সাপ্তাহিক সৈনিক
১২ই এপ্রিল ১৯৫৭
স্বায়ত্বশাসন ও আওয়ামী লীগ
সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে গৃহীত আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব লইয়া পাকিস্তানের উভয় অংশে তুমুল আলােড়ন সৃষ্টি হইয়াছে। প্রস্তাবটিতে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ এই মর্মে সুপারিশ করিয়াছে যে, প্রাদেশিক সরকার যেন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারকে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা এই তিনটি বিষয় ব্যতীত সমুদয় ক্ষমতা পূর্ব পাকিস্তান সরকারের হস্তে সমর্পণ করিতে অনুরােধ জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তানের উভয় অংশে, বিশেষ করিয়া পশ্চিম-পাকিস্তানে ইহার বিরাট প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়াছে। এই প্রস্তাব উত্থাপনের যখন মাত্র তােড়জোড় চলিতেছিল প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা এ ধরনের দাবী উত্থাপকদিগকে হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছিলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র উজির মীর গােলাম আলী খান তালপুর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার অনতিকাল পরেই এক বিবৃতিতে ইহাকে বিভেদসৃষ্টিকারী ও বিচ্ছিন্নমনােভাব প্রসূত বলিয়া অভিহিত করেন এবং এইসব প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। এমন কি আওয়ামী উজিরে আজম স্বয়ং জনাব সােহরাওয়ার্দীও এই প্রস্তাবকে ‘রাজনৈতিক ভাওতা’ বলিয়া অভিহিত করেন এবং জনসাধারণকে ইহার প্রতি অধিক গুরুত্ব না দিতে অনুরােধ করেন। জনাব তালপুরের বিবৃতির কড়া জবাব দেন কেন্দ্রীয় শ্রম উজির জনাব আবদুল খালেক ও প্রাদেশিক বাণিজ্য ও শিল্প উজির শেখ মুজিবর রহমান। প্রবীণ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান তালপুর সাহেবের উগ্রতার সমালােচনা করিয়াও প্রস্তাব উত্থাপকদের দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়াছেন। এদিকে জনাব সােহরাওয়ার্দী সাহেবের বিবৃতির প্রতিবাদ জানাইয়াছেন তাহারই দলের নেতৃবৃন্দ জনাব ভাসানী, জনাব আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবর রহমান। জনাব ভাসানী তাে পরিস্কার বলিয়াছেন ঃ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আওয়ামী লীগের অন্যতম মৌলিক দাবী, ইহার বিরােধিতা যিনিই করিবেন তাহাকেই প্রতিষ্ঠান হইতে বাহির হইয়া যাইতে হইবে। জনাব সােহরাওয়ার্দী তাঁর বিবৃতি দিয়াছেন ব্যক্তিগত দায়িত্বে ভাসানী সাহেব সেই সুযােগে জনাব সােহরাওয়ার্দীর আইন সচিব থাকাকালীন এমন একখানি পত্র সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়াছেন যাহাতে তিনি ২১ দফা ও যুক্তনির্বাচনের জন্য এক লিখিত প্রতিজ্ঞা দিয়াছিলেন এবং বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে কোন কোন মহল। যাহা দ্বারা সােহরাওয়ার্দীকে সহজেই বিশ্বাসভঙ্গকারী প্রমাণ করিতে হইবে। জনাব আতাউর রহমান খান অবশ্য অতখানি যান নাই। তিনি শুধু সােহরাওয়ার্দীর বিবৃতির সাথে তাঁহার দ্বিমতের উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে, স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব তাহারা “বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করিয়াছেন, নিছক তামাশার জন্য নহে।” শেখ মুজিবর রহমান করাচী পৌছিয়াই এক বিবৃতিতে স্বায়ত্তশাসন দাবীর বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার তীব্র সমালােচনা করেন। অতঃপর আওয়ামী রিপাবলিকান কোয়ালিশন পাটির সভায় যেদিন তিনি ও জনাব আবুল মনসুর আহমদ জনাব সােহরাওয়ার্দীকে স্বপক্ষে আনয়ন করিতে যাইয়া ব্যর্থ হন সেদিনও শেখ সাহেব এক দীর্ঘ বিবৃতিতে তাঁহাদের তিনদফা স্বায়ত্তশাসন দাবীর যৌক্তিকতা প্রদানের চেষ্টা করেন। জনাব সােহরাওয়ার্দী বলিয়াছিলেন- জনসাধারণ আজ চায় সৎ সরকার-স্বায়ত্তশাসন নয়। তাহার প্রতিবাদে জনাব মুজিবর রহমান বলিয়াছেনপাকিস্তানে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতীত সৎ সরকার সম্ভব নয়।
স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আজ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার মধ্যে, আওয়ামী রিপাবলিকান কোয়ালিশনের অন্তর্গত বিভিন্ন দলের মধ্যে, উভয় প্রদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে, এক কথায় সারাদেশেই আলােচনা-সমালােচনা চলিতেছে। পাকিস্তানে ফেডারেল ধরনের শাসন-কাঠামাে ও দুইটি প্রদেশের মধ্যে বিরাট ভৌগলিক ব্যবধান বিধায় স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে দেশের অধিকাংশ লােক একমত। বিশেষতঃ কেন্দ্রীয় রাজধানী হইতে বহু দূরে অবস্থিত ঘনবসতিপূর্ণ এই পূর্ব পাকিস্তান অতীতে জাতীয় অর্থনীতিতে তার ন্যায্য হিস্যা হইতে যে বৎসরের পর বৎসর বঞ্চিত হইয়াছে ইহাও কেহই অস্বীকার করিবেন না। এই বাস্তব পরিস্থিতির পটভূমিকায় পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ হইতে প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবী উঠা একান্ত স্বাভাবিক এবং সংগত। এই দাবীকে অতীতে বা বর্তমানে যাহারা বিচ্ছিন্নমনােভাব প্রসূত ও অনৈক্যসৃষ্টিকারী বলিয়া উড়াইয়া দিতে চান তাহারাও কোনক্রমেই। পাকিস্তানের বন্ধু নন। কারণ পাকিস্তানের অধিকাংশ জনতাকে পংগু রাখিয়া পাকিস্তানের প্রকৃত অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, স্বায়ত্তশাসনের নামে এমন সমস্ত শ্লোগান তােলা হইবে যাহার সাথে বাস্তবতার কোন সম্পর্ক থাকিবে না, যাহা প্রদেশের স্বার্থের নামে গােটা দেশে আনয়ন করিবে চরম বিশৃংখলা- যাহাতে শুধু দেশের দুষমনরাই খুশী হইতে পারিবে। স্বায়ত্তশাসনের নামে জনগণ অবশ্যই কেন্দ্রকে অচল করিয়া দেওয়ার কথা কোনদিন কল্পনা করেন না। অথচ আমাদের লাগাম ছাড়া শ্লোগান বিশারদদের কল্যাণে সেরূপ দাবীও মাঝেমাঝে উত্থিত হইতে দেখা যায়। দৃষ্টিান্তস্বরূপ বলা যায়, শুধু কারেন্সী, দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়কে কেন্দ্রের হাতে রাখিয়া বাকী সব বিষয় প্রদেশের হাতে আনয়নের তথাকথিত একুশ দফা-মার্কা একটি শ্লোগান আমাদের দেশে সম্প্রতি চালু আছে। এই শ্লোগান রচয়িতাদেরকে অনায়াসেই প্রশ্ন করা যায়- “আন্তঃআঞ্চলিক যােগাযােগ ব্যবস্থা” যদি কেন্দ্রের হাতে না দেয়া যায় তবে উভয় প্রদেশের মধ্যেকার বিভিন্ন প্রকারের যােগাযােগ ব্যবস্থার দায়িত্ব কাহার হাতে থাকিবে। শুধু তাই নয়সম্প্রতি এই তিন দফাওয়ালা স্বায়ত্তশাসনেরও আবার এক ‘উর্বর ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। তাহা হইল ঃ “বৈদেশিক” অর্থ শুধু রাজনৈতিক বিষয়, বৈদেশিক বাণিজ্য নয়; কারেন্সী অর্থ শুধু টাকশাল, অর্থাৎ শুধু নােট ছাপিবার অধিকার, অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নয় ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে সহজেই প্রশ্ন ওঠে ঃ কুটনৈতিক কার্যাদি চালনা, নােট ছাপানাে আর দেশরক্ষার যাবতীয় ব্যবস্থার অর্থের নিশ্চয়তা কেন্দ্র পাইবে কোথা হইতে? কারণ এইসব আজব ব্যাখ্যাদাতাগণ তাে বৈদেশিক বাণিজ্য সহ অর্থাগমের সমস্ত বিষয় প্রদেশের হাতে লইয়া আসিবেন। দেশরক্ষার মত একটি সুবিপুল খরচের বিষয় কেন্দ্রকে দেওয়া হইবে আর তাহার অর্থের ব্যয় সংকুলানের জন্য কেন্দ্রকে স্বাভাবিক এবং জরুরী প্রতি মুহূর্তে প্রদেশের “চাদার উপর নির্ভর করিতে হইবে। এমতাবস্থায় কখনাে কোন বহিঃরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানকে আক্রমণ করে আর কেন্দ্র। প্রদেশের “চাদার” বিলম্বে বহিরাক্রমণ প্রতিরােধে স্বীয় সৈন্য পরিচালনা বন্ধ রাখিতে বাধ্য হয় তখন যে অবস্থা সৃষ্টি হইবে তাহাতে স্বায়ত্তশাসনের এই পরিণতিতে খুশী হইবে আক্রমণকারী দেশ, পাকিস্তানী জনসাধারণ নয়। স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন আজ তাই খুব ধীরভাবে স্থির মস্তিস্কে চিন্তা করিয়া দেশ ও প্রদেশের স্বার্থের একটি সমন্বয় খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। বাচালের মত শুধু আবােল-তাবােল বকিলেই চলিবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর লােক যেমন পূর্ব পাকিস্তানের কোন দাবী উঠিলেই দেশপ্রেমের সােল এজেন্সী লইয়া তাহা প্রতিরােধের জন্য মরিয়া হইয়া ওঠেন, পূর্ব পাকিস্তানের এক শ্রেণীর প্রদেশ প্রেমের সােল এজেন্ট যেন সেইরূপ আবার প্রদেশপ্রেমের জোয়ারে দেশকেই ডুবাইয়া না ফেলেন। কারণ প্রদেশপ্রেমের এইসব সােল এজেন্টগণ পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় শােষক পুঁজিপতির অপকর্মকে সেখানকার জনগণের ঘাড়ে চাপাইয়া গােটা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যখন তখন যে বিদ্বেষাহ্নি ছড়াইয়া চলিয়েছেন তাহা অচিরে নির্বাপিত না হইলে একদিন গােটা পাকিস্তানকে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া ছারখার করিয়া দিতে পারে। আরও আশ্চর্য লাগে যখন দেখি এইসব প্রদেশপ্রেমিকগণ পুঁজিপতি বলিতেই বােঝেন শুধু আদমজী ইস্পাহানী ইত্যাদি। কিন্তু যে অসংখ্য ভারতীয় ও মাড়ােয়ারী ব্যবসায়ী, পুঁজিপতি ও মিলমালিক আমাদের প্রদেশের পাট ও অন্যান্য ব্যবসা শিল্পের সিংহের ভাগ লুট করিয়া প্রতি বৎসর কোটি কোটি টাকা ভারতে চালান দিতেছেন, যাহাদের প্রতিটি কোম্পানী ও কারবারের হেড কোয়ার্টার ভারতে অবস্থিত তাদের সম্বন্ধে এই অতি বিপ্লবী প্রদেশপ্রেমিকগণ আগাগােড়া নীরব থাকেন কেন, এ প্রশ্ন পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ অবশ্যই করিতে পারেন। যাই হােক আমরা চাই ঃ শ্লোগানের মােহ ত্যাগ করিয়া দেশের বাস্তব অবস্থাকে সামনে রাখিয়া সকলে এ ব্যাপারে একটা স্থির সিদ্ধান্তে আসুন।