দৈনিক ইত্তেফাক
১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬
আওয়ামী লীগ ও পূর্ববর্তী মন্ত্রিসভার তুলনামূলক কার্যপদ্ধতি
পল্টন ময়দানের জনসভায় দুর্নীতি দমন মন্ত্রী শেখ মুজিবের বক্তৃতা
মন্ত্রী ও জনগণের মধ্যে ব্যবধানে চৌ…তু…য় দেওয়ার তাৎপর্য ব্যাখ্যা
গত শনিবার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও মওলানা ভাসানীর পূর্বে বক্তৃতা প্রসঙ্গে প্রাদেশিক শিল্প-বাণিজ্য-শ্রম ও দুর্নীতি দমন-মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও কর্মপদ্ধতি বিশ্লেষণ করিয়া তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ঘােষণা করেনঃ “পার্টির কাজ ব্যাহত হইতে পারে এই মনে করিয়া মন্ত্রিসভায় আসন গ্রহণের ইচ্ছা আমার এতটুকুও ছিল না; কিন্তু আমার নেতা জনাব সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নিদের্শই আমাকে মন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য করিয়াছে। তবে, আমি আপনাদিগকে এই আশ্বাস দিতেছি যে, মন্ত্রিসভায় আসন গ্রহণ করায় আমার উপর যে কর্তব্যের তাগিদ নামিয়া আসিয়াছে তদ্দরুন আমি আমার সংগ্রাম সাধনায় দ্বিগুণ উৎসাহই পাইয়াছি। আর এই কারণেই আমি স্বেচ্ছায় গণ-জীবনের নিকৃষ্টতম দুষ্টক্ষত দুর্নীতি দমনের দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করিয়াছি।” দুর্নীতি দমন মন্ত্রী আরও বলেন, “বিভাগীয় মন্ত্রী হিসাবে আমি আপনাদের এই আশ্বাসও দিতেছি যে, শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যে উকট দুর্নীতি আমাদের গণজীবনকে গ্রাস করিয়াছে, তাহার মূলােৎপাটন করিয়া সম্পদের সত্যিকার সদ্ব্যবহার সম্ভব কিনা, তাহারই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কঠিন ব্ৰত আমি বাছিয়া লইয়াছি। আপনাদের সাহায্য ও সহযােগিতা থাকিলে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারিব বলিয়া আমি বিশ্বাস করি।” জনাব রহমান বলেন, “শাসনযন্ত্র হইতে দুর্নীতির মূলােচ্ছেদ করিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমরা এ কথা জানি, মন্ত্রীরা যদি দুর্নীতি করেন, কর্মচারীরাও দুর্নীতি করিবে এবং আমরা দুর্নীতি না করিলে কেহ দুর্নীতির আশ্রয় নিতে সাহসী হইবে না। সকলের একথা স্মরণ রাখা দরকার, দুর্নীতিকে সমাজজীবন হইতে সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া ফেলিতে আমরা বদ্ধপরিকর।”
তিনি বলেন, “জনাব আবু হােসেনের মন্ত্রিত্বের আমলে খাদ্য বিভাগের কোন অস্তিত্ব ছিল বলিয়া মনে হয় না। আমরা মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর খাদ্য বিভাগের কোন হিসাবপত্র পাই নাই। তিনি ঘােষণা করেন যে, আমরা মন্ত্রিসভা গঠন করার পর করাচী গিয়া দ্রুত খাদ্য আমদানীর সর্বপ্রকার ব্যবস্থা করিয়াছি। আপনাদের একান্ত প্রিয় নেতা। জনাব সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ হইতে জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে খাদ্য আমদানীর ব্যবস্থা করিয়াছেন। অবিলম্বেই দেশের খাদ্যাভাব দূরীভূত হইবে বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি।” আওয়ামী লীগ সরকারের নীতি ও কর্মধারা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর বলেনঃ ‘জনসাধারণের প্রতি প্রদত্ত ওয়াদা পালনই আমাদের লক্ষ্য-পূর্ববর্তী মন্ত্রীদের ন্যায় ভাওতা দিয়া আরাম ও আয়াসে দিন গুজরান করাকে আমরা অন্তর দিয়া ঘৃণা করি। এই কারণেই ক্ষমতা গ্রহণের পরদিনই আমরা আওয়ামী লীগের মন্ত্রীবৃন্দ বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়াছি এবং মুক্তিদানের দিনে সশরীরে জেলখানায় গিয়া রাজবন্দীদিগকে আমরা অভিনন্দন জানাইয়াছি।” তিনি বলেনঃ “পর্বত প্রমাণ খাদ্য সংকটের মুখে দাঁড়াইয়া আমাদের এই লক্ষ্য অর্জনের কাজ সম্পাদনের জন্য প্রয়ােজন নিরবচ্ছিন্ন কর্ম সাধনার। তাই আমরা স্থির করিয়াছি, সকাল ১০টা হইতে বিকাল ৪টা পর্যন্ত আমরা যখন সরকারি দফতরে থাকি, তখন পূর্ববর্তী মন্ত্রীদের ন্যায় আসহাব, মােসাহেব ও ট্যাণ্ডলের দলে পরিবেষ্টিত হইয়া মন্ত্রীর কক্ষ গুলজার না কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছি। এ প্রচেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হইবার নয়। বুদ্ধি দিয়া, শক্তি জোগাইয়া আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। দেখি গণজীবনকে সমস্যা ও দুর্নীতিমুক্ত করিয়া দেশে স্বচ্ছ-সুন্দর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ গড়িয়া তােলা সম্ভব কি-না।”
উপসংহারে তিনি বলেন, শ্রদ্ধেয় নেতা ভাসানীর নির্দেশে ও আপনাদের সংগ্রাম সাধনার পরিণতি হিসাবে আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করিয়াছি। কর্তব্য সাধনে ব্যর্থ হইলে তাহারই নির্দেশে ও আপনাদের অঙ্গুলি সংকেতে মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করিয়া জনতার কাতারে শামিল হইতে আমরা ক্ষণেকের তরেও ইতস্ততঃ করিব না। বক্তৃতার প্রারম্ভে শেখ সাহেব তুমূল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেনঃ “মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর আমাদের বন্ধু-বান্ধব ও হিতাকাঙ্খী জনসাধারণের নিকট হতে অসংখ্য অভিনন্দন-বাণী আমরা পাইয়াছি। কিন্তু সে অভিনন্দনের যােগ্যপাত্র এখনাে আমরা নই বলিয়াই বিশ্বাস। তাই সে অভিনন্দন গ্রহণ করিব ও তার জবাব দিব আমরা কেবল সেই দিনই-যেদিন জনসাধারণের প্রদত্ত দায়িত্ব সার্থকভাবে পালন করিয়া অভিনন্দন প্রাপ্তির যােগ্য বলিয়া নিজেদেরকে আমরা দাবীও করিতে পারিব।”