সংবাদ
৯ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭
শেখ মুজিবর কর্তৃক কাউন্সিল সমক্ষে আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ঐতিহ্যের রিপাের্ট পেশ
গতকল্য (শুক্রবার) কাগমারীতে আওয়ামী লীগ কাউন্সিলের অধিবেশনে রিপাের্ট দান প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জনসেবার কাছে আওয়ামী লীগ দলের ঐতিহাসিক ভূমিকা বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন: আওয়ামী লীগের বিগত সাধারণ নির্বাচনের পর এটা কাউন্সিলের দ্বিতীয় অধিবেশন। এর পূর্বে আমরা বিগত ১৯শে ও ২০শে মে (১৯৫৬) তারিখে ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে সমবেত হই। সে আজ নয় মাসের কথা, ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘ নয় বৎসর ধরে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এককভাবে বিরােধী দলের কাজ করে আসছিল। বিরােধিতার জন্যই যে বিরােধিতা করে আসছিল, তা নয়। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনকে অনাচার, অত্যাচার, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি প্রভৃতির কলুষ-কালিমা মুক্ত করে তদস্থলে ন্যায়নীতি, সত্য এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে আসছিল আওয়ামী লীগ। এ সংগ্রামের নেতৃত্ব করেছেন পরম শ্রদ্ধেয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জনাব সােহরাওয়ার্দী। ভাইসব, আমাদের এ সংগ্রাম সহজ সংগ্রাম ছিল না, আমাদের অগ্রগতিকে বাধা দেওয়ার জন্য তল্কালীন মুসলিম লীগ দল, এমন কোন উপায় নেই যা অবলম্বন করেনি, এমন কোন অপবাদ নেই যা আমাদের উপর আরােপ করেনি। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানী কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের সভ্য ছিলেন। তিনি বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, মরহুম খাজা নাসেরল্লাহ, জনাব তােফাজ্জল আলী, ডাঃ মালেক, জনাব ফজলুল হক প্রভৃতিকে দিয়ে মুসলিম লীগকে জনসাধারণের প্রতিনিধি স্থানীয় করবাব চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু তদানীন্তন নাজেম মন্ত্রিসভায় তা সহ্য হলাে না। তারা জনাব খুররম খান পন্নী দ্বারা শ্রদ্ধেয় মওলানা সাহেবের নির্বাচনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করালেন। মাওলানা সাহেব মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করতে অস্বীকার করেন; ফলে নাজেম মন্ত্রিসভা জিতলেন। এসেম্বলিতে মওলানা ভাসানীর সমালােচনা থেকে তারা মুক্তি পেলেন। অন্য যাদের নাম করেছি তারা একে একে বিদেশ রাষ্ট্রদূত এবং বড় বড় পদ পেয়ে সন্তুষ্টচিত্তে বিদায় নিলেন। তারা বিরােধিতা করছিলেন সুবিধার জন্য, সুবিধা পেতেই তারা নিরস্ত হলেন। এতে পরিষ্কার প্রমাণিত হলাে, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতি বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, জনাব ফজলুল হক, তােফাজ্জল আলী, প্রভৃতি যে দরদ দেখিয়েছিলেন, তা শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য, দেশের দশের কোন হিতের জন্য নয়। পশ্চিম বাংলা তথা সমগ্র ভারতের মুসলমানদের জন্য চরম দুর্দিন। জনাব সােহরাওয়ার্দী তার পক্ষে যতদূর সম্ভব, ভারতীয় মুসলমানদের খেদমত ও সহায়তার জন্য তখনও কলকাতায়। তাদেরই রক্ষাৰ্থ ১৯৪৯ সালে জনাব সােহরাওয়ার্দী শান্তি মিশন নিয়ে ঢাকায় আসলে, নাজেম মন্ত্রিসভা জনাব সােহরাওয়ার্দীর পূর্ববঙ্গ সফরের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। তাঁর এলাসিন যাত্রাকালে, বাদামতলী স্টীমার ঘাটে তার উপর নাজেম মন্ত্রিসভার নিষেধাজ্ঞা জারী হয়। জনাব সােহরাওয়ার্দী, মিয়া ইফতিখারদ্দীন, মওলানা ভাসানী প্রভৃতি নেতার এক বৈঠক হয় ঢাকায়। একটি বিরােধীদল গঠন সম্বন্ধে আলােচনা হয়। সে আলােচনায় স্থির হয় যে মুসলিম লীগকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানরূপে গঠন করার একটি শেষ চেষ্টা করা হউক। … করা হয়। আমি অতি কষ্টে গ্রেফতার এড়িয়ে মওলানা সাহেবের নির্দেশে লাহােরে গমন করি।সেখানে আমি জনাব সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি এবং এক সাংবাদিক বৈঠকে মিলিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে তখন যে চণ্ডনীতি অনুসৃত হচ্ছিল, তা জানাই। পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত সংবাদপত্রে আমার সেই সাংবাদিক বৈঠকের বিবরণ ভালভাবে ছাপা হয়। সেখানে মুসলীম লীগের নীতি বিরােধী নেতাদের এক বৈঠক হয় এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ গঠিত হয়। প্রায় একমাস পশ্চিম পাকিস্তানে অতিবাহিত করে পূর্ধ্ব পাকিস্তানে ফিরে আসার পরে সঙ্গে সঙ্গে আমি গ্রেফতার হই। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক লীগ সরকার প্রবল দমন নীতি পরিচালনা করে আরও শত শত কর্মীকে গ্রেফতার করে।
জনাব সােহরাওয়ার্দী লীগ শাহী কর্তৃক অনুসৃত এই গণতন্ত্র বিরােধী কার্যকলাপের খবর পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন এবং মওলানা ভাসানী এবং আমাদের মুক্তির জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করেন। আমাদের সকলের গ্রেফতারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে তখন বিশেষ ত্রাসের সঞ্চার হয়েছিল। তাদের মধ্যে হতাশার লক্ষণও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। সকলেরই মনে এরূপ ধারণা জন্মে যে। লীগ শাহীর বিরুদ্ধে বুঝিবা কিছু করা সম্ভব নয়। ঠিক এসময়ে জনাব সােহরাওয়ার্দীর পূৰ্ব্ববঙ্গে আগমন এবং রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জনসাধারণের মনে সাহস সঞ্চার করে। জনাব সােহরাওয়ার্দী ব্যাপকভাবে পূর্ববঙ্গ সফর করতে থাকেন। সর্বত্র তার এ আন্দোলনের প্রতি বিপুল সাড়া পরিলক্ষিত হয়।
অসমাপ্ত