জাও একদিন নগ্নভাবে প্রচার করেছিলেন এই কাহিনী। কমিউনিজমের বুলি নিয়ে ভাসানী সেজেছিলেন বিপ্লবী। চান ওটাকে মনে করত বাইরের আলখেল্ললা। জাতীয়তাবাদীরাও বিশ্বাস করতেন না তাঁকে। বৃদ্ধ বয়সে ভাসানী নিঃসঙ্গ এবং পরিত্যক্ত নেতা। জাতির চরম দুর্দিনে জাতীয়তাবাদী বাঙালী হিসেবে জ্বলে উঠেছেন। ভাসানী। সংগ্রামের শেষ তিনি দেখে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ। ব্যান্ডেজ বাধা হাতে তিনি যখন চীনা নেতাদের আদাব জানাবেন তখন হয়ত দেখবেন তাদের বা হাতগুলাে অর্ধউত্তেলিত হয়ে নেমে যাচ্ছে। ডান হাত লুকানাে। কারণ এ হাত গুটাতে সময় লাগবে। মৌলনা ভাসানী তখন হয়ত ইহ জগতে থাকবেন না। অনুতপ্ত বৃদ্ধের চোখের জল মুছতে পিকিং এর কেউ এগিয়ে আসবেন না। ব্যর্থতার মর্মজ্বালা নিয়ে তাকে ফিরে আসতে হবে আবার এই দুর্গত বাংলাদেশে।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩০ এপ্রিল ১৯৭১