দৈনিক ইত্তেফাক
১০ই নভেম্বর ১৯৫৭
শিল্প দফতরের প্রাদেশিকীকরণ তুরান্বিত করার জন্য ম্যান্ডেট দানের বিষয় বিবেচনা
প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী শেখ মুজিবের বিবৃতি
আই-সি-আই-এর সাহায্য সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ
স্টাফ রিপাের্টার
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (শনিবার) প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন,
‘ইহা খুবই মর্মান্তিক ব্যাপার যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার আই,সি,এর এক কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য সিমেন্ট, লৌহ, পেট্রল, চিনি প্রভৃতি আমদানী করার জন্য বরাদ্দ করিয়াছেন। পূর্বে উক্ত সাহায্য পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্দেশ্যে বিদেশ হইতে যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য বরাদ্দ করা হইয়াছিল।” জনাব রহমান বলেন, শাসনতন্ত্র অনুসারে শিল্প দফতর একটি প্রাদেশিক বিষয় বিধায় এ ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বনের জন্য প্রাদেশিক সরকারকে ম্যাণ্ডেট প্রদান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ গভীরভাবে বিবেচনা করিতেছে বলিয়া উল্লেখ করেন। কেন্দ্রে মুসলিম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম ও রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে অশুভ আঁতাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই মর্মে এক প্রেসনােট প্রকাশ করা হয় যে, তাহারা লাইসেন্স প্রদান সম্পর্কে তদন্ত করিতেছেন। কারণ, তাহারা লাইসেন্স প্রদান প্রসঙ্গে এরূপ সন্দেহ করেন যে, উহা রাজনৈতিক দলমত অনুসারে প্রদান করা হইয়াছে। কিন্তু বর্তমানে গােমর ফাক হইয়া পড়িয়াছে। ওয়াশিংটনে আই,সি-এর জনৈক মুখপাত্র সুস্পষ্টরূপে বলিয়াছেন যে, একটি মাত্র অভিযােগও প্রমাণিত হয় নাই। কিন্তু তবুও তাহারা পূর্ব পাকিস্তানে শিল্প গড়িয়া উঠিতে দিবেন না। কারণ, করাচীর স্বার্থবাদী মহল চিরকাল ধরিয়া পূর্ব পাকিস্তানে তাহাদের বাজার অক্ষুন্ন রাখিতে চাহেন। উহা হারাইবার আশংকায় তাঁহারা শঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছেন। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপন্ন পণ্যের অগ্নিমূল্য প্রদান করিতে করিতে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা প্রানন্তির হইয়া উঠিয়াছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ১৫ শত মাইলের দুরত্ব একটি ভৌগােলিক সত্য। ইহার জন্যই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলে সম্পূর্ণ পৃথক অর্থনীতি গড়িয়া তােলা সম্পূর্ণ অপরিহার্য। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তদুপরি করাচী-চক্র কখনও পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্প ক্ষেত্রে পুঁজি নিয়ােগ করিতে দেন নাই। নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তােলার জন্য নিজস্ব পরিকল্পনাসহ অগ্রসর হইয়া আসতে জনগণের প্রতি আহ্বান না জানাইয়া তাহারা বরাবরই তাঁহাদের নিজস্ব পার্টির লােকদিগকে শিল্প সংক্রান্ত ব্যাপারে পৃষ্ঠপােষকতা প্রদান করিয়াছেন। জনাব মুজিবুর রহমান বলেন, আমি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শিল্প সচিব পদে থাকাকালে শিল্প দফতর প্রাদেশিক সরকারের হাতে আনিতে সংগ্রাম করিয়াছি। আমাদের শাসনতন্ত্রেও অনুরূপ বিধান সুস্পষ্টরূপে উল্লেখ রহিয়াছে।
সে অনুসারে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শিল্প সচিবদের এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে অনুরূপ সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়। বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যে, তাহারা তাহাদের প্রিয়ভাজনদের মধ্যে পুনরায় লাইসেন্স প্রদান করিতে যাইতেছেন। তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই যে অবাঙ্গালী হইবে উহাতে কোন প্রকার সন্দেহই নাই। জনাব মুজিবুর রহমান বলেন, এই প্রথম বারের মত পূর্ব পাকিস্তানীরা দলমত নির্বিশেষে যােগ্যতা অনুসারে শিল্প লাইসেন্স লাভ করিয়াছিলেন। যদি প্রয়ােজন হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তান সরকার যে লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে সুবিচার করিয়াছেন, উহা প্রমাণের জন্য আমি লাইসেন্স প্রাপ্তদের নাম প্রকাশ করিব। প্রাদেশিক সরকারের সুপারিশে কেন্দ্রীয় শিল্প দফতর, আই, সি এর অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দফতর সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হইয়াছিল। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ১৯৫৮ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ঐ সকল শিল্প গড়িয়া তােলা যাইত। ইহার ফলে প্রায় ১ লক্ষ লােকের কর্মের সংস্থান হইত এবং ২ বৎসরের মধ্যে অবশ্যাম্ভাবীভাবে দ্রব্য মূল্য হ্রাস পাইত। তিনি বলেন, শিল্প লাইসেন্স প্রদানের ব্যাপারে তাঁহারা অব্যবস্থার যে অভিযােগ করিয়াছেন, উহা কি? পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পক্ষেত্রে আই, সি এর সাহায্য নিয়ােগ স্থগিত করার তাৎপর্য কি? তাঁহারা ঘােষণা করিয়াছেন যে, সরকারের রিজার্ভ ফান্ড হইতে শিল্পক্ষেত্রে ১ কোটি ডলার নিয়ােগ করা হইবে। ইহার সামগ্রিক অবস্থা কি দাঁড়ায়? পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পক্ষেত্রে পুঁজি নিয়ােগ হইতে বঞ্চিত করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ক্ষেত্রে করাচীর স্বার্থবাদী মহলের প্রাধান্য অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যেই কি ইহা করা হয় নাই? পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্যকে চিরস্থায়ী করার এবং পূর্ব পাকিস্তানকে উহার প্রয়ােজনীয় শিল্প সম্ভার হইতে বঞ্চিত করার ইহা কি একটি প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা নহে?
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, যেহেতু শাসনতন্ত্র অনুসারে শিল্প একটি প্রাদেশিক বিষয়, কাজেই এ ব্যাপারে সংগ্রাম করার উদ্দেশ্যে আইনের পথ অনুসরণের জন্য আমি প্রাদেশিক সরকারের নিকট আবেদন করিতেছি। এ সম্পর্কে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনের উদ্দেশ্যে ম্যান্ডেট প্রদান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ গভীরভাবে চিন্তা করিতেছে বলিয়াও তিনি উল্লেখ করেন।