দৈনিক ইত্তেহাদ
৩০শে জুলাই ১৯৫৭
মওলানা ভাসানীর বিরুদ্ধে শেখ মুজিবরের বিষােদগার
সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে পরস্পর বিরােধী উক্তি
(ষ্টাফ রিপাের্টার)
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাদেশিক শিল্প ও বাণিজ্য সচিব শেখ মুজিবর রহমান গতকল্য (সােমবার) সেক্রেটারীয়েট ভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি বলেন যে, মওলানা সাহেব অনেক দিন হইতেই আওয়ামী লীগ পরিত্যাগের বিষয়ে বিবেচনা করিতে ছিলেন। এবং ইহার ভিতরে থাকিয়া আওয়ামী লীগের ক্ষতিসাধন করিতে ছিলেন।
এ সম্পর্কে জনৈক সাংবাদিক তাহাকে জিজ্ঞাসা করেন, মাওলানা সাহেবের এইরূপ কাৰ্যকলাপ সত্ত্বেও তাহার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নাই এবং গত কাউন্সিল অধিবেশনেও তাহাকে কি করিয়া পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করার জন্য বলা হইল। ইহার উত্তরে জনাব রহমান বলেন, মওলানা ভাসানী ব্যক্তিগতভাবে একজন সৎ লােক; কিন্তু তিনি মুষ্টিমেয় কয়েকটি লােকের কবলে পড়িয়াছেন এবং তাহাদের কবল হইতে তাহাকে উদ্ধার করাই ছিল গত কাউন্সিল অধিবেশনের উপরােক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ। এই সকল লােক ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে অর্থাৎ ৯২ ধারার সময় আওয়ামী লীগে যােগদান করিয়াছিলেন।
এই সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব সম্পাদক ও পার্লামেন্টারী পার্টির সেক্রেটারী জনাব মােহাম্মদ সােলায়মান এবং জনাব সােবহান এম, পি, এ, এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন। যে, ক্ষমতা অধিকারের জন্য কৃষক শ্রমিক পার্টি অন্য কোন দলের সহিত কোয়ালিশন করিবে না। নেতৃদ্বয় স্থানীয় কোন কোন পত্রিকায় প্রকাশিত কৃষক শ্রমিক পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন করিতে শেখ মুজিবর রহমানকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়। তিনি পূর্ব হইতে প্রস্তুত একটি লিখিত বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, কিছু সংখ্যক লােকের আওয়ামী লীগ পরিত্যাগের ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ “শক্তিশালী হইয়াছে।
তিনি আরও বলেন যে, যুবলীগ সম্পর্কিত প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া তাহারা এই সকল লােককে আওয়ামী লীগ হইতে অপসারণ করিতে চাহিয়াছিলেন। প্রকৃত আওয়ামী লীগ গণ প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়া যান নাই। তবে তিনি এক প্রশ্নের জওয়াবে বলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠানের জন্মের সহিত যাহারা ইহার সাথে জড়িত ছিলেন তাঁহাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন লােক আওয়ামী লীগ হইতে পদত্যাগ করিয়াছেন। আওয়ামী লীগ ২১ দফা কার্যসূচী এবং অন্যান্য প্রতিশ্রুতি পালন করে নাই বলিয়া মওলানা ভাসানী যে অভিযােগ করিয়াছেন শেখ মুজিবর রহমান তাহাকে বাজে ইর্ষামূলক ও উদ্দেশ্য প্রণােদিত বলিয়া মন্তব্য করেন। শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, মাওলানা ভাসানী জনাব সােহরাওয়ার্দীর বর্তমান পররাষ্ট্রনীতি সমালােচনা করিয়া থাকেন। শেখ মুজিবর রহমান আরও বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী সকল দেশের সহিত বন্ধুত্বহানি করিতে ইচ্ছুক এবং এই উদ্দেশ্যে চীনও সফর করিয়াছিলেন। মওলানা সাহেব বর্তমান পররাষ্ট্রনীতিকে জাতীয় পরিষদ কর্তৃক অনুমােদিত করিয়া লইতে বলিয়াছিলেন এবং জনাব সােহরাওয়ার্দীও তাহার কথামত জাতীয় পরিষদের অনুমােদন লইয়াছিলেন। ইহার পর কাগমারী আওয়ামী লীগ কাউন্সিলে মওলানা সাহেবের বৈদেশিক নীতি গৃহীত না হওয়ায় তিনি দল ত্যাগ করেন বলিয়া জনাব রহমান মন্তব্য করেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে, মন্ত্রী হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমান বিভিন্ন সামরিক চুক্তির তীব্র বিরােধিতা করিয়া থাকিতেন।
জনাব মুজিবর রহমান বলেন যে, আওয়ামী লীগ হইতে মাওলানা সাহেবের পদত্যাগ নিয়মতন্ত্র বহির্ভুত হইয়াছে। এই সময় জনৈক সাংবাদিক লণ্ডনে জনাব সােহরাওয়ার্দীর মন্তব্যের প্রতি তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী ব্যক্তিগতভাবে এই মত পােষণ করিতে পারে, কিন্তু তিনি (শেখ মুজিবর রহমান) পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবেই উপরােক্ত মন্তব্য করিয়াছেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলিয়াছিলেন যে, মওলানা সাহেব পদত্যাগ যুক্তিযুক্ত হইয়াছে, কারণ তিনি কাউন্সিলে তাহার প্রস্তাব অনুমােদন করাইতে পারেন নাই।
আর একটি বিষয়ে শেখ মুজিবর রহমান তাহার নেতা প্রধানমন্ত্রী জনাব সােহরাওয়ার্দীর মন্তব্যের সহিত অনেক ধরা পড়ে। তিনি বলেন যে, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নাই। ইহার জন্য তিনি পূর্ববর্তী সরকারসমূহকে দায়ী করেন। এই সময় একজন সাংবাদিক উল্যেখ করেন যে, নিউইয়র্কে জনাব সােহরাওয়ার্দী স্পষ্টভাবে ঘােষণা করিয়াছেন যে, পাকিস্তানী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিরাজমান রহিয়াছে। উহার সােজা জওয়াব দিয়া শেখ সাহেব বলেন যে, জনাব সােহরাওয়ার্দী আগামী সনের মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ এবং তিনি সকল প্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন।
সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক কনভেনশন এবং ইহার উদ্যোগে আয়ােজিত পল্টন ময়দান জনসভার উপর হামলা সম্পর্কে জনাব মুজিবর রহমানকে বহু প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়। তাঁহার লিখিত বিবৃতিতে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, পল্টন ময়দানের জনসভায় যে ঘটনা সংঘটিত হইয়া গিয়াছে তজ্জন্য মওলানা সাহেব এবং তাঁহার সমর্থকগণ আওয়ামী লীগকে দোষারােপ করিতেছে।
তিনি বলেন, “আমরা কখনই গুন্ডামী সমর্থন করিনা।” আওয়ামী লীগের ইহার সহিত কোন সম্পর্ক নাই বলিয়াও তিনি ঘােষণা করেন। তিনি আরও বলেন যে, প্রত্যেকেরই জনসভা করার অধিকার রহিয়াছে। সরকার সকলকেই পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়াছেন। তিনি গুণ্ডামির নিন্দা করিবেন কিনা সাংবাদিকগণ ইহা জিজ্ঞাসা করিলে তিনি শেষ পর্যন্ত ইহা এড়াইয়া যান। উপরােক্ত গুণ্ডামীর জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করা হইলে তিনি উহার সমর্থন করিবেন কিনা, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, ইহা একটি সাধারণ ঘটনা মাত্র। এবং এ সম্পর্কে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর সহিত যােগাযােগ করিতে অনুরােধ করেন। এক প্রশ্নের জওয়াবে তিনি বলেন যে, ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারী করার ব্যাপারে কোন মন্ত্রীর হাত ছিল না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং সাধারণ সম্পাদকের সহিত পরামর্শ না করিয়া মওলানা সাহেব কাগমারীতে বহু সংখ্যক বিদেশী এবং আওয়ামী লীগের সদস্য নহেন, এইরূপ বহু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। এই সম্পর্কে তাহার বক্তব্যের আরও বিশ্লেষণ করিতে বলা হইলে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, যদিও কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের স্তম্ভভূক্ত ছিল বা এবং মওলানা সাহেব ব্যক্তিগতভাবে ইহার আয়ােজন করিয়াছিলেন তবুও এই ব্যাপারে তাহাদের সহিত আলাপ করিলে ভাল হইত। তিনি তাহার বিবৃতিতে সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলীর উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগের সম্পাদক কর্তৃক আহূত এবং সেক্রেটারীয়েটের একটি কক্ষে অনুষ্ঠিত এই সাংবাদিক সম্মেলনে প্রচার বিভাগের ডিরেক্টর উপস্থিত ছিলেন। এবং প্রচার দফতরের ফটোগ্রাফার সম্মেলনের ছবি তােলেন।