You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.23 | বাংলাদেশ ও আমরা- সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও আমরা
সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই পশ্চিম বাংলার মানুষকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করছে, বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের নিজেদের প্রবণতাগুলােকে নিঃসংকোচে যাচাই করার একটা সুযােগ এসেছে।
ওপারে যা ঘটছে তার সংবাদ এ দেশের মানুষকে পৌছে দেবার ব্যাপারে বাংলা খবরের কাগজগুলাের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী এই সংবাদপত্রগুলাে এই সুযােগে একজাতীয় সস্তা রােমহর্ষকতা ও নাটুকেপনার অবতারণ করেছে। হাসিও পায়, দুঃখও হয় যখন দেখি যে, সংবাদপত্রটি চৌষট্টি সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় বিশেষ ঢং-এর খবর পেশ করে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়েছিল, আজ তারই সাংবাদিকরা পূর্ববাংলার মুসলমান ভাই-বোেনদের দুঃখে অশ্রুপাত করছেন। আমার মনে আছে চৌষট্টি সালে দাঙ্গার দিনগুলােতে প্রায় রােজই সন্ধ্যাবেলা শিয়ালদহ স্টেশনে যেতে হতাে, বনগাঁ থেকে ট্রেনে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উৎপীড়িত হিন্দু উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে দাঙ্গা সংক্রান্ত সংবাদ জোগাড় করতে। কাটা মুণ্ড তাে দূরের কথা, কোনােদিন কোনাে রক্তাক্ত, আহত উদ্বাস্তুকে আমি অন্তত দেখিনি। অথচ পরের দিন সকালে বাংলা সংবাদপত্রগুলাে খুলে দেখতাম, রােমহর্ষক সব সাক্ষাৎকার বার হয়েছে। যারা লিখেছেন, তারা আমারই সঙ্গে শিয়ালদহ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার করতেন।
এসব কাগজের সাংবাদিকরা যখন পূর্ববাংলায় কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে এসে রােমাঞ্চকর বিবরণী পেশ করেন, তখন আমি অবাক হই না। বুঝতে পারি, যে রােমহর্ষকতার তাগিদে এক সময় তারা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের গুণ্ডা বানিয়েছিলেন, তারই প্রয়ােজনে আজ আবার সেই মুসলমানদেরই মুক্তিযােদ্ধা বলে জয়গান গাইতে হচ্ছে। স্বভাবতই আতিশয্য তখনও যেমন হয়েছিল, এখনও হচ্ছে।
এক এক সময় এই আতিশয্য নির্লজ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন একটি সাংবাদিক যশাের থেকে ফিরে এসে লিখলেন কী করে কজি ডুবিয়ে মুরগির ঝােল উপভােগ করে এসেছেন তিনি। ওপারে যখন মানুষ যুদ্ধ করে মরছে, বােমায় ক্ষেত-খামার বিধ্বস্ত হচ্ছে, আসন্ন দুর্ভিক্ষের ঘনায়মান ছায়া, তখন যিনি সেই মানুষগুলাের আতিথেয়তার সুযোেগ নিয়ে তাদের অন্ন ধ্বংস করে মুরগির ঝােলের স্বাদ আহরণে ব্যস্ত, বাংলাদেশের মুক্তির লড়াই সম্বন্ধে তিনি কতটুকু আন্তরিক তা সহজেই অনুমেয়।
এই ধরনের সংবাদ রচনা না হয় অর্বাচীনের ইতরামি বলে উড়িয়ে দেয়া যেত। কিন্তু দিনের পর দিন, এই যুদ্ধটাকে অত্যন্ত সহজ বিজয়-অভিযান বলে প্রতিপন্ন করে নৈতিক মনােবল রক্ষার নামে পূর্ববাংলার এসব কাগজের পাঠকদের মনে এক ধরনের আত্মসন্তুষ্টি উৎপাদন করা হয়। যশােরের ঝিকরগাছা গ্রামে গিয়ে দেখেছিলাম স্থানীয় অধিবাসীরা আমাদের সংবাদপত্র পড়ে নিশ্চিত হয়ে বসেছিলেন যে, পাক-সৈন্য সম্পূর্ণ পরাভূত। তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঝিকরগাছার উপর পাক আক্রমণ এঁদের কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত ছিল, তেমনই বেদনাদায়ক। তারা আশা করতে পারেন নি এপারের বাঙালি বন্ধুরা, বিশেষ করে সাংবাদিকরা তাদের এভাবে বিভ্রান্ত করবেন। সংবাদ-পরিবেশনায় আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার এই নজিরগুলাে এ দেশে বসে মনে হয় নিরীহ অতিশয়ােক্তি, কিন্তু যারা সংগ্রামরত ও দেশে তাদের কাছে বিপজ্জনক।
অবশ্য এই জাতীয় নাটুকেপণা কেবলমাত্র সাংবাদিকদেরই একচেটিয়া নয়। যুদ্ধের শুরুর দিকে, যখন ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী পূর্ববাংলার অঞ্চলগুলাে নিরাপদ ছিল, তখন দলে দলে যুবক, ওপারে গিয়ে দিন কাটিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে কিছু আন্তরিকভাবে সাহায্য করার জন্যই, খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধপত্র নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশই প্রায় একটা চড়ইভাতি করার মেজাজ নিয়ে ঘুরে এসেছে। হিন্দী গান গাওয়ার ঢং-এ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে ট্রাকের উপর নাচতে নাচতে ছেলেদের বনগাঁ থেকে যাত্রা করতে দেখেছি। খুলনার সাতক্ষীরায় যেটা আমাদের ইটিন্ডাঘাট থেকে কয়েক মাইল দূরে দেখেছি এ পারের লােক সস্তায় মুরগি কিনে ফিরে আসছে। এপারের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যারা, তাঁরা অনুরােধ করেছেন‘ওপারের প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসবে না দয়া করে; কারণ ওঁরা যুদ্ধ করেছেন; ওঁদের আরও বেশি দরকার। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা! সাতক্ষীরাতে এমন দৃশ্য দেখেছি, এপারের ছেলেরা চা-মিষ্টি খেয়ে দাম দেবার বেলায় দরাদরি করছে।
পূর্ববাংলার ঘটনাবলীর প্রতিক্রিয়া এ দেশের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে আর এক জাতীয় সুযােগ এনে দিয়েছে। নিপীড়িত উদ্বাস্তুদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে গুণ্ডা-বদমায়েস, মেয়েমানুষের দালালদের উৎসাহ বেড়ে গেছে। পশ্চিম দিনাজপুরে রাধিকাপুর স্টেশনে দেখলাম প্রায় হাজার দশেক উদ্বাস্তু এসে হাজির হয়েছেন। হিন্দু, মুসলমান, উচ্চমধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত দরিদ্র মানুষের ভিড়। কেউ একেবারে নিঃস্ব, কেউ কিছু সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। অল্প বয়সী মেয়েদের সংখ্যা বেশি। ওখানকার পুলিশের অফিসারদের কাছে শুনলাম ছিনতাই, রাহাজানি শুরু হয়ে গেছে। বদমায়েশ লােকদের আনাগােনাও বেড়ে গেছে।
আবার উদ্বাস্তু সমস্যা এবং তার সঙ্গে জড়িত যতরকমের ন্যাক্কারজনক পূর্বপরিচিত লক্ষণগুলাের পুনরাবির্ভাব ঘটছে। এই নবাগত উদ্বাস্তুদের নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলাের খেলা শুরু হতেও আর বেশি দেরি নেই। রিলিফের নামে অর্থ সংগ্রহ এবং তার শেষ কোথায় গিয়ে পৌছবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনাও শুরু হয়ে গেছে।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক, এ দেশের কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের প্রতিক্রিয়া। বামপন্থী আন্দোলনে লালিত হয়েও সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে তাদের চিন্তাধারা আজও মুক্ত নয়। বহু জায়গায় শুনেছি এঁদের বলতে “১৯৪৭ সালে ওরা আমাদের এমনি করে তাড়িয়ে ছিল; আজ ঠেলা বুঝুক?’ ওঁরা ভুলে যান পূর্ববঙ্গের আজকের মুসলমান যুব সম্প্রদায় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতায় পুষ্ট। যে আনসার বাহিনী আজ রণাঙ্গনে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে আর ১৯৪৭ সালে সীমান্তে যে আনাসাররা হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিঃস্ব করে বার করে দিয়েছিল, তাদের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক ঘটে গেছে গত চব্বিশ বছরে। পূর্ববাংলায় পদার্পণ করলে, সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বললে, যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, সাম্প্রদায়িকতা সেখানে আজ বিলুপ্ত। কে হিন্দু কে মুসলমান- এ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। চব্বিশ বছর পূর্বে কিছু স্বার্থান্বেষী নেতার কথায় বিহ্বল একদল মানুষ দেশভাগে সায় দিয়েছিল এবং সেই দেশভাগে আমাদের এ দেশের হিন্দু নেতাদেরও যথেষ্ট অবদান ছিল। অতীতের সেই ভুলের জন্য, তাদের পুত্র-কন্যাদের বর্তমান সঙ্কটের জন্য সমস্ত মুসলমান সমাজকে দায়ী করে এ দেশের যে হিন্দুরা প্রতিশােধ বাসনা চরিতার্থ করছেন, তাঁরা এক ধরনের বিকৃত আনন্দে মগ্ন।
আবার আর এক ধরনের মানসিকতা লক্ষ করি উত্তর ভারতের উর্দুভাষী হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে। দিল্লীর পাঞ্জাবি ও অবাঙালিরা শুরুতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বেশ মাতামাতি করেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই হাওয়াটা অন্যদিকে ঘুরতে লাগল। এমন কথাও শুনলাম যে, পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা বাড়াবাড়ি করছে; তাদের প্রতি কোনাে অর্থনৈতিক বৈষম্য করা হয়নি। যে পাঞ্জাবি হিন্দুরা পাঞ্জাবি মুসলমানদের দু’চোখে দেখতে পারতেন না (পশ্চিমের ও পুবের বাঙালিদের মধ্যে যে সম্প্রীতি গত কয়েক বছরের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তা পাঞ্জাবে কখনই হয়নি) রাতারাতি তারা হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। পাঞ্জাবের একজন মন্ত্রী বলে বসলেন যে, পূর্ববাংলার ঘটনা নিয়ে ভারত সরকারের বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়, কারণ তাহলে দুই পাঞ্জাবের মধ্যে যে সম্প্রীতি তাতে চিড় খাবে। এদের। অতীতাশ্রয়ী বাঙালি বিদ্বেষী মনােভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
আর উর্দুভাষী মুসলমানরা একটু আতঙ্কগ্রস্ত। তারা বুঝতে পারছেন পাকিস্তান দেশ হিসেবে আর বেশিদিন টিকে থাকবে না। এ দেশে প্রায়ই যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে, তার হাত থেকে উদ্ধার পাবার জন্য এই উৎপীড়িত মুসলমানরা একমাত্র পাকিস্তানেই আশ্রয় পেতেন এতকাল। ভারতবর্ষে ভবিষ্যতেও দাঙ্গা বাঁধবে; কিন্তু পাকিস্তান না থাকলে এঁরা কোথায় যাবেন- এই ভয়টা স্বভাবতই এঁদের পেয়ে বসেছে।
এসব নানা স্তরের নানা স্বার্থ প্রসূত উদ্দেশের ফলে দেখা যাচ্ছে যে, পূর্ববাংলার মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে দাঁড়াবার লােক খুব অল্প। চিরাচরিত ধারায় আমাদের উৎসাহ-উদ্দীপনাও রেডিও সংবাদপত্রের নাটুকেপনা, ব্যবসাদারদের সুযােগ সন্ধানে ও রাজনৈতিক দলগুলাের কুটিল হিসেবের দর কষাকষিতে পর্যবসিত হয়ে যাচ্ছে।

সূত্র: দর্পণ
২৩.০৪.১৯৭১