You dont have javascript enabled! Please enable it! নিয়াজির দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
নিয়াজির দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ
================
লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার হিসেবে ঢাকায় আসেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরাে সময়টি তিনি এখানেই ছিলেন। জেনারেল নিয়াজি ১৯১৫ সালে পাঞ্জাবে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার হিসেবে ঢাকা আসেন। জেনারেল নিয়াজি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। যুদ্ধে পরাজয়ের কারণে ১৯৭৫ সালে তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে অপসারণ করা হয়। পাকিস্তান সরকার তার পদ, পদবি ও উপাধি সবই কেড়ে নেয়। ২০০৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে তিনি মারা যান। ১৯৯৮ সালে তিনি তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থন করে দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) বইটি রচনা করেন। এই বই থেকে তাঁর যুদ্ধে যােগ দেওয়া এবং প্রথম দিকের বর্ণনা নিচের রচনায় উল্লেখিত হয়েছে।
রাজনৈতিক সংকট কাটাতে যে সামরিক তরিকা বাতলানাে হলাে তাতে টেকসই সমাধান এল না। ইয়াকুবের [লে. জেনারেল শাহজাদা ইয়াকুব আলী খান ইস্টার্ন কমান্ডের আগের অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর] অসময়ােচিত পদত্যাগ এবং টিক্কা খানের [লে. জেনারেল, ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, পরে জেনারেল ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতা—এ দুটোই আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা ছিল। সে জন্য টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গ্যারিসন থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আমি তখন লাহােরে দশম ডিভিশনের
পৃষ্ঠা: ৭১
দায়িত্বে ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান আমাকে জিএইচকিউতে তলব করেন।
পরের দিন জিএইচকিউতে পৌঁছে আমি সরাসরি জেনারেল হামিদের কার্যালয়ে যাই। তিনি আমাকে বললেন, রাষ্ট্রপতি জেনারেল টিক্কা খানের সামরিক অভিযানের ধরন নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তিনি আরও জানালেন, বেশ কয়েকজন জেনারেলের কনিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও অতীতে যুদ্ধ ও সংকটকালে কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার পদে নিযুক্ত করেছেন।
চিফ অব আর্মি স্টাফের সঙ্গে সাক্ষাতের এক দিন পরেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল আমি ঢাকায় আসি। এই পরিবর্তনের কথা শুনে টিক্কা খান স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা হলাে, অভিযানের মাঝপথে অব্যাহতি পাওয়া একজন কমান্ডারের জন্য গভীরভাবে হতাশাজনক। দায়িত্ব হস্তান্তর না করতে টিক্কা খান সব চেষ্টাই করলেন। এমনকি আমাকে তিনি অধস্তন কমান্ডার বানানােরও প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু চিফ অব আর্মি স্টাফ কঠোরভাবে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বললেন, সুযােগ পেয়েও আপনি আনাড়ির মতাে সব ভুল করেছেন। তীব্র অনীহা নিয়ে তিনি ১০ এপ্রিল কমান্ড হস্তান্তর করলেন, অর্থাৎ আমি ঢাকায় আসার এক সপ্তাহ পরে।
১১ এপ্রিল সবকিছু পুনর্গঠন করা হলাে। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হলেন। একই সঙ্গে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক হলেন। তার মানে হলাে, বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক আইন। প্রয়ােগসহ সবকিছুর দায়িত্ব তার ওপর অর্পিত হলাে। সব গ্রেপ্তার, শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ড প্রদান তাঁর নির্দেশে করা হতাে। শফিক-উর-রেহমান ছিলেন। গভর্নরের মুখ্য সচিব আর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন। গভর্নরের সামরিক সচিব। এ ছাড়া ব্রিগেডিয়ার ফকির মুহাম্মদ ছিলেন সামরিক আইনের ব্রিগেডিয়ার, ব্রিগেডিয়ার জিলানি (পরবর্তীকালে লে. জেনারেল ও গভর্নর) ছিলেন আমার চিফ অব স্টাফ—তিনি ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রুসের স্থলাভিষিক্ত হন, নবম ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল শওকত রাজা, মেজর জেনারেল খাদিম রাজার জায়গায় ১৪ ডিভিশনের জিওসি হলেন মেজর জেনারেল রহিম, ১৬ ডিভিশনের জিওসি হলেন মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্, ব্রিগেডিয়ার নাসিরের জায়গায় সিভিল আর্মড ফোর্সের প্রধান হলেন মেজর জেনারেল জামশেদ; অন্যদিকে নৌ ও বিমানসেনার নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে রিয়ার অ্যাডমিরাল শরিফ ও এয়ার কমােডর ইনাম।
মাস্টার জেনারেল পাঠানাে হয়েছিল জেনারেল টিক্কা খানকে সহায়তা
পৃষ্ঠা: ৭২
করার উদ্দেশ্যে। জেনারেল মিঠঠা সেনাসংখ্যা বাড়ানাের অনুরােধ জানিয়ে জিএইচকিউতে নিম্নোক্ত বার্তা পাঠিয়েছিলেন :
‘অভিযান এখন গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে। দূরে যাওয়া বা ট্রেনে চড়ে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। ফেরি বা নৌকা নেই কোথাও। বস্তুত, অভিযান চালানাের ক্ষেত্রে বা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যাতায়াতই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ অবস্থা আরও কিছুদিন চলবে। সে জন্য সব ক্ষেত্রে সশস্ত্র বাহিনীর নিজস্ব সক্ষমতা গড়ে তােলা দরকার। আমার পরামর্শ হচ্ছে, নিম্নোক্ত বাহিনীগুলাে এখনই গঠন করে মােতায়েন করা দরকার। আলফা-চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য নৌবাহিনী থেকে পাের্ট অপারেটিং ব্যাটালিয়ন। ব্রাভাে—সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী বা ইঞ্জিনিয়ার বাহিনী থেকে নৌ পরিবহন ব্যাটালিয়ন ও রিভার মেরিন ব্যাটালিয়ন এবং সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা রেল অপারেটিং ব্যাটালিয়ন। চার্লি-নৌবাহিনী থেকে কার্গো ও ট্যাংকার ফ্লোটিলা, এই বাহিনী গঠনের জন্য জাহাজ প্রস্তুত থাকলেও ক্রু ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ লাগবে। সরঞ্জাম পরিবহন ও যাতায়াতের জন্য আরও হেলিকপ্টার প্রয়ােজন।’
কিন্তু হেলিকপ্টার ছাড়া আর কোনাে ইউনিট গঠন করা হয়নি। বাহিনী গঠন তাে দূরের কথা, পূর্ব পাকিস্তানে যে ইউনিটগুলাে যুদ্ধ করছিল, তাদের সহায়তায় নতুন সেনাও পাঠানাে হয়নি। সেনা প্রতিস্থাপনও করা হয়নি, যদিও সেনা কর্তৃপক্ষ সবকিছুরই অঙ্গীকার করেছিল।
আমি পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পর জেনারেল মিঠঠাকে জিএইচকিউতে পাঠানাে হয়। তবে টিক্কা খান সামরিক কমান্ডারের সরকারি বাসভবন ছাড়েননি। মেজর জেনারেল গুল হাসান তখন ঢাকায় ছিলেন। শেষমেশ তিনি টিক্কা খানকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউস ত্যাগ করে গভর্নমেন্ট হাউসে যেতে রাজি করান।
জেনারেল টিক্কা অদক্ষতা ও শত্রুর বিরুদ্ধে সাহস না দেখাতে পারার অজুহাতে ব্রিগেডিয়ার রহিম দুররানি, ব্রিগেডিয়ার জুলফিকার, ব্রিগেডিয়ার খুশি মােহাম্মাদ খালেদ ও লে. কর্নেল শাফকাত বালুচকে সৈনিকের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে আমার কমান্ডে থাকাকালে ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল রহিমের সুপারিশে ব্রিগেডিয়ার আরবাবকে চুরি ও লুটপাটের অভিযােগে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তে এসব অভিযােগ সত্য প্রমাণিত হলে কোর্ট মার্শালের জন্য তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
জিলানি কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন এবং তাঁর দায়িত্বকালে তিনি আমার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই পূর্ব
পৃষ্ঠা: ৭৩
পাকিস্তানে ছিলেন। তাঁকে আইএসআই ডিরেক্টরেটে মহাপরিচালক হিসেবে। বদলি করা হয়। তার পরিবর্তে নিয়ে আসা হয় ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীকে, যাকে আমি আগে চিনতাম না। তিনি শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তানের পারিপার্শিক অবস্থা, স্থানীয় পরিস্থিতি, আবহাওয়া—কোনাে কিছুই আমার জন্য নতুন ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাঁচি ও টেকনাফে আমি জঙ্গল যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। সেই প্রশিক্ষণের ভিত্তিতে আমি বার্মা, সিঙ্গাপুর, মালয়া (মালয়েশিয়া) ও ডাচ্-ইস্ট ইন্ডিজে (এখন ইন্দোনেশিয়া) যুদ্ধ করেছি। এসব জায়গার জলবায়ু ও ভূমির গঠন অনেকটা পূর্ব পাকিস্তানের মতােই। অন্যদিকে দেশভাগের পর আমি ঢাকায় ১/১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলাম। ঢাকা সেনানিবাসে আমার নামে একটা সড়কের নামকরণ করা হয়েছিল টাইগার রােড। তাই পূর্ব পাকিস্তানে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বােধ করছিলাম। তা দায়িত্ব নেওয়ার পর দেখলাম, প্রাদেশিক সরকার ঠিকঠাক কাজ করছিল না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও প্রশাসন স্থানীয় জনগণ আর বাঙালি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানকে ঘৃণা করত। তারা যেন আমাদের সহায়তা না করার পণ করেছিল। ফলে নিজ দেশে আমরা অনাকাঙ্ক্ষিত বিদেশি হয়ে গেলাম। বাজারঘাট সব একরকম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জীবনযাত্রায় স্থবিরতা নেমে আসে। উর্দুভাষী মানুষদের ঢাকা বিমানবন্দরে থামিয়ে ঘিরে ধরা হতাে। সেনাদের জন্য নিয়মিত সরবরাহ ব্যবস্থাই ছিল না। ব্যাপারটা হলাে, পুরাে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশই যেন বিদ্রোহ ঘােষণা করে বসেছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেনানিবাস ও শিবিরগুলাে ঘিরে যুদ্ধ করছিল, এগুলাে তাদের শক্তিশালী দুর্গ হয়ে উঠেছিল। তারা শুধু আকাশপথে ঢাকা ও পরস্পরের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারত। এ ছাড়া যােগাযােগের অন্য সব পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অথবা ব্যবহারের অনুপযােগী হয়ে গিয়েছিল। দেশের বাকি অংশ মুক্তিবাহিনীর অধীনে চলে গিয়েছিল। মুক্তিবাহিনীর নৈতিক বল ছিল আকাশছোঁয়া এবং তারা বেশ উদ্যমীও ছিল। নদীবিধৌত পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ ফেরিঘাট ও ফেরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আর পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল, আন্তর্জাতিক সীমান্ত বলে কোনাে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। ভারত থেকে বিপুলসংখ্যক হিন্দু জনগােষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। প্রদেশের রাজধানী ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ঢাকা সন্ত্রাসী ও দুবৃত্তে ভরে গিয়েছিল। গােয়েন্দাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছিল এবং কোনাে বিষয়েই তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। বৈশ্বিক গণমাধ্যমও আমাদের বিরুদ্ধে
পৃষ্ঠা: ৭৪
ছিল। তারা প্রতিনিয়িত আমাদের বিরুদ্ধে বানানাে আর বিকৃত সংবাদ ছাপাত। তবে সরকার এসব অপপ্রচারের জবাব দিত না। সেনারা বড় বড় দলে বিভক্ত হয়ে ঘুরত, তাঁরা একা একা বা ছােট দলে ঘুরলে অতর্কিত আক্রমণের শিকার হতাে।
যুদ্ধক্ষেত্রে তাে সবাই মৃত্যুকে কাঁধে নিয়ে ঘােরে, তাই সে সময় সবাই খােদাভীরু ও পূতপবিত্র হয়ে যায়। সেনাদের এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে তাঁরা যেন সংশ্লিষ্ট অধিনায়কের অধীনে প্লাটুন (৩৬ জন) ও কোম্পানিতে (১২০ জন) বিভক্ত হয়ে থাকে। ফলে সেনাদের বিরুদ্ধে সাধারণত যে ধরনের অভিযােগ উঠেছিল, সেসব কাজে জড়িয়ে পড়ার সাহস কারও দেখানাের কথা নয়। কেউ যদি একা একা বেরিয়ে পড়ত, তাহলে সে খুন হয়ে যেত। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সেনাবাহিনী, সমাজ, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে এক ধরনের বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছিল। সব জায়গাতেই কেবল বিভ্রান্তি আর বিভ্রান্তি বিরাজ করছিল।
আমাদের সামনে তখন অনেক দুর্দম সমস্যা। কোনাে কিছুই সহজে হচ্ছে। দুটি ব্যাপার একদম পরিষ্কার ছিল : প্রথমত, যেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম, সেসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেতে আমাদের একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করতে হবে। বস্তুত, এটি হবে পূর্ব পাকিস্তান বিজয়ের পরিকল্পনা। দ্বিতীয়ত, এটি নিয়মতান্ত্রিক অভিযান হবে না। টিকে থাকার জন্য সেটি হবে এক নির্মম লড়াই।
আমার হাতে ছিল মাত্র তিনটি খর্ব শক্তির ও অপ্রতুল সরঞ্জামে সজ্জিত ডিভিশন। দুটি ডিভিশন বিমানে আসায় তারা সঙ্গে করে কামান, গােলন্দাজ বাহিনীর সরঞ্জাম, প্রকৗশল সরঞ্জাম, সেতু ও যাতায়াত সরঞ্জাম, মাইন, কাঁটাতার—এসব আনতে পারেনি। যুদ্ধ করার মতাে সেনা ছিল মাত্র ৪৫ হাজার-সেনা বাহিনীর ৩৪ হাজার, আর এর সঙ্গে ছিল সিএএফ, পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক পুলিশ ও সশস্ত্র অযােদ্ধা সেনা ১১ হাজার। এই ৩৪ হাজার নিয়মিত সেনার মধ্যে আবার ১১ হাজার ছিল আর্মার, গােলন্দাজ, প্রকৌশল, সিগন্যাল ও আর্টিলারি সেনা। ২৩ হাজার ছিল পদাতিক বাহিনী। সম্মুখের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিখাগুলাে পাহাড়া দেওয়া এবং সরাসরি হামলা চালানাের মতাে সক্ষমতা কেবল এদেরই ছিল। খুব বেশি হলে যুদ্ধে আমার পক্ষে ৪০ হাজার বেয়নেটধারী সেনা নামানাে সম্ভব ছিল। এদের মধ্যে অনেকেই আবার যুদ্ধের জন্য যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ছিল না, তাদের হাতিয়ারও পর্যাপ্ত ছিল না। ভারতীয়দের ধোকা দিতে আমি এই খবর চাউর করে দিলাম যে আমার অধীনে চারটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন আছে। তারাও নিজেদের গােয়েন্দা ব্যর্থতা ঢাকতে এই লক্ষাধিক সেনার খবর বারবার চর্বিত-
পৃষ্ঠা: ৭৫
চর্বণ করতে থাকল এবং সুবিধাভােগীদের বলল, যেখানে আছেন, সেখানেই থাকুন, আগে বাড়বেন না।
বিমান সহায়তা ছাড়া কোনাে সেনাবাহিনী এই যুগে যুদ্ধ করতে পারে না। অথচ আমার ছিল এক স্কোয়াড্রন পুরােনাে যুদ্ধবিমান ও একটি বিমানঘাঁটি, ছিল না কোনাে রাডার ব্যবস্থা। উপকূলীয় এলাকা ও বিশাল বিশাল নদী পাহারা দেওয়ার জন্য ছিল মাত্র চারটি সশস্ত্র নৌযান, যদিও এই বিশাল বিশাল নদী পাহারা দেওয়ার জন্য দরকার ছিল যুদ্ধজাহাজ। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ চালানাের মতাে অস্ত্র বা প্রশিক্ষণ আমার ডিভিশনের ছিল না। ট্যাংক, আর্টিলারি, বিমান ও ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রের প্রচুর অভাব ছিল আমার। আবার গােলন্দাজ বাহিনীকে উপদেশ দেওয়ার মতাে মানুষেরও অভাব ছিল বাহিনীতে।
আর্টিলারিতে চারজন ব্রিগেডিয়ার থাকার কথা থাকলেও ছিল মাত্র একজন। ব্যাটালিয়নগুলাের সঙ্গেও আর্টিলারি উপদেষ্টা ছিল না। ব্রিগেড ও ডিভিশনের সঙ্গে ছিল কনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা। সে কারণে একজন ব্রিগেডিয়ারকে পুরাে পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে আর্টিলারি বাহিনীর সমর্থন জোগাতে হয়েছে। আমার কামানের গােলা সর্বোচ্চ ১১ হাজার গজ দূরত্বে ফায়ার করা সম্ভব ছিল, যেখানে শত্রুর ১৩০ এমএম গুলির সীমা ছিল ৩০ হাজার গজ। সাহায্যকারী অস্ত্রপাতির অভাব ছিল, অন্যদিকে আমার ছােট অস্ত্রগুলাে ছিল জার্মান, ব্রিটিশ, মার্কিন ও চীনের তৈরি। এগুলাে আবার একেকটি ছিল একেক ক্যালিবারের। এতে গুলি সরবরাহ ও এক ইউনিট থেকে আরেক ইউনিটে স্থানান্তরে সমস্যা হতাে। এগুলাে খুব ছােটখাটো বা তাৎপর্যহীন ব্যাপার মনে হলেও খুবই সতর্ক সমন্বয়ের প্রয়ােজন হতাে, কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে অদ্ভুত অনেক কিছু ঘটে থাকে। » আমার তিনটি মাঝারি ট্যাংক রেজিমেন্ট ও একটি হালকা ট্যাংক রেজিমেন্টের প্রাধিকার ছিল। বাস্তবে আমার অধীন ছিল এম২৪ হালকা সাফি ট্যাংকের একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট ও একটি স্কোয়াড্রন। এটি ১৯৪৪ সালের তৈরি এবং কোরিয়ায় প্রথম ব্যবহার করা হয়। আর এর কামান ছিল ৭৫ এমএমবিশিষ্ট যা ভারতের আধুনিক ট্যাংকের বিপরীতে একেবারেই অকার্যকর ছিল। কিছু ট্যাংকে আবার ফ্যান বেল্টের জায়গায় রশি ব্যবহার করা হয়েছিল। আবার কিছু কিছু ট্যাংক চালু করার জন্য ধাক্কা দিতে হতাে। আমার চারটি মাঝারি ও একটি ভারী আর্টিলারি রেজিমেন্টের প্রাধিকার ছিল। কিন্তু আমার কাছে একটিও ভারী বা মাঝারি কামান ছিল না। আর ফিল্ডগান যতগুলাে থাকার কথা, ছিল তার অর্ধেক।
সেনাদের স্বাস্থ্য রক্ষা করাও ছিল এক বড় সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের আবহাওয়া অত্যন্ত আর্দ্র, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা এতে হাঁপিয়ে উঠত।
পৃষ্ঠা: ৭৬
সেখানকার স্যাতসেঁতে আবহাওয়ায় সেনাদের পায়ে ফাঙ্গাসসহ নানা ধরনের ঘা হতাে। হাসপাতালও ছিল হাতে গােনা, অভাব ছিল ওষুধ ও চিকিৎসকের, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের। প্রয়ােজনীয় উপকরণ ও রসদের অভাবে মেডিকেল ইউনিটগুলাে কাজ করার পরিস্থিতিতে ছিল না। হতাহতদের সরিয়ে নেওয়ার মতাে সন্তোষজনক আয়ােজন ছিল না। অনেকেই পথে মারা পড়ত, অনেকেই আবার প্রয়ােজনীয় চিকিৎসার অভাবে পঙ্গু হয়ে যেত। আহতদের ফার্স্ট ফিল্ড ড্রেসিংও পর্যাপ্ত ছিল না, যদিও প্রতিটি সেনার কাছে তা একটি করে থাকার কথা এবং শতভাগ রিজার্ভ রাখার কথা। বােমার আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতের ড্রেসিং করার মতাে মরফিয়া ইনজেকশনও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না। আমাদের শতকরা সত্তর ভাগ পােশাক ও জুতার ঘাটতি ছিল। সে কারণে ঘেঁড়া-ফাটা বুট ও কাপড় বদলি করার মতাে কিছু ছিল না। আমার সেনারা ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের শুষ্ক অঞ্চলের। অনেকেই জীবনে বড় নদী দেখেনি এবং তারা এও জানত না, নাভির চেয়ে বেশি উচ্চতার পানিতে কীভাবে হাঁটা যায়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাঁচ-ছয় মাইল অন্তর নদী বা খাল-বিল আছে। আর বড় নদীগুলাে তাে আমাদের কাছে সাগরের মতাে। তাই তাদের অভিযানের মধ্য দিয়েই সাঁতার, নৌকা চালানাে, পানির মধ্য দিয়ে হাঁটা সবকিছুই শিখতে হয়েছে। এসব কারণে আমাদের চলাচল ব্যাহত হয়েছে, বিশেষ করে বর্ষাকালে।
যুদ্ধের মধ্যে যুদ্ধবহির্ভূত কিছু ব্যাপার আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় : মশা, ম্যালেরিয়া, বিপজ্জনক জোক, বিছানার ছারপােকা প্রভৃতি। আর্দ্র আবহাওয়ায় এসব পােকামাকড়ের জন্ম হয়। বর্ষাকাল কয়েক মাসব্যাপী স্থায়ী হয়। আর সে সময় পুরাে গ্রামাঞ্চল সাগরের রূপ নেয়। যানবাহন বলতে তখন এক নৌকা ছাড়া কিছু ব্যবহার করা যায় না। এসব কিছু আমাদের সেনাদের বড় রকম চাপে ফেলে।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব পালন করতে আসি আমি। সেই দায়িত্বটা হলাে, পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে বাঙালিদের সরকার। গঠন করতে না দেওয়া, গেরিলাদের হটানাে ও ভারতীয় আগ্রাসন ঠেকানাে। ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম : আমাকে এক পালভাঙা ও দিগ্ভ্রান্ত জাহাজের নাবিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যে জাহাজ নিয়ে আমাকে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে। পথে আবার বাতিঘরও নেই। আমার কাজ ও লক্ষ্য সম্পর্কে। লিখিত নির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। ব্রিগেডিয়ার চৌধুরী সেপ্টেম্বর ১৯৫৭: বিফোর অ্যান্ড আফটার গ্রন্থে লিখেছেন :
‘জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সভাসদেরা পুরাে ব্যাপারটা এত হালকাভাবে দেখেছেন যে লে. জেনারেল নিয়াজিকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়ারও
পৃষ্ঠা: ৭৭
প্রয়ােজনীয়তা তাঁরা বােধ করেননি। আমার মনে হয়েছে যে তারা এই ব্যাপারটা ইচ্ছা করে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঠেকিয়ে রাখা যাবে না এবং সে কারণে নিজ দায়ভার এড়াতে পুরাে ব্যাপারটা তিনি লে. জেনারেল নিয়াজির ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
ঘাটতি, সমস্যা ও বাধার মধ্যে আমাদের আবার কিছু সুবিধাও ছিল। সেনাবাহিনী অধিনায়কত্ব করার বিপুল অভিজ্ঞতা ছিল আমার। আমার অধীনের সেনাবাহিনী সম্ভবত বিশ্বের সেরা ছিল। আমরা নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিলাম, বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের সেনাবাহিনীত ভর্তি করা হয়নি, ছিল যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা। আমার অধীনের অধিকাংশ ইউনিট পাকিস্তানের সব যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সেনা আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। যুদ্ধ ও শান্তি—উভয় পরিস্থিতিতেই তারা বিপুলভাবে অভিজ্ঞ ছিল। লে. কর্নেল থেকে শুরু করে ওপরের সব কর্মকর্তাকে আমি চিনতাম, অনেক জেসিও আর এনসিওকেও চিনতাম।
এর বিপরীতে বাঙালিদের ব্রিটিশরা যােদ্ধা জাতি মনে করত না। বাঙালিদের সামরিক ঐতিহ্য বা যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা ছিল না। ব্রিটিশভারতীয় সেনাবাহিনীতে তারা ছিলই না, সুনির্দিষ্টভাবে বললে, সশস্ত্র যুদ্ধে তাদের নেওয়া হতাে না। আর এই যুদ্ধে তারা সুসংবদ্ধ দল ছিল না, বরং তারা নানা দল বা ইউনিটে বিভক্ত ছিল। তাদের কমান্ডার কর্নেল ওসমানী ঠিক এ রকম প্রকৃতির মানুষ ছিলেন যে তাঁকে দেখলে অধীনদের মনে আত্মবিশ্বাস জন্মাত। তিনি মূলত আরআইএএসসি-এর (রয়্যাল ইন্ডিয়ান আর্মি সার্ভিস কোরের) সদস্য ছিলেন। দেশ বিভাগের পর তাঁকে পদাতিক বাহিনীতে বদলি করা হয়। তাঁর অফিসের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদলের অধিনায়কত্ব করার অভিজ্ঞতা ছিল না। চাকরিতে তিনি আমার জ্যেষ্ঠ ছিলেন। রাওয়ালপিন্ডিতে আমাকে ফোন করলে অপর প্রান্ত থেকে তিনি বলতেন, ‘টাইগার, সিনিয়র টাইগার বলছি। বেঙ্গল রেজিমেন্টে তিনি জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর রেজিমেন্টাল ব্যাজ ছিল টাইগার। যাহােক, কর্নেল ওসমানী ও বাঙালিদের আমাদের মতাে সুশৃঙ্খল ও অভিজ্ঞ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে থাকার কথা নয়।
বাঙালিরা সংখ্যায় আমাদের চেয়ে বেশি হলেও তাদের বিরুদ্ধে আমরা জিতব, সে ব্যাপারে আমি ইতিবাচক ছিলাম। যদিও বাঙালিদের সঙ্গে ছিল ভারতীয়দের আর্থিক, নৈতিক ও ভৌগােলিক সমর্থন, আর ছিল রুশদের। প্রশিক্ষণ। ভারতীয়রা সেখানে ইউনিটসহ ছিল না তা ঠিক, কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন স্তরের সেনারা বিশেষ বিশেষ কাজে নিযুক্ত ছিল; যেমন,
পৃষ্ঠা: ৭৮
সেতু ধ্বংস আর বাঙালিদের নৈতিকতা ও শক্তি বৃদ্ধি করা। ভারত সরকার পরিকল্পনা ছাড়া খাপছাড়াভাবে সেনা মােতায়েন করে না। এ ছাড়া শতভাগ। সফল হওয়ার নিশ্চয়তা না থাকলে তারা প্রকাশ্য বৈরিতায়ও লিপ্ত হয় না।
পূর্ব পাকিস্তানে আসার পর আমি মূলত সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চল ও পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করাই। ফলে কমান্ড নেওয়ার সময় যুদ্ধের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি ভালােভাবে অবগত ছিলাম এবং সে জন্য আমার পক্ষে বিভাগীয় কমান্ডারদের নতুন নির্দেশনা দেওয়া সম্ভব ছিল। আমি যেকোনাে যুদ্ধের আগে, চলাকালে বা শেষে যুদ্ধের এলাকাগুলাে আগের মতােই সফর করছিলাম। বেতারযন্ত্র আর টেলিফোন খুব কমই ব্যবহার করতাম। টেলিফোন। দপ্তরে বাঙালিই ছিল বেশি, তাই টেলিফোন ব্যবহার নির্ভরযােগ্য ছিল না। বেতার যােগাযােগের ভালাে মাধ্যম হলেও তা কখনাে ব্যক্তিগত যােগাযােগের বিকল্প হতে পারে না। আমার এসব সফর সেনাদের টনিক হিসেবে কাজ। করত, সব স্তরের সেনারাই এসব সফরের প্রশংসা করেছে। আমি ইউনিট ও ফরমেশন সদর দপ্তরই শুধু সফর করিনি, একই সঙ্গে সেনাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এফডিএলে [যুদ্ধের সম্মুখবর্তী এলাকা] চলে গিয়েছি।
ডিভিশন ও সাহায্যকারী আর্মসের কমান্ডারদের (যদিও তখন তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনই মজুত ছিল) পরামর্শে যুদ্ধ পরিকল্পনা তৈরি করেছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে অভিযানের পরিকল্পনা ও কৌশলগত সিদ্ধান্ত ছিল আমার একার।
প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সেনা মােতায়েন। সাবেক পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের ছােট একটি অংশ বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। চতুর্থ দিকে আছে বঙ্গোপসাগর। মূলত পূর্ব পাকিস্তান একটি নিম্নভূমি, যার মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য নদী ও জলধারা। সেখানকার তিন প্রধান নদী হলাে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা। বর্ষার সময় এই নদীগুলাে সমুদ্রের মতাে হয়ে যায়। এই নদীগুলাের আবার অসংখ্য শাখা ও উপনদী আছে, যার কারণে এই অঞ্চলের যােগাযােগব্যবস্থা অত্যন্ত প্রতিকূল। পুরাে পূর্ব পাকিস্তানে কেবল ভৈরব ও পাকশীতে দুটি সেতু ছিল। সড়ক ও সেতুর অভাবে নৌকা ও ফেরি এই অঞ্চলে যােগাযােগের প্রধান মাধ্যম। এটি যেমন সময়সাপেক্ষ, তেমনি গেরিলাযুদ্ধ মােকাবিলায় অনেক ঝামেলাপূর্ণ। এতে করে গেরিলাদের হঠাৎ আক্রমণের মুখে পড়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। দ্রুত নদীর প্রতিবন্ধকতা দূর করার একমাত্র সমাধান হলাে আকাশপথ, ১৯৭১ সালে ভারতীয়রা ঠিক এটাই করেছিল, অথবা নদীর উভয় পাড়ে প্যারাট্রুপার নামানাে।
পৃষ্ঠা: ৭৯
সেখানকার আবহাওয়া খুবই উষ্ণ ও আর্দ্র। বর্ষাকালের স্থায়িত্ব অনেক বেশি এবং তখন খুব ভারী বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষার সময় আর্দ্রতা এত বেড়ে যায় যে যারা এর সঙ্গে ধাতস্থ নয়, তাদের পক্ষে এটি সহ্য করা খুবই কঠিন। এই আবহাওয়া মানুষের শক্তি শুষে নেয়। এই সেঁতসেঁতে আবহাওয়া শুষ্ক অঞ্চলের মানুষের জন্য বিপজ্জনক। এই পরিবেশে নানা রকম রােগের প্রকোপ দেখা দেয়। এর মধ্যে ম্যালেরিয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক। জোকসহ অনেক রকম বিপজ্জনক কীটের উপদ্রব দেখা দেয়। ঠিকঠাক সুরক্ষাব্যবস্থা না থাকলে এই আবহাওয়া ও কীটপতঙ্গ সেনাদের জন্য বুলেটের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়।
যাহােক, এই প্রধান নদীগুলাে পুরাে দেশটিকে চারটি স্বাধীন সেক্টরে। বিভক্ত করেছে :
রংপুর-রাজশাহী সেক্টর : পুরাে এই সেক্টরে কেবল পাকশীতে একটি রেল সেতু ছিল। এই সেতু দক্ষিণের কুষ্টিয়া-খুলনা অঞ্চলকে এই সেক্টরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার জন্যও কেবল একটি বড় রাস্তা ছিল। ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগের জন্য যমুনা নদীতে সেতু ছিল না। হালকা বিমানের জন্য ঠাকুরগাঁওয়ে ছােট একটা বিমানঘাঁটি ছিল।
কুষ্টিয়া-খুলনা সেক্টর : এই অঞ্চলে দুটি বড় সড়ক ছিল, একটি ছিল কুষ্টিয়া থেকে খুলনা পর্যন্ত, আরেকটি ছিল ভারতীয় সীমান্তের বেনাপােল থেকে যশাের-ঝিনাইদহ-ফরিদপুর পর্যন্ত। এই অঞ্চলে আবার ছােট ছােট অনেক নদী। ছিল, তাই আড়াআড়ি চলাচল করা ছিল দুরূহ। যশােরে ভালাে একটি বিমানঘাঁটি ছিল। আর চালনাতে একটি নৌবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছিল।
সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টর : চট্টগ্রাম একটি সমুদ্রবন্দর। মেঘনা নদী এই অঞ্চলকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার। একটি সরাসরি সড়ক আছে। ভৈরব রেলসেতু ঢাকাকে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। কিছু কিছু জায়গায় রেললাইন একদম আগরতলা সীমান্ত ঘেঁষে চলে গিয়েছে। দক্ষিণ থেকে উত্তরে যাওয়ার কেবল দুটি বড় রাস্তা ছিল, একটি ছিল সিলেট থেকে ঢাকা, আরেকটি ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম। এই পথে ছিল আবার অসংখ্য নদী, যে কারণে চলাচল করা ছিল কঠিন, যানবাহনের গতিও ছিল ধীর। চট্টগ্রামে ভালাে একটি বিমানঘাঁটি ছিল, যদিও তা ছিল কেবল ছােট বিমানের জন্য।
ঢাকা সেক্টর : ঢাকা ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতার কেন্দ্র। এই সেক্টরের পশ্চিমে ছিল যমুনা নদী, পূর্বে ছিল মেঘনা। ময়মনসিংহ থেকে একটি রাস্তা সােজা ঢাকায় এসে উঠেছে। ভারতীয় সীমান্ত থেকে এই সড়ক দিয়ে ঢাকা পৌঁছানাে সবচেয়ে সহজ ছিল, যদিও তা ছিল বন্ধুর। ব্রহ্মপুত্র নদ
পৃষ্ঠা: ৮০
এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বাধা ছিল। এর মাঝখানে আবার ছােট-বড় অনেক নদী ছিল। ঢাকার বিমানঘাঁটিটি বড়ই ছিল, এফ৮৬ বিমান সেখানে অবতরণ করতে পারত।
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে বড় রাস্তার পাশ দিয়ে চমৎকার ছােট ছােট রাস্তা ছিল ঠিকই, কিন্তু বড় বড় নদীর কারণে সেনাদের এক সেক্টর থেকে আরেক সেক্টরে যাওয়া সম্ভব ছিল না।
যােগাযােগ
সামরিক অভিযানে যােগাযােগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে যােগাযােগব্যবস্থা ছিল দুর্বল : রেলপথ ছিল সীমিত, পাকা রাস্তা ছিল খুবই সামান্য, তাও আবার মাটি ফেলে উঁচু করে সেই রাস্তা বানাতে হতাে। এখানকার যােগাযােগব্যবস্থা বিশ্বে অনন্য। ব্যাপারটা হলাে, সেখানকার যােগাযােগব্যবস্থা ছিল যথাক্রমে নৌপথ-রেলপথ-সড়কপথনির্ভর; যদিও বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ব্যাপারটা ঠিক এর উল্টো।
পাকা রাস্তা বানাতে ১৫ থেকে ২০ ফুট মাটি ভরাট করতে হয়। আর যেদিক দিয়ে রাস্তা গেছে, তার চারদিকে ঘন ঝােপঝাড়, বদ্ধ পুকুর বা ধানখেত। এসব খেতে বর্ষার সময় চার-পাচ ফুট পানি থাকত। ফলে সেখানে অস্ত্র মােতায়েনের জন্য পরিখা করার বদলে পানির ওপরে মাচার মতাে কিছু করতে হতাে। ফলে এগুলাে দৃশ্যমান হয়ে যেত। আর পরিখা যেভাবেই করা হােক না কেন, পানি এসে তা ভরাট হয়ে যেত। যাহােক, ভৈরব রেলসেতু চট্টগ্রাম বিভাগকে ঢাকা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং পাকশী রেলসেতু খুলনা বিভাগকে করেছে রাজশাহী বিভাগের সঙ্গে। তবে ঢাকা বিভাগের সঙ্গে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সংযােগ সেতু ছিল না। তাই ঢাকা থেকে রাজশাহী বা খুলনা চলাচলের জন্য নৌকা বা আকাশপথ ব্যবহার করতে হতাে। আর নদী পার হওয়ার জন্য ছিল ফেরি।
একটা ছােট উদাহরণের মাধ্যমে বােঝা যায় যে যােগাযােগব্যবস্থা কতটা প্রতিকূল ছিল। ধরা যাক, ঢাকা থেকে যশাের যেতে হবে। সে জন্য প্রথমে সড়কপথে বা ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ যেতে হবে, নারায়ণগঞ্জ থেকে স্টিমারে গােয়ালন্দ ঘাট বা খুলনা, সেখান থেকে ব্রডগেজ ট্রেনে যশাের। আকাশপথে এই দূরত্ব মাত্র ৭৫ মাইল, অথচ এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগত দুই দিন এবং তিনবার ওঠানামা করতে হতাে। একইভাবে সিলেট থেকে যশাের যেতে সড়ক, নৌ, দুই ধরনের ট্রেনসহ তিনটি থেকে চারটি বাহনে ভেঙে ভেঙে যেতে হতাে।
পৃষ্ঠা: ৮১
সেনা মােতায়েন ও বিদ্রোহী দমন অভিযান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দায়িত্ব নেওয়ার সময় পরিস্থিতি দেখে আমার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফিল্ড মার্শাল ফচের [প্রথম মহাযুদ্ধে ফরাসি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি] কথা মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, আমার মাঝখান ভেঙে পড়ছে, ডান পাশ পিছিয়ে যাচ্ছে; পরিস্থিতি দারুণ, আক্রমণ আমাকে করতেই হবে। আর আমি মনে মনে বললাম, আমার কেন্দ্রে ভাঙন ধরেছে, আশপাশ উল্টে গেছে আর আমি কমবেশি ঘেরাও হয়ে আছি। পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালাে হতে পারে না। আমাকে অবশ্যই আক্রমণ করতে হবে। আমি তাৎক্ষণিকভাবেই হামলা করি। সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় যুদ্ধের প্রথম দফায় আমি পূর্ণাঙ্গ সফলতা অর্জন করি। আমি সব ফরমেশনের কাছে শৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য চিঠি পাঠাই, পরিশিষ্ট ৩ ও ৪-এ তা সংযুক্ত করা হয়েছে [এখানে সংযুক্ত করা হয়নি]।
আগে যা বলেছি, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তিন দিকেই ভারত। পুরাে সীমান্ত এলাকার সীমানা ৩ হাজার মাইল (২ হাজার ৫০০ মাইল স্থল ও ৫০০ মাইল সমুদ্র)। এই সীমান্ত আবার সরলরৈখিক বা পশ্চিম পাকিস্তানের মতাে অর্ধবৃত্তাকার নয়, বরং তা অনেকটা বৃত্তের মতাে এবং চারটি বড় নদী দ্বারা চারটি সেক্টরে বিভক্ত। সে কারণে সব সময় আমাদের পক্ষে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি ডিভিশন পর্যায়েও তা সম্ভব হয়নি। খুব বেশি হলে ব্যাটালিয়ন বা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ব্রিগেড দিয়ে ডিভিশন অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।
জেনারেল টিক্কা খান যে সেনা মােতায়েন করে গিয়েছিলেন, উত্তরাধিকার সূত্রে আমি তাই পেলাম। আমি চেয়েছিলাম গেরিলাদের উৎখাত করতে। আর তা করতে আমার জন্য দুটি পথ খােলা ছিল :
ক) গেরিলাদের সীমান্তের দিকে তাড়িয়ে দেওয়া এবং একসময় তাদের ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন করে ভারতের ভেতরে ঠেলে দেওয়া। এটি করতে হয়তাে অনেক সময় লাগত। ব্যয়বহুল যেমন হতাে, তেমনি অনেক সেনার প্রাণও যেতে পারত এতে। আমি হয়তাে তাদের পছন্দের জায়গাতেই যুদ্ধ করতাম এবং তাদের সেনাসংখ্যা বাড়ানাে বা প্রত্যাহারের সুযােগও হয়তাে শেষ পর্যন্ত থাকত।
খ) দুই পাশ ও পেছনের কথা না ভেবে, কয়েকটি কলামে সীমান্তের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যাওয়া এবং তাদের সেনাসংখ্যা বাড়ানাে বা প্রত্যাহারের পথ বন্ধ করে দেওয়া। দ্রুতবেগে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটি প্রবল আঘাত দিলে গেরিলাদের মনে ভয় ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব হতাে। তাদের মধ্যে
পৃষ্ঠা: ৮২
বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ভীতিও তৈরি করা সম্ভব হতাে। এইভাবে এগিয়ে গেলে গেরিলারা হয়তাে তাদের তৈরি করা অবস্থান থেকে সরে যেত এবং পালিয়ে ভারতের দিকে চলে যেত।
তবে জেনারেল টিক্কার সেনা মােতায়েনের ধরন অনেকটা রক্ষণাত্মক ছিল। আক্রমণাত্মক অবস্থানে যাওয়ার জন্য সমন্বয়ে কিছুটা হেরফের দরকার ছিল। কিন্তু আমি শত্রুদের বিস্মিত করে সুযােগটা তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, তাই সীমান্তে দ্রুত পৌছার জন্য গতি খুব জরুরি ছিল। সে কারণে পরিবর্তন খুব বেশি করলাম না। ফরমেশনকে নতুন কিছু কাজ দিয়ে আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়তে বললাম। শুধু এটুকু বললাম, সবার আগে আমাদের। সীমান্তে পৌঁছাতে হবে, সর্বোচ্চ গতিতে।
আমি নিচের চার ধাপে আমার নির্দেশনা সম্পাদনের আদেশ দিলাম।
প্রথম ধাপ : সব গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত শহর দখলমুক্ত করে সেখানে অনুপ্রবেশ বা সেখান থেকে বেরােনাের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া। চট্টগ্রাম ঘাঁটি দখলমুক্ত করে তা কামান ও মর্টারের গােলা থেকে রক্ষা করা।
দ্বিতীয় ধাপ : গুরুত্বপূর্ণ নদী, সড়ক ও রেল যােগাযােগব্যবস্থা চালু করা।
তৃতীয় ধাপ : ভেতরের সব শহর ও উপকূলীয় অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনীকে হটিয়ে দেওয়া।
চতুর্থ ধাপ : পুরাে এলাকা বিদ্রোহী ও অনুপ্রবেশকারী থেকে মুক্ত করতে চিরুনি তল্লাশি চালানাে।
এসব কাজ করার চূড়ান্ত সময়সীমা নির্ধারণ করলাম ১৯৭১ সালের ১৫ মে। আরও বললাম, জোর দিয়েই বললাম, গতি বাড়াতে বা একাধিক আঘাত করতে পারলে সুবিধা পাওয়া যাবে।
সেনাবাহিনী ও তাদের কাজ রাজশাহী বেসামরিক বিভাগের দায়িত্ব ছিল মেজর জেনারেল নজর হােসেন শশাহের নেতৃত্বাধীন ১৬ ডিভিশনের। তারা দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়া ধরে রাখবে। এখান থেকে ভারতীয় সেনানিবাসগুলাে খুব কাছে এবং এলাকাটি সমতলভূমি হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে সেখানে অনায়াসে ট্যাংক চলাচল সম্ভব। সে জন্য পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ট্যাংক রেজিমেন্ট এদের হাতে দেওয়া হয়।
ঢাকা ও খুলনা বিভাগ ছিল মেজর জেনারেল শওকত হােসেনের নেতৃত্বাধীন নবম ডিভিশনের দায়িত্বে। ঢাকা ছিল প্রদেশের রাজধানী। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও ছিল সেখানে, ফলত ঢাকার গুরুত্ব ছিল অনেক।
পৃষ্ঠা: ৮৩
ঢাকার উত্তর দিকে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। কিন্তু মধুপুরের জঙ্গলসহ টাঙ্গাইল শহরের চারপাশে বেশ শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। ময়মনসিংহ শহরও ধরে রাখা প্রয়ােজন ছিল। গুরুত্বের দিক থেকে রাজশাহী বিভাগের পর খুলনা বিভাগের স্থান, কারণটা আবারও সেই ভৌগােলিক নৈকট্য, সেখান থেকে ভারতীয় সেনানিবাসগুলাে বেশ কাছে। তুলনামূলকভাবে সহজে আমাদের অবস্থানের মুখােমুখি ভারতীয় বাহিনী মােতায়েন করা সম্ভব ছিল। তাই যশােরও ধরে রাখা প্রয়ােজন ছিল। ফরিদপুরের বেলায়ও একই কথা প্রযােজ্য, কারণটা হলাে, এটি যেমন একদিকে যশাের শহরকে গভীরতা দিচ্ছিল; অন্যদিকে ঢাকার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করছিল।
অন্যদিকে চালনা, বরিশাল ও সুন্দরবনের জলমগ্ন অঞ্চলগুলাে সিএএফকে [বেসামরিক বাহিনী] দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব ছিল মেজর জেনারেল রহিম খানের কাঁধে। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম রক্ষা করার প্রয়ােজন ছিল। চট্টগ্রামও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কমান্ডাে সেনা মােতায়েন করা হয়েছিল। এ ডিভিশনের মধ্যে অঞ্চল ও দায়িত্ব ভাগ করার পর আমি সেগুলি সফর করলাম। এরপর বিস্তারিত পরিকল্পনা, পরবর্তী গ্রুপিং ও ফরমেশনগুলাের জন্য নতুন করে সীমানা নির্ধারণের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলাম।
এটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে কোনাে আগ্রাসনকারীই বৈরী এলাকায় টিকতে পারে না, যেখানে জনসাধারণ তােমার বিরুদ্ধে আর তােমার প্রতিপক্ষের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। একইভাবে যেখানে বিশ্বাসঘাতকেরা শত্রুদের সহায়তা করে, সেখানে সশস্ত্র বাহিনী যতই বীরােচিত ভূমিকা রাখুক না কেন, সে জাতির পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। আমাদের এই দুই পরিস্থিতিরই শিকার হতে হয়েছে এবং তা আরও বড় পরিসরে। জেনারেল টিক্কা খানের নির্মম ও অপরিকল্পিত সামরিক অভিযানের পর বাঙালি সেনা ও রাজনীতিকদের বেরিয়ে যাওয়া, মুক্তিবাহিনী গঠন ও কলকাতায় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠন ও স্থানীয় জনগণের আমাদের বিরুদ্ধে চলে যাওয়া—এসব কারণে আমরা এক বৈরী পরিবেশে বিদেশি সেনাবাহিনীর মতাে হয়ে গেলাম। বাঙালিরা আমাদের দখলদার সেনাবাহিনী’ বলত। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর শুধু স্থানীয় সমর্থনই ছিল না, ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা। এখানেই শেষ নয়, পুরাে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক ক্ষমতাকাঠামাের সমর্থনের পাশাপাশি আরও ছিল রাশিয়ার উপদেষ্টাদের সমর্থন।
যাহােক, বিপক্ষ শক্তি সংখ্যায় আমাদের চেয়ে বেশি এবং স্থানীয় পরিবেশ ও যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে পরিচিত হলেও বা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও আমরা
পৃষ্ঠা: ৮৪
সফলভাবে প্রথম ধাপ থেকে তৃতীয় ধাপ সম্পন্ন করতে পেরেছিলাম। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমরা সব সীমান্ত শহর ও বিওপি খালি করে দখল নিতে সক্ষম হই। পাশাপাশি, ভারত থেকে সেনা অনুপ্রবেশের সব পথ। বন্ধ করে পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হই, জেনারেল ইয়াকুব ও টিক্কার আমলে যা একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। আর মে মাসের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম, চালনা ও খুলনার সমুদ্র ও নদীপথ আমাদের দখলে নিয়ে আসি, এসব বন্দরে নৌযান আসা-যাওয়াও শুরু করে। এ ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের রেল যােগাযােগও আবার চালু হয়।
১৯৭১ সালের ১৩ মে আমি রাওয়ালপিন্ডির জিএইচকিউতে বার্তা পাঠাই। সর্বশেষ পরিস্থিতি, বিদ্রোহীদের তৎপরতার ধরন, ভারতের অংশগ্রহণের। মাত্রা, ফরমেশনগুলাের সীমান্ত পরিবর্তন ও নতুন দায়িত্ব—এসব লিখে পাঠাই। বিদ্রোহীরা শহরে পরাজিত হয়ে ভেতরের দুর্গম স্থানে চলে যায়, বিশেষ করে, ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলােতে চলে যায় তারা। প্রায় ৩০ হাজার বিদ্রোহী সেনা প্রাণ হারায় বা অকার্যকর হয়ে যায়, বাকিরা ভারতে চলে যায়।
নতুন সেনা মােতায়েনের ধরনটা ছিল এ রকম :
মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহের নেতৃত্বে তিনটি ব্রিগেড ও একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত ১৬ ডিভিশনের অধীনে দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়াকে নিয়ে আসা হয়।
মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারির নেতৃত্বে দুই ব্রিগেড নিয়ে গঠিত নবম ডিভিশনের অধীনে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, ভােলা, পটুয়াখালী, খুলনা, যশাের, চুয়াডাঙ্গা, মেহরপুর ও পাকশী সেতু নিয়ে আসা হয়।
চালনা, বরিশাল ও সুন্দরবনের মতাে জলমগ্ন অঞ্চল সিএএফের [বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী] সঙ্গেই রাখা হলাে।
মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে তিনটি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত ১৪ ডিভিশনের অধীন ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লা হয়ে ফেনী নদী, নােয়াখালী ও ঢাকাকে আনা হলাে।
আর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধীনে একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড ও কমান্ডােদের অধীনে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলকে আনা হলাে।
নতুন সেনা মােতায়েনের ক্ষেত্রে নিচের পরিবর্তনগুলাে নিয়ে আসা হয় :
অদক্ষতা ও যুদ্ধের চাপে ন্যুবজ হয়ে যাওয়া মেজর জেনারেল শওকত রেজাকে নবম ডিভিশনের কমান্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর পরিবর্তে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারিকে পদোন্নতি দিয়ে এই ডিভিশনের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এই ডিভিশন প্রথমত ঢাকা ও খুলনা বিভাগের বেসামরিক
পৃষ্ঠা: ৮৫
দায়িত্বে ছিল। এখন এই ডিভশন থেকে একটি ব্রিগেড বাদ দিয়ে তাকে শুধু খুলনা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় ১৪ ডিভিশনকে। একটি ডিভিশনের জন্য এটি অনেক বড় জায়গা ছিল, তাই এই অঞ্চলকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। ফেনী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে এখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ফেনীর উত্তরাঞ্চল এর সঙ্গে রেখে দেওয়া হয়। ১৬ ডিভিশনে পরিবর্তন আনা হয়নি।
এই সেনা মােতায়েন ও সীমান্ত পুনর্নির্ধারণ অভিযানের সময় অধিক কার্যকর প্রমাণিত হয়। ফরমেশন কমান্ডারদের নিজ এলাকার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তৈরি করে অগ্রসর হতে বলা হয়, সঙ্গে এ-ও বলা হয় যে তারা যেন যােগাযােগব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে কোথায় প্রতিরক্ষা নেওয়া দরকার, তা নির্ধারণ করবে। শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়বে এবং সেই অবস্থানে গােলাবারুদ ও রেশনের মজুত গড়ে তুলবে।
১৯৭১ সালের মে মাস নাগাদ বিদ্রোহীদের প্রতিরােধ ভেঙে দেওয়া হয়। এতে তাদের জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বিদ্রোহীদের মনােবল ভেঙে যায়। তারা দুর্গম জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় অথবা ভারতীয়দের আশ্রয়ে ক্ষতস্থানের শুশ্রুষা করে। ভারত অবশ্য বসে ছিল না। বিদ্রোহ যাতে না থামে সে জন্য ভারতীয়রা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও উপকরণ সরবরাহ করে যােদ্ধাদের। শক্তি বাড়াতে সচেষ্ট থাকে। ভারতীয়রা সীমান্তের ওপার থেকে গুলি ছুঁড়ত এবং কখনাে কখনাে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে আমাদের আস্তানায় হামলা চালাত। কিন্তু হতােদ্যম বিদ্রোহীরা আমাদের সেনা দেখলেই বা ভারতীয়দের চোখের আড়াল হলেই পালাত।
এসব অভিযানে ৪০ হাজার রাইফেল, ১০টি ভারীসহ ৬৫টি মেশিনগান, ১১৪ হালকা মেশিন গান, ৩১টি মর্টার, ১২টি রিকয়েললেস রাইফেল ও বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদসহ বিপুলসংখ্যক অস্ত্র আমাদের হাতে আসে। বিদ্রোহীদের মারা পড়া এবং বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ফেলে যাওয়ার কারণ হলাে আমাদের অভিযানের গতি ও সাহসিকতা। সব পর্যায়েই এই গতি বজায় রেখেছি আমরা। ব্যাপারটা হলাে আমরা যে গতিতে এসব অভিযান চালিয়েছি, গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। এই গতির কারণে শত্রুরা বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায়। সাহস হারিয়ে তারা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এলােপাতাড়ি ছুটে বেড়িয়েছে, আর তা করতে গিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও যানবাহন ফেলে যায়। তাঁরা যে পরিকল্পিতভাবে পিছিয়েছে তা নয়, পুরােটাই ছিল অগােছালাে। দুই মাসের কম সময়ে বিদ্রোহীরা নিজের অঞ্চলে ও কৌশলে বড় ব্যবধানে হারতে শুরু করে, যদিও স্থানীয় জনগণ ও ভারতের সমর্থন তাদের ছিল।
পৃষ্ঠা: ৮৬
এই অভিযানকে ‘বিদ্যুৎ গতির অভিযান’ আখ্যা দিলে ভুল হয় না। আমি জিএইচকিউতে অভিযানের বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠাই এবং মার খাওয়া মুক্তিবাহিনীকে পাকড়াও করতে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের অনুমতি চাই। জেনারেল হামিদ টেলিফোনে আমাকে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট ও আমি উভয়েই আপনার এই দারুণ অর্জনে সন্তুষ্ট। তবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করবেন না। শিগগিরই ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আপনার সঙ্গে আলােচনা করব’, এই ছিল তার কথা।
আমাদের দ্রুত সৈন্য চালনা, সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়া ও যােগাযােগব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সময়সূচি এলােমেলাে হয়ে যায়। তারা ধারণা করেছিল যে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে প্রদেশের বড় শহর আর সেনানিবাসের মধ্যে সীমিত করে ফেলবে এবং সরবরাহের ঘাটতি ও যানবাহনের অভাবে কয়েক মাসের মধ্যে আমাদেরকে অকেজো করে দেবে। তবে হ্যা, টিক্কা খান দায়িত্বে থাকলে অথবা আমি টিক্কা খানের পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করলে ভারতীয়দের এই সহজ সূত্র কাজে লেগে যেত, আগেও বলেছি, টিক্কা খানের পরকিল্পনা ছিল আত্মরক্ষামূলক। ভারতীয় সেনাবাহিনীও সেই পরিকল্পনা করে রেখেছিল, প্রত্যেক মুক্তিযােদ্ধা যদি একজন করে পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে, তাহলে কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তান গ্যারিসন উধাও হয়ে যাবে।
১৯৭১ সালের জুন মাসে জেনারেল হামিদ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এলে আমি তাকে জানালাম, অত্যন্ত অল্প সময়ে আমরা সেখানে এক বড় নৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিজয় অর্জন করেছি, তাই আমাদের মনােবল তুঙ্গে। আর বাঙালিদের তলানিতে। বাঙালিরা দৌড়ের ওপর আছে। অন্যদিকে ভারতীয়রা ধাধায় পড়েছে আর রুশিরা বিস্মিত। আমার সেনারা লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে, যেখানে ভারতীয়রা এখনাে বুঝে উঠতে পারছে না। তাদের কী করা উচিত। আমি যুক্তি দিলাম যে লােহা গরম থাকতে থাকতে আঘাত করতে হবে, অর্থাৎ বিদ্রোহীদের তাড়া দিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে নিয়ে শো হিসেবে তাদের অকেজো করে দেওয়া, যাতে ভারত আর তাদের। সহায়তা করতে না পারে। সেটা করলে লাখ লাখ বেসামরিক নাগরিক নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটবে আর তাতে সেখানকার যােগাযােগব্যবস্থা ব্যাহত হবে। এতে রাস্তাঘাটে এত ভিড় হবে যে ভারতীয় বেসামরিক প্রশাসন নানা সমস্যায় পড়বে, এতে আবার ভারতীয় সেনাদের চলাচলও ব্যাহত হবে। এখন পর্যন্ত আমরা নিজেদের ভূমিতে লড়াই করছি। এতে আমাদের জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। কথা হলাে, ভারত সরকার যদি দেখে যে তার। জনগণের ক্ষতি হচ্ছে তাহলে তারা আক্রমণাত্মক অবস্থান থেকে সরে
পৃষ্ঠা: ৮৭
আসবে। এ ছাড়া মুক্তিবাহিনীর সংগঠিত প্রতিরােধ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হতােদ্যম হয়ে তারা ছত্রখান হয়ে গেছে। এদের অধিকাংশ এখন ভারতে পালিয়ে আছে।
সেই সময় ভারতীয় সেনারা অপ্রত্যাশিত আক্রমণ প্রতিহত করার মতাে জায়গায় ছিল না। যতক্ষণে তারা সংগঠিত হয়ে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করার মতাে জায়গায় যাবে, ততক্ষণে আমরা গেরিলা শিবিরগুলাে ধ্বংস করে দিতে পারব এবং তাদের আরও ভেতরে ঠেলে দিতে পারব। আর সীমান্তে যে সীমান্তরক্ষী সেনারা আছে, তাদেরও ভেতরে ঠেলে দিতে পারব। ভারতীয়দের পূর্ণ শক্তি সংগঠিত করতে করতে বর্ষা শুরু হয়ে যাবে এবং তাদের পক্ষে ভারী অস্ত্র ও বিমানসেনা ব্যবহার করা সম্ভব হবে না, অর্থাৎ আমাদের অবস্থান থেকে হটাতে পারবে না তারা। এর মধ্যে পশ্চিমের গ্যারিসনগুলাে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে লক্ষ্য অর্জন করে ফেলবে, আর সেটা মূল লড়াইটা পশ্চিমে হবে’ ধারণার আলােকে। তা আমার দ্বিতীয় পরামর্শটি ছিল এ রকম: যদি আমার ডিভিশনের ঘাটতি, বিশেষ করে ট্যাংক আর গােলন্দাজ পূরণ করা হয় এবং এক স্কোয়াড্রন আধুনিক বিমান, কিছু বিমানবিধ্বংসী কামান আর একটি ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড গ্রুপ দেওয়া হয়, তাহলে আগরতলা ও আসামের বড় একটি অংশ আমার পক্ষে দখল করে নেওয়া সম্ভব হবে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও কিছু হামলা চালানাে সম্ভব হবে। হুগলি সেতু উড়িয়ে দিয়ে এবং নৌকা ও জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে আমরা কলকাতার অর্থনীতি খোড়া করে দিতে পারব, এতে আমজনতার মধ্যে ভীতিও তৈরি হবে। কলকাতায় একবার বিমান হামলা চালানাে গেলে লাখ লাখ মানুষ কলকাতা ছেড়ে চলে যাবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বাহিনী কলকাতায় বিমান হামলা চালালে ঠিক একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
তৃতীয়ত, আমি বলেছিলাম, ঘাটতি পূরণ করতে আমাকে আরও দুটি ডিভিশন, কিছু বিমান, বিমানবিধ্বংসী কামান (পশ্চিম পাকিস্তানকে দুর্বল না করেই যা দেওয়া সম্ভব ছিল) দেওয়া হােক; তাতে আমার পক্ষে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের লড়াই করাই সম্ভব হতাে তা নয়, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তান ও ভারতের মাটিতেও লড়াইটা করা সম্ভব হতাে। আমাদের পাঁচ ডিভিশনের মােকাবিলায় তাদের ১৫টি ডিভিশন আনতে হতাে, সঙ্গে লাগত বিমান ও নৌবাহিনীর বড়। একটি অংশ। ভারতকে চীনের মােকাবিলা ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য কিছু ডিভিশন রাখতে হতাে। এতে পশ্চিম ফ্রন্টে তারা দুর্বল হয়ে পড়ত এবং আমাদের পক্ষে কাশ্মীর ও গুরুদাসপুর স্বাধীন করা সম্ভব হতাে। ব্যাপারটা হলাে, পশ্চিমে সবল হতে গেলে ভারতকে পূর্বে দুর্বল হতে হতাে, তাদের
পৃষ্ঠা: ৮৮
পক্ষে তাে আর সবখানে সবল হওয়া সম্ভব হতাে নয়। মিজো স্বাধীনতাকামী নেতা লাল ডেঙ্গা, আসামের নাগা স্বাধীনতাকামী নেতা এ জে ফিজো এবং পশ্চিমবঙ্গের নকশালপন্থী নেতা চারু মজুমদারের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ ছিল। তারা আমাদের সঙ্গে হাত মেলাবে। অন্যদিকে ভারতের মাটিতে যুদ্ধ। শুরু হলে আমাদের বাঙালি ভাইয়েরাও লড়াইয়ে শামিল হতাে। আমি বলেছিলাম যে এটি ঈশ্বর প্রদত্ত সুযােগ, যা আমাদের নেওয়াই উচিত। নৈতিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত ও সামরিক দিক থেকে ভারতে হামলা করা আমাদের জন্য জায়েজ ছিল, কারণ ভারত নিজেই পাকিস্তানের ভূখণ্ডে ঢুকে আমাদের তল্লাশিচৌকিতে আক্রমণ ও শত্রুদের আশ্রয় দিয়েছিল।
সব শুনে জেনারেল হামিদ বললেন, আমার পরামর্শের অর্থ হলাে ভারতের সঙ্গে উন্মুক্ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া। আমি একমত পােষণ করে বললাম, ভারতের মাটিতে ঢুকলেই তারা আমাদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করতে চাইবে। আর ভারত অনুকূল পরিবেশ পেলে যে আমাদের সঙ্গে সরাসরি বৈরিতায় জড়িয়ে পড়বে না, তা নয়। তারা তাে পাকিস্তানের জন্ম মেনে নেয়নি এবং পাকিস্তান বা মুসলমানদের প্রতি তাদের সহানুভূতিও নেই। সুযােগ পেলেই তারা সতর্কবাণী ছাড়াই আমাদের ওপর হামলা করবে, কোনাে কারণ দেখানােরও প্রয়ােজন বােধ করবে না তারা। ১৯৪৭ সালের পর ভারত কখনােই শান্তিপূর্ণ দেশ ছিল না। তারা ইতিমধ্যে সাতটি যুদ্ধ করেছে এবং এই মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে। আমি বললাম, এই মুহূর্তে আঘাত করে ভারত যে অহিংসার কথা বলে, তাদের সেই অহিংসা চর্চা করতে বাধ্য করা উচিত।
আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনে জেনারেল হামিদ বললেন, ‘নিয়াজি, তােমার পরামর্শ শুনে ভালাে লাগল, আমি কিছু সেনা নিয়ে তােমাকে সাহায্য করতেই পারি—একসঙ্গে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের লড়াইটা করতে পারি। ভারতের মাটিতে যুদ্ধ করতে পারলে আমার ভালােই লাগত। তােমার শেষ পরামর্শটাও অনায়াসে বাস্তবায়ন করা যেত। কিন্তু আমাদের সরকার ভারতের সঙ্গে উন্মুক্ত যুদ্ধে যেতে চায় না; সরকার চায় যে সবকিছু ঠিক সেভাবেই চলুক, যেভাবে সব চলছে। তবে এই যুদ্ধে তুমি অসাধারণ কৃতিত্ব দেখাচ্ছ। এখন মন দিয়ে শােনাে, তােমার কাজ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে যেন ভারত বাংলাদেশ সরকার গঠন করে দিতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। তুমি সেটা করতে পারলেই আমরা খুশি হব। শেষ কথা হলাে, তুমি ভারতের মাটিতে তাে ঢুকবেই না, উপরন্তু সেখানে সেনাও পাঠাবে না এবং ভারতের দিকে লক্ষ্য করে গুলিও ছুড়বে না। তােমার কাজ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে শত্রুপক্ষকে ঢুকতে না দেওয়া।
পৃষ্ঠা: ৮৯
আমি বললাম, রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে কী হবে? বাঙালিরা তাে এর জন্য প্রস্তুত।’ তিনি বললেন, ‘টাইগার, রাজনৈতিক ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়াে না, এসব বড় বেশি জটিল।
আমি বললাম, ঠিক আছে স্যার, হয়ে যাবে। সে ভারতের মাটিতে ঢুকে বিদ্রোহীদের তাড়া করার পরিকল্পনার সেখানেই শেষ হলাে। আর যুদ্ধটা ভারতের মাটিতে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্নও ভূলুণ্ঠিত হলাে।
মেজর জেনারেল খুশবন্ত সিংহ দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ গ্রন্থের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,
‘আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করার জন্য ইয়াহিয়ার যৌক্তিক কারণ ছিল। গেরিলাদের পাকড়াও করতে এবং ভারতে তাদের শিবির গুঁড়িয়ে দিতে তিনি তা করতেই পারতেন এবং পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতকে আঘাত করে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করতে পারতেন। ভারতের অবস্থা তখন ভালাে ছিল না। রিজার্ভ সেনারা ছিল তখন দূরে। সেনা ও উপকরণের ভয়াবহ ঘাটতি ছিল তাদের। সেনা ও সাধারণ জনতা তাৎক্ষণিক যুদ্ধে যেতেও প্রস্তুত ছিল না। ইয়াহিয়া তখন হামলা চালালে বর্ষার আগেই পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে সুবিধাজনক অবস্থানে। যাওয়া সম্ভব হতাে তার।
ভারতের সেনারা শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তা-ই নয়, রাশিয়ার সঙ্গেও তখনাে তাদের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ইয়াহিয়া তখন ভারতে হামলা চালালে পাকিস্তান অবিভক্তই থাকত, আর ভারতকেও মারাত্মক আঘাত করা যেত, পাকিস্তান সেনাবাহিনীও অপরাজিত থাকত।
অনুবাদ : প্রতীক বর্ধন।
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান