বাংলার বাণী
ঢাকা: শুক্রবার ২৬শে মাঘ, ১৩৭৯ ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩
আজ জাতিসংঘের মহাসচিব আসছেন
উপমহাদেশ সফরের শেষ পর্বে জাতিসংঘের মহাসচিব কুর্ট ওয়াল্ক হেইম আজ ঢাকা আসছেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের প্রশ্নটাই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রতিষ্ঠানের এক খবরে প্রকাশ। জাতিসংঘের অসদস্য একটি রাষ্ট্রের সংস্থার মহাসচিব হিসেবে মিঃ ওয়াল্ক হেইমের এই সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জল্পনা-কল্পনা তাই দানা বেধে উঠেছে মহাসচিবদের এই সফরকে কেন্দ্র করে।
আমরা বহুবার দেখেছি এই উপমহাদেশের শান্তি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের বাস্তব বোঝাপড়ার উপর নির্ভরশীল। স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তাই সর্বাগ্রে যা প্রয়োজন তা হলো সহজ-সরল বাস্তবতাকে মেনে নেয়া। দিনের আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে যারা বাতাসে গদা ঘোরাচ্ছেন প্রকৃতপক্ষে তারা উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায়ই বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন।পাকিস্তান আমলে শুধু জীবিকার অন্বেষণে বাংলাদেশের অসংখ্য মেহনতী মানুষকে পাড়ি জমাতে হয়েছিল তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের সম্পদ গড়ে ওঠা করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদের জীবিকার ক্ষেত্রে শুধু বাঁচার প্রয়োজনে এই সকল নিরীহ চাকরিজীবীকে আনা আস্তানা গাড়তে হয়েছিল। অতঃপর জ্বলে উঠলো বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে বন্দরে সংগ্রামের মশাল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি ঘোষণা করল স্বাধীনতা। চলল লড়াই। ন’মাস দীর্ঘ লড়াইয়ের জীবন দান করল ত্রিশ লক্ষ জনতা। হিংস্রতা আর নির্যাতনের যে নজির পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনী যে ন’মাসে বাংলাদেশের স্থাপন করল তার তুলনা ইতিহাস খুঁজে মেলা ভার। সম্পদ আর জীবনের এত ক্ষয়ক্ষতি কোন স্বাধীনতা সংগ্রামী একটা জাতীকে স্বীকার করতে হয়েছিল বলে আমাদের জানা নেই। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে সেই বর্বর সেনা বাহিনীকে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে সংগ্রামী জনতার কাছে। মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সংযুক্ত কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় তারা। সেই হায়নার দল এখন বন্দি রয়েছে ভারতীয় শিবিরে যুদ্ধবন্দী প্রায় এক লক্ষ সৈন্যের মধ্যে। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিচার করবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন বাংলাদেশে সরকার। এই সেদিনও আইন মন্ত্রী জনাব কামাল হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশের মাটিতেই এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে। তার প্রস্তুতিও ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে এটা সহজ কথা, আইনের কথা। যারা ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে সহায় সম্পদ বিনষ্ট করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সহজ বিষয়কেই বাঁকা চোখে দেখছেন একশ্রেণীর মতলববাজ গোষ্ঠী। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো সরাসরি এই বিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলেছেন, যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয় তবে তিনি তার প্রতিশোধ প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের উপর। ইতিমধ্যেই পাকিস্থানে আটক প্রায় চার লাখ বাঙালির উপর অমানুষিক অত্যাচার এর বিভিন্ন কাহিনী আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। উচ্চপদস্থ সামরিক এবং বেসামরিক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছেন বলেই মিঃ ভুট্টো বুঝতে পারছেন না যে শুধুমাত্র জীবিকার অন্বেষণে যাদের একদিন পাকিস্তানের পাড়ি জমাতে হয়েছিল তারা আর হত্যাযজ্ঞ লুন্ঠনের হোতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক নয়। যারা যুদ্ধাপরাধী তারা শুধু বাংলাদেশের নয় মানবতার শত্রু। এই মানবতার শত্রুদের বিচার এবং শাস্তিদান বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে চিরজাগ্রত থাকবে। যাতে করে আর কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষ মানবতার বিরুদ্ধে এমন জঘন্য আক্রমণের প্রয়াস না পায়। তাই শান্তি এবং মানবতার খাতিরে প্রয়োজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হওয়া।
মিঃ ওয়াল্কহেইম আসছেন। বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে তিনি নিশ্চয়ই ওয়াকেবহাল রয়েছেন। তাছাড়া ঢাকা আসবা পূর্বে তিনি পাকিস্তান এবং ভারতের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছেন। পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের সমস্যা যে কত গভীর তার তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। মিঃ ভুট্টোর অন্ধ নীতি উপমহাদেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় যে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে তার অবসান শান্তিকামী মানুষমাত্রেই কামনা করে। কামনা করে উপমহাদেশে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সেখানে আটক বাঙ্গালীদের যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবেন। এবং এ বিষয়ে বিশ্ব বিবেক অধিক সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। মিঃ ওয়াল্কহেইমের মতো বিশ্ব সংস্থার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি তার সার্বিক প্রভাব কোন দেশের শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োগ করবেন বলে শুধু আমরাই নয় বিশ্ব শান্তিকামী মানুষ আশা পোষণ করে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখে আমরা ঢাকায় মিঃ ওয়াল্কহেইমের আগমনকে স্বাগত জানাই।
সমবায়ের বাস্তবায়ন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে
সমবায়ের ভিত্তিতে দেশ গঠনের একটা বৃহৎ পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর-পরই বাংলাদেশ সরকার সমবায়ের ভিত্তিতে কৃষি ও কুটির শিল্প কে নিয়ন্ত্রিত করার প্রকল্পে কথা ঘোষণা করেছিলেন। এবং তখন থেকেই সমবায় ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থা যেহেতু একটি বিপ্লবাত্নক বিষয় সেহেতু এর যথেষ্ট শত্রু রয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী জনাব শামসুল হক সম্প্রতি বরিশালের এক সমবায় সমিতির সভা প্রতিষ্ঠিত প্রসঙ্গে বলেছেন, সরকার ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য দীর্ঘ সংকল্পবদ্ধ। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে যে সকল অশুভ শক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াবে তাদের কোনো অবস্থাতে সহ্য করা হবে না বলে তিনি দৃঢ় মত পোষণ করেন। তিনি সমবায় এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ চলছে বলেও উল্লেখ করেন। বস্তুতঃ সমবায় ব্যবস্থা একটি অত্যন্ত প্রগতিশীল কর্মসূচি। এটাকে যদি বাস্তবায়িত করা যায় তাহলে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন আসতে বাধ্য। ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার ব্যাপারে ব্যবস্থা একটি বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আনবে। বাংলাদেশ একটি কৃষি নির্ভরশীল দেশ। বিশ্বের যে সকল দেশ কিসের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশে তাদের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতির দ্বারা এ দেশের সর্ববৃহৎ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। প্রকৃতির দান এ জাতির প্রতি অপরিসীম। আমাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকরা যদি এ অপার শক্তিময় প্রকৃতির দানকে সদ্ব্যবহার না করেন তাহলে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হতে পারে না। অতীতে পাকিস্তান সরকার এদেশের কৃষি ও স্বনির্ভর শিল্পকে গড়ে তোলার জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কৃষি ব্যবস্থার উপর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে দেশের চেয়ে খাদ্যাভাব পূরণ হতে পারতো তারও কোনো ব্যবস্থা সেদিন গ্রহণ করা হয়নি। এর মূলে ছিল রাজনৈতিক অসাধুতা। আজ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। তার জন্য সরকার সমবায় প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অন্যদিকে ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহ প্রদান না করে সমবায়ের ভিত্তিতে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার কেউ সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
আধুনিক বিশ্বের সমবা ব্যবস্থায় এক বিরাট অর্থনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ব্যবস্থায় সার্থক প্রবর্তন হয় সর্ব প্রথম। তারপর থেকেই প্রগতিশীল অর্থনীতির একটা দ্বার মোচন হয়। আর এর পেছনে ছিল সমবায় প্রথম চার ও শিল্প গড়ার পরিকল্পনা। সমবায় ব্যবস্থার সুফল আজকে দুনিয়ায় আর অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্বে প্রায় প্রত্যেকটি দেশি এই প্রথার মাধ্যমে অর্থনীতিকে গড়ে তুলছে।
বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই সমবায়ের পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। এদেশের মান্ধাতামলের কৃষি ব্যবস্থাকে ঢেলে নতুন করে সাজাতে হবে। আধুনিক কারিগরি উপায় চাষাবাদের প্রবর্তন করতে হবে। কুটির শিল্পকে নতুন প্রত্যেক গড়ে তুলতে হবে। কৃষি ও কৃষকের জীবনে পরিবর্তন আনতে হলে সমবায়ের বাস্তবায়ন একান্ত প্রয়োজন। এর জন্য দরকার কৃষি ক্ষেত্রে কৃষকদের সংগঠনের তারা একটি পরিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলা। কৃষকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে তাদের নেতৃত্বে এ আন্দোলন সফল হতে পারে। সমবায় বাস্তবায়নে ও তার শত্রু দমনের জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ ছাড়াও জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক