সংবাদ
১২ই আগস্ট ১৯৫৭
কেএসপিকে লইয়া ক্ষয়িষ্ণু আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধির সকল চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত
একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বলিয়া কৃষক শ্রমিক পালামেন্টারী পার্টির দাবি
অবিলম্বে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহবানের প্রস্তাবঃ মন্ত্রী লীগ
মহলে নৈরাশ্যের কালােছায়া
স্টাফ রিপাের্টার
কৃষক শ্রমিক পার্টিকে কোয়ালিশনে সংযুক্ত করিয়া আওয়ামী লীগের শক্তি বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গতকল্য (রবিবার) ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইয়াছে। কে, এস, পি গতকল্যকার। সভায় কোয়ালিশনের প্রস্তাবকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। উক্ত পার্টির সভায় গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবে বলা হইয়াছে যে, কে, এস, পি পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিধায় প্রদেশে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোয়ালিশনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। কে, এস, পির সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের চরম ব্যর্থতায় আওয়ামী লীগ মহলে নৈরাশ্যের কালােছায়া নামিয়া আসিতেছে। ইহার ফলে আওয়ামী লীগ শক্তি বৃদ্ধির পরিবর্তে কোয়ালিশন সরকারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হইবার ফলে আওয়ামী লীগের যে শক্তি হ্রাস পাইয়াছে তাহা পুনরুদ্ধারের জন্য কিছুদিন যাবত কে, এস, পিকে কোয়ালিশনে গ্রহণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা করিতেছিল। জনাব আতাউর রহমান সম্প্রতি চট্টগ্রামে কে, এস, পির সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেন। নিজের ক্ষয়িষ্ণু পার্টির ম্রিয়মাণ সদস্যদের মনে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য আওয়ামী নেতৃবৃন্দ স্বল্পকাল যাবত কোয়ালিশনের নিয়মিত প্রচারকার্য চালাইয়া আসিতেছিলেন শুধু তাহাই নহে। প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমনও কোয়ালিশন গঠনের প্রস্তাবের মূলে। কারণ কেন্দ্রে ক্ষুদ্রতম দলের নেতা হিসাবে তাহার প্রধানমন্ত্রিত্বের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে রহিয়াছে।
কে, এস, পি-র গতকল্যকার পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় অপর এক প্রস্তাবে অবিলম্বে প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের দাবী জানান হইয়াছে। গত সন্ধ্যায় জনাব আবু হােসেন সরকারের সভাপতিত্বে পার্টির সভা বসে। ৪৪ মিনিট সভার কার্য চলার পর উপরােক্ত দুইটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রকাশ ডাঃ খান সাহেবের মারফত কে এস পি কোয়ালিশনে যােগদানের জন্য যে সময় শর্ত আরােপ করিয়াছেন, তাহা আওয়ামী লীগ পার্টি গ্রহণযােগ্য মনে করে নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ কোয়ালিশনে কে, এস, পি-কে যােগদানের গতকল্য পাঁচটার সময় আওয়ামী লীগের মতামত কে, এস, পি-কে জানান।
কিন্তু কে, এস, পি বর্তমান অবস্থায় অধিকাংশ সদস্যের মতামতের মূল্য দিয়া আওয়ামী লীগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তাহারা কে, এস, পি-কে পরিষদে “একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল” দল বলিয়া দাবী করেন। সেই জন্যই প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ কে, এস, পি’র হওয়া উচিত বলিয়া তাহারা মনে করেন। আগামী পরিষদ অধিবেশনেই দলগুলির প্রকৃত শক্তির পরিচয় পাওয়া যাইবে।
মুজিবরের প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবর রহমান কে-এস পি কর্তৃক কোয়ালিশনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হইবার পর বলেন যে, আওয়ামী লীগ কখনাে কে, এস, পির নিকট কোয়ালিশনের প্রস্তাব করেন নাই। কে এস পির সদস্যগণই কোয়ালিশনের কথা পাড়িয়া ছিলেন। তিনি আরও বলেন যে, কে, এস, পির অধিকাংশ সদস্যই দায়স্বরূপ-তাহারা সমপদ নহেন। তাঁহাদের কোন কোন নেতা বিনাশর্তে কোয়ালিশনের উদ্দেশ্যে জনাব সােহরাওয়ার্দীর নিকট করাচী পর্যন্ত গিয়াছিলেন। তাহার মতে আওয়ামী লীগ ষড়যন্ত্র বা তােষামােদ করিয়া কাজ বাগানােতে বিশ্বাস করে না।
আলােচনা অগ্রসর হইতেছে
গতকল্য (রবিবার) পরিষদ কমিটি রুমে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারী পার্টির এক সভা অনুষ্ঠিত হইয়াছে। চারি ঘণ্টাকালব্যাপী স্থানীয় উক্ত সভায় দলীয় নেতা আতাউর রহমানের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করা হয়। এবং কোয়ালিশন পার্লামেন্টারী পার্টির সভা অদ্য সকাল পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। অদ্যকার সভায়ও সােহরাওয়ার্দী যােগদান করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে। গতকল্য আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় প্রধানমন্ত্রী জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া তাহার বিদেশ ভ্রমণ এবং কেন্দ্র ও প্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা করেন। সভাশেষে সাংবাদিকগণ আওয়ামী লীগ কে, এস, পি কোয়ালিশন সম্পর্কে প্রশ্ন করিলে জনাব সােহরাওয়ার্দী কোন জওয়াব দিতে অস্বীকার করেন। সাংবাদিকগণ এই সম্পর্কে তাঁহাকে চাপ দিলে তিনি বলেন যে, আলােচনা অগ্রসর হইতেছে। সভাপতির নেতৃত্বে কতিপয় ভাড়াটিয়া ছাত্র ও গুণ্ডা হৈ চৈ করিতে করিতে মঞ্চের দিকে অগ্রসর হয়। যে কয়জন লােক মঞ্চের দিকে হাঙ্গামার জন্য অগ্রসর হয়, পুলিশের সংখ্যা ছিল তাহাদের অনেক বেশী। কিন্তু পুলিশ বাধাদানের পরিবর্তে গুণ্ডদলকে আলগাইয়া রাখে যাহাতে শ্রোতাবৃন্দ ও সভার উদ্যোক্তাদের হাত হইতে তাহারা রক্ষা পায়। কিন্তু পুলিশের সাহায্য সত্বেও গুণ্ডাদলের হামলা প্রতিরুদ্ধ হওয়া অবশেষে ময়দানের এক কোনায় দাঁড়াইয়া মঞ্চের দিকে তাহারা প্রস্তর নিক্ষেপ করিতে থাকে। জনাব অলি আহাদ এই সময়ে বক্তৃতা করিতেছিলেন। গুণ্ডাদের হামলা বারবার প্রতিরুদ্ধ হইতে দেখিয়া এস ডি ও রাস্তার উপর মােটর গাড়ীতে দাঁড়াইয়া মাইকযােগে কি যে ঘােষণা করিতে থাকেন। এমন সময় তিনি আসিয়া বলেন যে ১৪৪ ধারা জারী হইয়াছে, আপনারা সভার কাজ বন্ধ রাখুন। গুণ্ডামীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আস্থা প্রকাশক কয়েকটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ করিবার পর সভার কাজ সমাপ্ত ঘােষণা করা হয়। কিন্তু তখনও গুণ্ডার দল প্রস্তর নিক্ষেপ করিয়া চলে। আর অন্য দিকে পুলিশ নীরব দর্শকের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকে। পুলিশের হাবভাব দেখিয়া সকলের মনে হইতেছিল তাহারা যেন গুণ্ডার দলকে পাল্টা আক্রমণের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য তথায় রহিয়াছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় ধরিয়া এইরূপ চলিতে থাকে। ইতিমধ্যে আমি, মিসেস সেলিনা বানু এবং আরাে কয়েকজন প্রস্তরের আঘাতে আহত হই।
এমন সময় পাবনার এক কুখ্যাত গুণ্ডা ও দুষ্কৃতকারী, যাহার বিরুদ্ধে এখনও অনেকগুলি ফৌজদারী মামলা ঝুলিয়া রহিয়াছে এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির ভূত্য বলিয়া কথিত জনৈক ব্যক্তিকে মাতালবস্থায় মঞ্চের দিকে ছাড়িয়া দেওয়া হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছিল নেশার ঝেকে তাহাদের মাথায় খুন চাপিয়াছে। মঞ্চের উপর উঠিয়া অতিথিবর্গ ও সভার উদ্যোক্তাগণকে আক্রমণ করাই ছিল তাহাদের উদ্দেশ্য। পরে জানা গেল তাহাদের কোমরে ছােরা লুকানাে ছিল। মাতাল দুইজনকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশ খুব ভাল করিয়া চেনেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাহারা তাহাদিগকে গ্রেফতার তাে করেনই নাই উপরন্তু বারবার তাহাদিগকে রক্ষা করিয়া চলিতেছিলেন।
জনাব মাহমুদ আলী উপসংহারে বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী সরকার দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ধ্বংস করিবার প্রয়াস পাইতেছেন। তাহারা পাকিস্তানে ফ্যাসিজম চালু করিবার অপচেষ্টায় মাতিয়াছেন। কিন্তু জনাব সােহরাওয়ার্দীকে বলিয়া দিতে চাই যে, দেশে ফ্যাসিজমের উৎপত্তির দিন শেষ হইয়া গিয়াছে। দেশের জাগ্রত জনস্রোতের যুপকাষ্ঠে পাকিস্তানের ফ্যাসিস্ট শক্তির মৃত্যু আজ অবধারিত।