দৈনিক ইত্তেফাক
৪ঠা নভেম্বর ১৯৫৭
শিল্প তথা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে পঙ্গু করার জন্য জঘন্য কারসাজি
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (রবিবার) সংবাদপত্রে এক বিবৃতিদান প্রসঙ্গে বলেনঃ
“পণ্য সাহায্য কাৰ্যসূচী অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানের বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে সাহায্য মঞ্জুর করে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরােধক্রমে উক্ত সাহায্য দান বন্ধ করা হইয়াছে বলিয়া পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঘােষণা করিয়াছেন,স্থানীয় সংবাদপত্রসমূহে এই মর্মে রিপাের্ট প্রকাশিত হইয়াছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার এই সাহায্য বণ্টন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার তদন্তের ব্যবস্থা করিতেছেন বলিয়াও রিপাের্টে উল্লেখ করা হইয়াছে।”
পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ ল্যাংলীর নাম উল্লেখ করা না হইলে স্বাভাবিক অবস্থায় উপরােক্ত রিপাের্ট বিশ্বাসযােগ্য নহে। একটি ক্ষুদ্র কোটারী গঠনের উদ্দেশ্যে গত দশ বৎসর যাবৎ গােটা দেশ এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে যেরূপ অধঃপতনের মুখে ঠেলিয়া দেওয়া হইয়াছে, বর্তমান প্রচেষ্টা উহারই পুনরাবৃত্তি এবং ইহা অতীতের সব কিছুকেই ছাপাইয়া গিয়াছে। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে বিমাতাসুলভ ব্যবহার প্রদর্শিত হইয়াছে এবং শিল্প ও অন্যান্য উন্নয়ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে তারতম্য করা হইয়াছে, তাহার ফলে পূর্ব পাকিস্তান বলাবাহুল্য, ভঙ্গুর হইয়া পড়িয়াছে। এ দুঃখজনক কাহিনী আজ সর্বজনবিদিত। সকল রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এমনকি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোটারীর মুখপাত্রগণ পর্যন্ত প্রকাশ্য বক্তৃতা-বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের এ দুঃসহ অবস্থার সত্যতা স্বীকার করিয়াছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প এবং অন্যান্য উন্নয়ন ক্ষেত্রে যে অসম অবস্থা বিদ্যমান রহিয়াছে, প্ল্যানিং বাের্ড ইহা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের এই অসম অবস্থার প্রতিবিধানের জন্য প্ল্যানিং বাের্ড উপযুক্ত পরামর্শ দান অথবা পথ বাতলাইতে অসামর্থের পরিচয় দিয়াছেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অতীতের কুখ্যাত মুসলিম লীগেরই ধ্বংসাবশেষ। গত ১৯৫৩ সাল হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক যখন জোর প্রতিবাদ উত্থাপিত হইতে থাকে, তখন মুসলিম লীগ অধ্যুষিত কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের ১৫০টি বৃহদাকার শিল্প ইউনিটের জন্য ৩৫ কোটি টাকা এবং সে স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের ৪৭টি অনুরূপ শিল্প ইউনিটের জন্য মাত্র ২কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে উপেক্ষা করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহদকায় শিল্প ছাড়াও হাজার হাজার ক্ষুদ্রকায় শিল্প গড়িয়া তােলার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদর্শিত হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠায় সাহায্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা পি, আই, ভি, সি কি পরিমাণ অর্থ বিনিয়ােগ করিয়াছে, তাহার উল্লেখ করিয়া আমি জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টি করিতে চাই না। এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়নে অর্থ বিনিয়ােগের চেয়ে বিদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তােলার জন্য অর্থ বিনিয়ােগ করা বেশী যুক্তিযুক্ত বলিয়া বােধ করেন। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের কাছে এই ঘটনা অজানা নয়। তাহারা ইহা জানেন, তবে নিজেরা জনসাধারণের প্রতিনিধি না হওয়ার দরুন রাষ্ট্রের বু-ি নয়াদধ্বংসী এই অশুভ চক্রের হাতের ক্রীড়ানক হইতে বাধ্য হইতেছেন। শাসনতন্ত্রের বিধানে পরিস্কারভাবে প্রদেশের হাতে স্ব স্ব শিল্প গঠনের ভার দেওয়ার নির্দেশ থাকিলেও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ দল ক্ষমতায় আসিয়া এই বিষয়ে কেন্দ্র ও প্রদেশের অধিকারের সীমানা নির্ধারন না করা পর্যন্ত এই অশুভচক্রটি শাসনতন্ত্রে এই বিলটী কার্যকরীকরণ বিলম্বিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে বেশী পরিমাণে শিল্প প্রতিষ্ঠা করিয়া দেশের উভয় অংশের শিল্পায়নে সমতা আনার জন্য ক্রমে ক্রমে এই অসমতা দূর করার সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিজেদের ঘৃণ্য ব্যবহারের সাফাই দেওয়ার জন্য এবং এই প্রদেশের শিল্পায়ন ব্যাহত করিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সবসময়ই বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের অজুহাত দেখাইয়াছেন এবং সরকারী কর্মচারীদের চক্রান্ত তাহার নিকট ফাস করিয়া দেয়। ইহার ফলে প্রাদেশিক সরকারকে ৭ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রদেশের সমুদয় পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে এই পরিকল্পনা পেশ করা প্রায় অসম্ভব হইলেও প্রাদেশিক সরকার উক্ত নির্দেশ পালন করেন।
আজাদী লাভের পর হইতে লােকচক্ষুর আড়ালে দেশের অর্থনীতির প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া গােপনে অনুগ্রহ বিতরণের যে রেওয়াজ চলিয়া আসিতেছিল তাহা ভঙ্গ করিয়া প্রাদেশিক সরকার বিভিন্ন প্রকার ৩৩ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য শিল্পপতিদের নিকট হইতে প্রকাশ্যভাবে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা কিংবা অর্জনের উপরও দেশীয় কাঁচামালের ভিত্তিতে স্থাপিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। দেশের প্রয়ােজন এবং আর্থিক সঙ্গতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া পরিকল্পনাগুলি পুংখানুপুংখ রূপে পরীক্ষা করা হয় এবং পরিক্ষান্তে উহা গ্রহণ করা হয়। কোন অঞ্চলের অধিবাসী কিংবা তাহার রাজনৈতিক মতবাদ কি সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন না তুলিয়া প্রার্থীর আর্থিক সচ্ছলতার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া প্রার্থী মনােনীত করা হয়।
ফলে বহু মুসলিম লীগের এক এ্যালটমেন্ট লাভ করে। রাজনৈতিক মতবাদ কখনও বিচার করা হয় নাই। আমি যে কোনও ব্যক্তিকে এই প্রদেশ হইতে লাইসেন্স প্রাপ্ত লােকদের নামের তালিকা পরীক্ষা চ্যালেঞ্জ দিতেছি। আমি দৃঢ়তার সহিত বলিতে পারি যে, গােড়া মুসলিম লীগ পন্থীরাও অর্থ বিনিয়ােগের সুযােগ হইতে বঞ্চিত হন নাই।