দৈনিক মিল্লাত
১৫ই জুন ১৯৫৮
পাকিস্তান বিরােধী মওদুদী চক্রের আদর্শের বুলি আওড়াইবার অধিকার নাই
পল্টনের মহতী জনসভায় জনাব সােহরওয়ার্দীর বক্তৃতার শেষাংশ
[গত শুক্রবার পল্টনের মহতী জনসভায় জনাব সােহরাওয়ার্দীর বক্তৃতার প্রথমাংশ গতকল্যকার মিল্লাতে প্রকাশিত হইয়াছে। অদ্য অবশিষ্ট অংশ প্রকাশিত হইল]
শেখ মুজিবর রহমান
শেখ মুজিবর রহমান গত শুক্রবার পল্টনের জনসভায় বক্তৃতা দিতে উঠিয়া বলেন যে, খানে আজম খানে সার্দুল কাউয়ুম খান এই দেশ জয় করিতে আসিয়াছেন। তিনি (কায়ুম খান) আমাদের নেতৃবৃন্দ এবং প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে গালিগালাজ করিয়া বক্তব্য দান করিতেছেন। তিনি নাকি দেশের আত্মত্যাগ করিয়াছেন বলিয়াও প্রচার করিয়া ফিরিতেছেন। এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান কাইয়ুম খানের অতীত কলঙ্কময় ইতিহাসের উলেখ্য করিয়া বলেন যে, ছয় বৎসরকাল কাইয়ুম খানের সীমান্তের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে তথার লাল কোর্তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চলে। প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে সমালােচনা করার ব্যাপারে তিনি কাইয়ুম খানকে সমর্থন করিয়াছেন বলিয়া জনাব কাইয়ুম খান যে দাবী করিতেছে শেখ মুজিবর রহমান তাহার প্রতিবাদ করিয়া বলেন যে, বরঞ্চ জনাব কাইয়ুম খান তাহাদিগকে সমর্থন করিতেছেন।
জনাব মজিবর রহমান বলেন যে, মুসলিম লীগই জনাব ইস্কান্দর মীর্জাকে কর্মচারী হিসেবে চাকুরীর ক্ষেত্র হইতে রাজনীতিতে আনয়ন করিয়াছে। ৯২ক প্রবর্তন করিয়া তাহারাই গভর্ণর হিসেবে মীর্জাকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরণ করে। যাহার ফলে দেড় সহস্র কর্মীকে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল। আর আজ তাহারাই প্রেসিডেন্ট মীর্জাকে গালি দিতেছে।
মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের প্ররােচনায় কর্ণপাত না করিবার জন্য শেখ মুজিব জনগণের নিকট আবেদন জানান। তিনি বলেন যে, তদানিন্তন গভর্ণর জেনারেল মরহুম গােলাম মহম্মদ জনাব নাজিমুদ্দিনকে হঠাইয়া দিলেন। মুসলিম লীগ তাহার প্রতিবাদ করে নাই। শেখ মুজিব বলেন, জনাব কাইয়ুম খান তাহার বক্তৃতায় পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের জন্য শতকরা পঞ্চাশ ভাগ অর্থ, স্বায়ত্বশাসন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উল্লেখ করেন না। তিনি কেন্দ্রে মন্ত্রী থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানে গুলিবর্ষণ হয়, তিনি তাহার প্রতিবাদ করেন নাই। অথচ আজ তিনি পূৰ্ব্ব পাকিস্তানী মন লইয়া এখানে আগমন করিয়াছেন বলিয়া দাবী করিতেছেন। মওলানা মওদুদীকে সমালােচনা করিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, এখানে যখন দুর্ভিক্ষ চলিতেছিল, মওদুদী সাহেবের তখন পাত্তা পাওয়া যায় নাই। অথচ এখন তিনি এখানকার দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে গলা ফাটাইতেছিল। মওলানা মওদুদীর উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ বড় কিছু করিয়াছে বলিয়া দাবী করে না। কিন্তু একথা আওয়ামী লীগ জোর গলায় বলিতে পারে যে, তাহারা দেশের খারাপ কিছুই করে নাই। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করিয়া তিনি বলেন যে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার ফলে আওয়ামী লীগ কাজ করিতে অসুবিধার সম্মুখীন হইয়াছে। তদুপরি কেন্দ্রের অসহযােগিতার ফলেও তাহাদের কাজ ব্যাহত হইয়াছে। তিনি বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে প্রয়ােজন মত সৰ্ব্বদাই কেন্দ্র হইতে সাহায্য পাওয়া গিয়াছে। মােহাজেরদের সম্পর্কে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, তাহারা (মােহাজের) পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের বসতি স্থাপন করিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বুকের রক্ত দিয়া তাহাদের রক্ষা করিবে। কিন্তু পরিবর্তে মােহাজেরদেরও উচিত পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে না তাকাইয়া এখানকার স্বার্থের সহিত তাহাদের নিজেদের স্বার্থকে মিশাইয়া ফেলা এবং এখানকার জনগণের সহিত একযােগে কাজ করা। নির্বাচন সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন যে, যত শীঘ্ৰ নিৰ্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে দেশের পক্ষে ততই মঙ্গল। নির্বাচনের জন্য ইতিমধ্যে প্ররােচনা শুরু হইয়া গিয়াছে। নির্বাচনের জন্য “আবার যাত্রাপাদ শুরু হইয়া গিয়াছে।” তিনি বলেন, জনাব দৌলতনা, কাইয়ুম খান সহ মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ মারিতে যুক্তনির্বাচনের স্বপক্ষে স্বাক্ষরদান করেন। বর্তমানে তাঁহারা তাহাদের কথায় বরখেলাপ করিতেছেন। স্বায়ত্বশাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও শতকরা পঞ্চাশ ভাগ অর্থ আদায়ের জন্য শেখ মুজিব “আমাদের নেতা জনাব সহীদ সােহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করার আহ্বান জানান। জনাব মুজিবর রহমান বলেন যে, সাধারণ নির্বাচনে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণার সুবিধার জন্য কৃত্রিম উপায়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা হইতেছে। তিনি অভিযােগ করেন যে, বড় বড় ব্যবসায়ীগণ বিপুল পরিমাণ জিনিষপত্র গুদামজাত করিয়া রাখিয়া দ্রব্যমূল্য স্বেচ্ছাকৃতভাবে বৃদ্ধি করিতেছে। প্রকৃতপক্ষে জিনিষপত্রের মূল্য বৃদ্ধি উক্ত বড় বড় ব্যবসায়ীদের কারসাজির ফল।
তিনি বলেন, জনাব সােহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভ করিলে পূৰ্ব্ব পাকিস্তানের সকল দাবী দাওয়া মিটিয়া যাইবে। জনাব সােহরওয়ার্দীর নিকট জাতিগত কোন ভেদাভেদের স্থান নাই। মুসলিম লীগের মত মােনাফেকী করিয়া তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে তাহার ন্যায্য পাওনা হইতে বঞ্চিত করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমির উন্নতি করিতে প্রয়াস পান না। মুসলিম লীগের মত তিনি জুলুম জানেন না। তাঁহার আমলে কাহার উপর অত্যাচার করা হয় নাই এবং বিনাবিচারে কাহাকেও গ্রেফতার করিয়া রাখা হয় নাই। জনাব সােহরওয়ার্দীর আমলে বিদেশে পাকিস্তানের মর্যাদা বৃদ্ধি পাইয়াছে। যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাইয়া জনাব সােহরওয়ার্দী বলিয়াছিলেন, “আমি আপনাদের নিকট ভিক্ষা গ্রহণ করিতে আসি নাই, আমি আসিয়াছি আপনাদিগকে ইসলামী গণতন্ত্র উপহার দিতে”।(তুমুল হর্ষধ্বনি)।
পরিশেষে শেখ মুজিবর রহমান দেশবাসীর উদ্দেশ্যে আগামী সাধারণ নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ গােষ্ঠীর মিথ্যা প্ররােচনায় বিভ্রান্ত না হইয়া আওয়ামী লীগকে ভােটদানের আহ্বান তিনি জানান। বলেন যে, আওয়ামী লীগ পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করিলে পূর্ব পাকিস্তানের সকল সমস্যার সমাধান হইবে।