You dont have javascript enabled! Please enable it! 1957.11.06 | শেখ মুজিব কর্তৃক নয়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের সমালােচনা | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সংবাদ
৬ই নভেম্বর ১৯৫৭
শেখ মুজিব কর্তৃক নয়া কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের সমালােচনা

পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান গত রবিবার সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেনঃ
“পণ্য সাহায্য কাৰ্যসূচী অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানের বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে যে সাহায্য মঞ্জুর করে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের অনুরােধক্রমে উক্ত সাহায্য দান বন্ধ করা হইয়াছে বলিয়া পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ঘােষণা করিয়াছেন, স্থানীয় সংবাদপত্রসমুহে এই মর্মে রিপোের্ট প্রকাশিত হইয়াছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার এই সাহায্য বনটন সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার তদন্তের ব্যবস্থা করিতেছেন বলিয়াও রিপাের্টে উল্লেখ করা হইয়াছে।” পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি: ল্যাংলির নাম উল্লেখ করা না হইলে স্বাভাবিক অবস্থায় উপরােক্ত রিপাের্ট বিশ্বাসযােগ্য নহে। একটি ক্ষুদ্র কোটারী গঠনের উদ্দেশ্যে গত দশ বৎসর যাবৎ গােটা দেশ এবং বিশেষ ভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে যেরূপ অধ:পতনের মুখে ঠেলে দেওয়া হইয়েছে। বর্তমান প্রচেষ্টা উহারই পুনরাবৃত্তি এবং ইহা অতীতের সব কিছুকেই ছাপায়া গিয়াছে। বছরের পর বছর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে বিমাতাসুলভ ব্যবহার প্রদর্শিত হইয়াছে এবং শিল্প ও অন্যান্য উন্নয়ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে তারতম্য করা হইয়াছে। তাদের ফলে পূর্ব পাকিস্তান বলা বাহুল্য ভঙ্গুর হইয়া পড়িয়াছে। এ দুঃখজনক কাহীনী আজ সর্বজন বিদিত। সকল রাজনৈতিক দলের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এমনকি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোটারীর মুখপাত্রগণ পর্যন্ত প্রকাশ্য বক্তৃতা বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের এত:সহ অবস্থার সত্যতা স্বীকার করিয়াছেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প এবং অন্যান্য উন্নয়ন ক্ষেত্রে যে অসম অবস্থা বিদ্যামান রহিয়াছে, প্লানিং বাের্ড উহা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সমস্যা এবং পাকিস্তানের উভয় অংশের এই অসম অবস্থার প্রতিবিধানের জন্য প্লানিং বাের্ড উপযুক্ত পরামর্শ দান অথবা পথ বালাইতে অসামর্থের পরিচয় দিয়েছেন।
বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার অতীতের কুখ্যাত মুসলীম লীগেরই ধ্বংসাবশেষ। গত ১৯৫৪ সাল হইতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক যখন জোর প্রতিবাদ উপস্থাপিত হইতে থাকে তখন মুসলিম লীগ অধ্যুষিত কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের ১৫টি শিল্প ইউনিটের জন্য ৩৫ কোটি টাকা এবং সে স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের ৮৭ টি অনুরূপ শিল্প ইউনিটের জন্য মাত্র। ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানকে উপেক্ষা করিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহদকায় শিল্প ছাড়াও হাজার হাজার ক্ষুদ্রকায় শিল্প গড়িয়া তােলার ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্য ও সহযােগিতা প্রদর্শিত হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের বেসরকারী শিল্প প্রতিষ্ঠার সাহায্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারী সংস্থা পিআইবি সিকি পরিমান অর্থ বিনিয়ােগ করিয়াছে তাহার উল্লেখ করিয়া আমি জনমনে উত্তেজনা সৃষ্টি করিতে চাই না। এই প্রতিষ্ঠানটি পূর্ব পাকিস্তানের শিল্পায়নে অর্থ বিনিয়ােগের চেয়ে বিদেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তােলার জন্য অর্থ বিনিয়ােগ করা বেশী যুক্তিযুক্ত বলিয়া বােধ করেন। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকারের কাছে এই ঘটনা অজানা নয়। তাহারা ইহা জানেন, তবে নিজেরা জনসাধারণের প্রতিনিধি না হওয়ার দরুন রাষ্ট্রের বুনিয়াদধ্বংসী এই অশুভ চক্রের হাতের ক্রীড়নক হইতে বাধ্য হইতেছে না। শাসনতন্ত্রের বিধানে পরিস্কার ভাবে প্রদেশের হাতে স্ব স্ব শিল্প গঠনের ভার দেওয়ার নির্দেশ থাকলেও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ দল ক্ষমতায় আসিয়া সব বিষয়ে কেন্দ্রীয় প্রদেশের অধিকারের সীমানা নির্ধারণ না করা পর্যন্ত এক অশুভ চক্রটি শাসনতন্ত্রে এই বিলটি কার্যকর করণ বিলম্বিত করে। পূর্ব পাকিস্তানে বেশী পরিমাণ শিল্প প্রতিষ্ঠা করিয়া দেশের উভয় অংশের শিল্পায়নে সমতা আনার জন্য ক্রমে ক্রমে এই জনমত দূর করার সুস্পস্ট সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিজেদের ঘৃণ্য ব্যবহারের সাফাই দেওয়ার জন্য এবং দুই প্রদেশের শিল্পায়ন ব্যহত করিবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সব সময়ই বৈদেশিক মুদ্রার অভাবের। অজুহাত দেখাইয়াছেন। আই-সির বেসরকারী শিল্পোন্নয়নে ৫ কোটি টাকা মানের বৈদেশিক মুদ্রা সাহায্য করিবেন জানিতে পরিয়া সাধারণ মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়। স্বাভাবিকভাবেই সকলে আশা করেন যে, এই টাকার অধিকাংশই পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে ব্যয়িত হইবে, কিন্তু দুঃখের বিষয় করাচী চক্র দীর্ঘকাল ধরিয়া আইসি এর এই প্রস্তাব জনসাধারণের প্রতিনিধিদের এমন কি মন্ত্রীদের নিকট হতেও গােপন করে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মাত্র ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ করিয়া একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনাও পূর্ব হইতে বিদ্যামান পশ্চিম পাকিস্তানীদের কতিপয় পরিকল্পনার সহিত তাল রাখার জন্য গৃহীত হয়। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সরকার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গােচরীভূত করে এবং সরকারী কর্মচারীদের এই চক্রান্ত তাহার নিকট ফাঁস করিয়া দেয়। ইহার ফলে প্রাদেশিক সরকারকে ৭ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রদেশের সমস্ত পরিকল্পনা পেশ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে এই পরিকল্পনা পেশ করা প্রায় অসম্ভব হইলেও প্রাদেশিক সরকার উক্ত নির্দেশ পালন করেন।
আজাদী লাভের পর হইতে লােকচক্ষুর আড়ালে দেশের অর্থনীতির প্রতি লক্ষ্য না রাখিয়া গােপনে অনুগ্রহ বিতরণের যে রেওয়াজ চলিয়া আসিতেছিল তাহা ভঙ্গ করিয়া প্রাদেশিক সরকার বিভিন্ন প্রকার ৩০ ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য শিল্পপতিদের নিকট হইতে প্রকাশ্য ভাবে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। এই শিল্প প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা কিংবা অর্জনের উপরও দেশীয় কাঁচা মালের ভিত্তিতে স্থাপিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়।