বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৪ই ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২৮শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
সোনার বাংলা গড়তে হলে
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে সৎ, যোগ্য, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমীক এবং আদর্শনিষ্ঠ প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত পরশু এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন, নির্ভয় এবং বিনা প্রলোভনে এবার ভোটদাতারা তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃবর্গকে নির্বাচন যাতে সুসম্পন্ন করতে পারেন, সেজন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাবলম্বন নিশ্চিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচিতরা নিঃস্বার্থভাবে জনসাধারণের সেবা, শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং দুঃস্থ জনগণের মুখে হাসি ফোটানোর ঐকান্তিক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাবেন। বঙ্গবন্ধু মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভা গ্রাম বাংলা এবং শহরে-নগরে গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার সত্তিকারের ভিত্তি।
বাংলাদেশের প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ক্ষেত্রেও এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত হবে বলে আসন্ন নির্বাচনের প্রতি বঙ্গবন্ধু সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এবং তাই বঙ্গবন্ধু দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে, সোনার বাংলা গড়ার কাজে প্রয়োজন সৎ,আদর্শনিষ্ঠ, যোগ্য, ত্যাগী ও দেশ প্রেমিক নেতার। কাজেই ভোটদাতারা যেনো এই সব গুণাবলীর অধিকারী প্রার্থীদেরই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার প্রতি লক্ষ্য রাখেন। বঙ্গবন্ধু দেশবাসীকে এ আশ্বাস ও অভয় বাণীও দিয়েছেন যে, নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক কারণেই এ প্রত্যাশা আমরা করতে পারি যে, ভোটদাতাদের বিচার এবং নির্বাচন নিখুঁত এবং সুস্থ হবে।
বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের নাড়ি চেনেন। তাই তিনিও বাংলার মানুষের উপর দৃঢ় আস্থা পোষণ করছেন। ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভাগুলোর আসন্ন নির্বাচনে যাতে প্রকৃত দেশ প্রেমিকরা নির্বাচিত হতে পারেন, সেজন্যে বঙ্গবন্ধু ভোটদাতাদের সুবিচার কামনা করেছেন। একথা দিবালোকের মতো সত্য যে, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাগুলোর নির্বাচন সত্যিকার সোনার বাংলা গড়ার কাজে প্রধান সহায়ক শক্তি হিসেবে প্রতিপন্ন হতে বাধ্য। সেজন্যে যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়াই বাঞ্চনীয়। ফলে ভোটদাতাদের সুবিবেচনার ওপর আমাদের নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোনো উপায়ান্তর নেই। গণতান্ত্রিক প্রথায় নির্ভয়ে ভোটদাতাদের নিজের ভবিষ্যৎ নেতা নির্ধারণ করতে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। নইলে টাউট, ধোকাবাজ এবং ভন্ড নেতাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হলে তারা শেষাবধি জনগণের জীবনে দুর্দশার কারণ হিসেবে দেখা দেবেন। গ্রামাঞ্চল এবং শহরাঞ্চলের জনগণ আশা করি নিজেদের মূল্যবান ভোটটি দেয়ার সময় এই। চরম সত্য কথাগুলো হৃদয়াঙ্গম করেই ভবিষ্যৎ নেতা নির্বাচনের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সক্ষম হবেন।
কারণ আমরা সবাই চাই আমাদের এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটি সত্যিকার সোনার বাংলায় পরিণত হোক। আমরা সবাই কায়মনোবাক্যে কামনা করি, দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হোক, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘটুক উন্নতি। এমতাবস্থায় যদি দেশবাসী তাদের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্ভুল এবং সুস্থ সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, তাহলে তাদের সে ভুলের খেসারত কড়ায় গণ্ডায় দিতে হবে। আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু তাই দেশবাসীর প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা আমাদেত যুক্তি ও অনুভূতির আলোকে উপলব্ধি করতে হবে।
নির্যাতন সর্বকালেই মানবতাবিরোধী
‘এমনেসটি ইন্টারন্যাশনাল’ এর উদ্যোগে আয়োজিত একটি সম্মেলন সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় তিনশ’ প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। সম্মেলন তার বিভিন্ন প্রস্তাবাবলীর মধ্যে মুখ্য প্রস্তাব যেটি নিয়েছে সেটি হলো- নির্যাতন একটি মানবতাবিরোধী অপরাধ। নির্যাতন একজন মানুষের স্বাধীনতা ও সম্মানের পক্ষে অন্তরায় স্বরূপ। প্রস্তাবে সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর নির্যাতনকেও বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘এমনেসটি ইন্টারন্যাশনালের’ নেতৃবৃন্দ তাদের অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন- নির্যাতনের প্রচলন এক সরকার থেকে অন্য সরকারে যে হারে সংক্রমিত হচ্ছে তা নিদারুণ আশঙ্কার কারণ। তার জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে সকল নির্যাতন বিধি রয়েছে তার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। তারা ধর্মীয় ও বৃত্তিমূলক সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন। এমনেসটি ইন্টারন্যাশনালের নির্যাতন বিরোধী প্রস্তাব সমূহ মানবতার দৃষ্টিকোণে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিশ্বব্যাপী এর একটা প্রতিক্রিয়াও দেখা দেবে।
বিশ্বশান্তি ও মানবতার সপক্ষে যে সকল শক্তি রয়েছে তাদের কাছে এই নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনের ডাক নিঃসন্দেহে আদৃত হবে। মানুষের উপর দৈহিক নির্যাতন একটি মানবতা বিরোধী কাজ হলেও বিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই এ ধরনের নির্যাতনের প্রচলন রয়েছে। প্রাথমিক সমাজ গঠনের প্রয়োজনে যে সকল শত্রু তার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার দ্বারা বাধা সৃষ্টি করে থাকে তাকে মুলোৎপাটনের নিমিত্তে দৈহিক নির্যাতনের নিয়ম রাখা হয়েছে। সমাজ যখন সংস্কারমুক্ত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিখরে উপনীত হয় তখন দৈহিক নির্যাতনের প্রয়োজন হ্রাস পায়। কিন্তু মানবতার বিকাশ যতক্ষণ পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুট না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্যাতন বন্ধ হবে কি না তা বিবেচ্য। তবু মানবতার যুগে, ব্যক্তি স্বাধীনতার ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুগে মানুষের উপর দৈহিক নির্যাতন চালানো মনুষ্যত্ব বিরোধী বলে প্রতিপন্ন হয়। আমরা বিশ্বের মানবতাকামী দেশগুলোকে ক্রমান্বয়ে নির্যাতনের পথ রোধ করে মানবতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার কাজে অগ্রসর হবার আহ্বান জানাব।
উৎসাহী ও কর্মতৎপর জনসেবক কারা?
ঘূর্ণি আঘাত করেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে, ক্ষতি হয়েছে, এসব খবর আমরা পেয়েছি- দেশবাসী সবাই পেয়েছেন। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেডক্রস ইত্যাদি সংস্থা জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, সাহায্য দ্রব্য বিতরণ করছেন। আমরা যতটুকু জানি সরকার এখন পর্যন্ত দুর্গত এলাকার ক্ষয়ক্ষতির জন্য সর্বস্তরের জনগণের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহের আবেদন জানাননি কিংবা অন্য কোন সংস্থার প্রতিও নির্দেশ দেননি বা অনুমতি দেননি। কিন্তু গতপরশু রাজধানী শহরের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি পথে পথে গাড়ী থামিয়ে লাল সালুর ব্যানার নিয়ে আর্তের সেবার নামে চাঁদা সংগ্রহ করছেন। এমনিতর চাঁদা সংগ্রহের অভিযান শুধু ঢাকা শহরে নয় দেশের অন্যান্য জায়গাতেও দেখা যাচ্ছে বলে সংবাদও খবরের কাগজে বেরিয়েছে।
নবতার খাতিরে আর্তের সেবায় এগিয়ে আসা অত্যন্ত মহৎ কাজ সন্দেহ নেই। কিন্তু আর্থিক সেবার নামে সর্বস্তরের জনগণের কাছ থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে যদি সে তারা সম্পূর্ণ অর্থ যথার্থভাবে সত্যিকার দুঃস্থ মানুষদের হাতে না পৌঁছে তাহলে সেটা নিশ্চয়ই জনসেবার কাজ নয় বরং তো অপরাধ এবং জন সেবকের রূপে আত্মসেবারই নামান্তর। যখনই কোথাও সাহায্য প্রদানের মতো কোন অবস্থা ঘটে তখনই দেখা যায়, বলা নেই কওয়া নেই এক শ্রেণীর জনসেবকরা চাঁদা আদায়ের জন্য কালো ব্যাজ লাগিয়ে (বোধ করি শোক প্রকাশের প্রতীক হিসাবে) লাল সালু বিছিয়ে মোড়ে মোড়ে চাঁদা আদায়ে নেমে যান। এই সব চাঁদার হিসাব কিভাবে রক্ষা করা হয় বা সংগৃহীত অর্থের সম্পূর্ণ যথার্থভাবে প্রকৃত দুঃস্থ মানুষের হাতে পৌঁছে কিনা সন্দেহ। অথচ এভাবে সরকারি অনুমতি ব্যাতিরেকে কিংবা সংগৃহীত অর্থের হিসাব নিকাশ না রেখে জনসাধারণের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা আইনসঙ্গত তো নয়ই এটা জনগণের প্রতি জুলুম। কিন্তু সে অধিকার কারো নেই।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য ট্রেনে, ষ্টিমারে, বাসে কিংবা শহরের পথে পথে মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা গড়ে তোলা কিংবা স্কুলের সাহায্যের নামে দেশের সর্বত্র আরেক শ্রেণীর লোক অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এইসব অর্থেরও কোন হিসাব নিকাশ রাখা হয় না বলেই জানা যায় এবং তারাও সরকারের কাছ থেকে কোন অনুমতি না নিয়েই এভাবে অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। আমরা মনে করি এই বিষয়গুলোর প্রতি অবিলম্বে সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিত। বিষয়গুলোকে ছোট করে বিবেচনা করার অবকাশ নেই বলেও আমরা মনে করি। কেননা এতে করে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী জনসেবকদের দৌরাত্ম্য ক্রমান্বয়ে বেড়ে যেতে পারে। নিরীহ জনসাধারণের আর্তের সেবার নামে জুলুম চালাবার অধিকার তাদের নেই। সুতরাং এভাবে অর্থ সংগ্রহ যাতে বন্ধ হয় সে ব্যাপারে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সুস্পষ্ট ঘোষণা দিতে হবে। যদি কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে অর্থ সংগ্রহের অনুমতি দেওয়াও হয় তাহলে চাঁদা আদায়, আদায়কৃত অর্থের হিসাব নিকাশ ও তা যথার্থ স্থানে পৌঁছাবার ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকতে হবে যাতে করে আর্তের সেবার নামে সংগৃহীত অর্থের একটি পয়সাও অপচয় না ঘটতে পারে।
আমরা আশা করি সরকার মানবতাবোধের সঠিক মূল্যায়নের প্রেক্ষিতেই মানবতার নামে, অমানবতামূলক এইসব হীন কাজ বন্ধ করতে সক্রীয় ভাবে সচেষ্ট হবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক