দৈনিক ইত্তেফাক
১৩ই জানুয়ারি ১৯৫৭
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টির দুষ্ট প্রয়াস
স্বার্থান্বেষী মহলের হীন প্রচারণার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুরের হুঁশিয়ারী
স্টাফ রিপাের্টার
গতকল্য (শনিবার)-পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম সচিব শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতি দান প্রসঙ্গে বলেন যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল ব্যাপক ও ক্ষতিকর প্রচারণা চালাইতেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে অনৈক্যের বীজ উপ্ত করা ইহাদের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
শেখ মুজিবুর রহমান মিথ্যার বেসাতিকারী এই মহলের মুখােশ উন্মােচন করিয়া বলেন যে, তাহাদের উদ্দেশ্য নিশ্চিত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইবে।
বিবৃতিতে তিনি বলেনঃ “পূর্ব পাকিস্তান এবং বিশেষ করিয়া বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রচার কার্য চালান হইতেছে, তদৃষ্টে আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি।
কিন্তু যে পটভূমিকায় এই ধরনের প্রচার অভিযান চালান হয়, তাহাতে এবং এই প্রচার কার্যের ভয়ঙ্কর পরিণতির কথা বিবেচনা করিলে উহার মত অদ্ভুত আর কিছুই নাই বলিতে হয়।
“বিগত নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য দফতরের উদ্যোগে করাচীতে কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের মিলিত সম্মেলনে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তাহাকে কেন্দ্র করিয়া একদফা প্রচারকার্য শুরু হয়। এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব হ্রাসের অসৎ উদ্দেশ্য লইয়া প্রচার করা হয় যে, উক্ত সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অনুমােদিত হইবে না। প্রত্যেক দেশপ্রেমিক পাকিস্তানীর চোখে। স্বার্থান্বেষী দলগুলির এই প্রচার কার্যের উদ্দেশ্য দিবালােকের মত স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। একদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে অনৈক্যের বীজ রােপণ এবং অপর দিকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করাই হইতেছে ইহার মূল উদ্দেশ্য। মিথ্যার বেসাতিকারী এই সকল প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারগণ নয়া শাসনতন্ত্রের বিধানসমূহ এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের শিল্প-বাণিজ্যের ব্যাপারে ন্যায়সঙ্গত সমন্বয় সাধনের প্রয়ােজনীয়তা সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করিয়াছেন। “প্রচার অভিযানের অপর দিক হইতেছে এই যে, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের মত এক শ্রেণীর লােকের ধর্মীয় নেতা তাহার শিষ্য সাগরেদদিগকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থ বিনিয়ােগ করিতে নিষেধ করিয়াছেন। “জনসাধারণ, বিশেষ করিয়া যে সকল লােক এখানে শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প পরিচালনা করিতেছেন, তাঁহাদের মনে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করাই হইতেছে এই স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানিজাত প্রচারকার্যের উদ্দেশ্য।” “এই প্রচার অভিযানের তৃতীয় পর্যায় ক্ষতিকর প্রচারণার পূর্ববর্তী রেকর্ড ভঙ্গ করিয়াছে। ইহাতে বলা হইয়াছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান ব্যাপক শ্রমিক সঙ্কটের ফলে শিল্পপতিগণ এই প্রদেশে তাহাদের অর্থ বিনিয়ােগ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করিতেছেন।”
“অন্যান্য কাল্পনিক প্রচারণার সাথে সাথে ইহাও বলা হইয়াছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে অফিস রহিয়াছে-এইরূপ বহু সংখ্যক কারখানার ম্যানেজারদিগকে তাহাদের মালিকগণ দেশের এই অংশে আপাততঃ নূতন করিয়া মূলধন নিয়ােগ না করার নির্দেশ দিয়াছেন। আমি এই সুযােগে বলিতে চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের ব্যাপারে আজ যেরূপ পরিবেশ বিদ্যমান, তদপেক্ষা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ আর কখনই ছিল না। কয়েকটি স্থানে শ্রমিক এবং মালিক পক্ষের মধ্যে বিরােধ দেখা দিয়াছিল একথা সত্য; কিন্তু শান্তিপূর্ণ উপায়ে সকল বিরােধের মীমাংসা করা হইয়াছে।” “শিল্প সম্পর্কিত বিষয় এবং শ্রমিক সংক্রান্ত ব্যাপারে সরকার সর্বদাই সজাগ দৃষ্টি রাখিতেছেন। সুতরাং কোন শিল্প এলাকায় যদি সামান্যতম গােলযােগ দেখা দেয়, তাহা হইলে এত আতঙ্কিত হইবার কারণ কি! পাশ্চাত্যের সর্বাপেক্ষা বিত্তশালী দেশেও শ্রমিকগণ সময় সময় অধিক বেতন ও সুযােগ-সুবিধা দাবী করিয়া থাকে। আমাদের দেশে শ্রমিকগণ মালিকদের নিকট হইতে ন্যায্য পাওনা লাভ করুক, ইহাই আমরা কামনা করি এবং আমার বিশ্বাস, মালিকগণ শ্রমিকদিগকে সন্তুষ্ট রাখার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন।”
“এই প্রসঙ্গে এ সত্য আমার স্বীকার করা উচিত যে, কয়েকদিন পূর্বে আমার করাচী সফরের সময় কতিপয় শিল্পপতি এই প্রদেশে শিল্পোন্নয়নের ব্যাপারে সহযােগিতার প্রস্তাব লইয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করেন। সম্ভবতঃ ইহাতে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে শিল্পপতিগণ অধিক উৎসাহ প্রদর্শন করায় যাহারা পূর্ব পাকিস্তানকে অধিকতর সুখী ও সমৃদ্ধিশালী দেখিতে চাহেন না, তাহারা হতাশ হইয়া এই আক্রমণাত্মক প্রচারণার আশ্রয় লইয়াছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তাহাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইবে।”
“বর্তমান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের নির্যাতিত জনসাধারণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের সংস্থান করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের অধিকতর ভাগ্যবান ভ্রাতাগণ যেখানেই থাকুন না কেন তাহারা আমাদের দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সংগ্রামকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তাহাদের অর্থ ও কারিগরি অভিজ্ঞতা লইয়া সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবেন।”