You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | বঙ্গবন্ধু-হত্যার রায় কার্যকর করতে বিলম্ব কেন - আবু সাইয়িদ - সংগ্রামের নোটবুক
১, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে সামরিক-বেসামরিক খুনিচক্রের হাতে নিহত হন জাতির পিতা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার। পরিবারবর্গ। ২৬ সেপ্টেম্বর ‘৭৫ মােশতাক জারি করে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তার অনুগত জাতীয় সংসদে সংবিধানের ৫ম সংশােধনী পাস করিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সব সামরিক আইনবিধি কার্যক্রমকে বৈধতা দেন। ৭৫-পরবর্তী ক্ষমতাসীন চক্র খুনিদের পৃষ্ঠপােষকতা, পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক দল ও শক্তি সবসময়ই ছিল বঙ্গবন্ধুহত্যার বিচারের দাবিতে সােচ্চার। | ২, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয়ী হলে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করেন পঁচাত্তরে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাসভবনের রেসিডেন্ট পিএ আ,ফ,ম, মহিতুল ইসলাম। এদিনই গ্রেফতার হয় মােশতাকের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর। এর আগেই বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৩ আগস্ট ভােরে গ্রেফতার হয় কর্নেল ফারুক ও কর্নেল শাহরিয়ার। পরে গ্রেফতার হয় আরও দুজন—লে, কর্নেল মহিউদ্দিন (আটিলারি) ও অনারারি লেফটেন্যান্ট আব্দুল ওয়াহাব জোয়ারদার।
 
১২ নভেম্বর ‘৯৬ জাতীয় সংসদে পাস হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিল। বিএনপি সেদিন সংসদ বয়কট করে। পরবর্তীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল বিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কর্নেল ফারুকের মা মাহমুদা রহমান ও কর্নেল শাহরিয়ার সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে দুটি পৃথক রিট মামলা করেন। ৯৭-এর ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে ওই দুটো রিট মামলা খারিজ করে দেন। তদন্ত শেষে এএসপি। কাহহার ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার চার্জশিট বা অভিযােগপত্র প্রদান করেন ১৫ জানুয়ারি ৯৭। সবার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২, ৩৪,১২০বি ও ২০১ ধারায় হত্যা, হত্যার সহযােগিতা, হত্যার ষড়যন্ত্র ও হত্যার আলামত বিনষ্টের অভিযােগ আনা হয়। আসামি করা হয় ২০ জনকে। সাক্ষী ৭২ জন। খন্দকার মােশতাক, মাহবুব আলম চাষী, ক্যাপ্টেন এম মােস্তফা আহম্মদ—এই কজনের আগেই মৃত্যু হওয়ায় আসামি-তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। আসামিদের মধ্যে শেষ অবধি গ্রেফতার হয় ৬ জন, পলাতক থেকে যায় ১৪ জন। বিচারপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাখার জন্য সরকার প্রচলিত আইনে সাধারণ আদালতেই বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়। | ৩, এ অবস্থাতেই চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত থেকে মামলা ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য স্থানান্তরিত হয় ১ মার্চ ‘৯৭। আসামি, আইনজীবী ও বিচারকের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে সরকার ঢাকা জেলা ও দায়রা জজের আদালত চিহ্নিত করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ৩ মার্চ ‘৯৭। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম সুলের আদালতে মামলার চার্জ গঠন হয় ৭ এপ্রিল ‘৯৭। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ৪ মে ৯৭ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার কার্যক্রম ৪ সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে। হাইকোর্ট যােবায়দা রশিদকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আদেশ দেন ১৪ মে ১৭। মামলার আসামি সংখ্যা ২০ থেকে কমে ১৯ হয়।
 
৪, অবশেষে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে স্থাপিত ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গােলাম রসুলের আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কাক্রিম শুরু হয় ৬ জুলাই ৯৭। মামলার কার্যক্রমের প্রতিদিনে এই আদালত ও আশপাশের এলাকায় নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা, পুলিশের পাশাপাশি নিয়ােজিত করা হয় বিডিআর। পলাতক ১৪ জন আসামির প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র ১৪ জন আইনজীবী নিয়ােগ করে। আদালতের অনুমােদন সাপেক্ষে গ্রেফতারকৃত ৫ আসামির নিকট আত্মীয়, সাংবাদিক ও দর্শক-শ্রোতাদের মামলার কার্যক্রম অবলােকনের সুযােগ নিশ্চিত করা হয়। কখনও সপ্তাহে ৫ দিন, কখনও ৩ দিন এভাবেই সাধারণত মামলার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। কাঠগড়ায় উপস্থিত ৫ আসামির আইনজীবীরা মামলার কার্যক্রম ব্যাহত প্রলম্বিত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করেন। বিচারক কাজী গােলাম রসুলের গুরুতর অসুস্থতাজনিত কাৱাণেও মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকে প্রায় দেড়মাস। বিএনপি জামায়াতসহ বিরােধীদলীয় হরতাল আন্দোলনের কারণেও মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। | ৫, এতসব প্রতিকূল অবস্থা মােকাবেলা করে পরিচালিত হয় এ মামলার কার্যক্রম। সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে শেষপর্যন্ত ৬১ ব্যক্তি এ মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেন। এদের মধ্যে ৩৯ জন সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বা কর্মরত সদস্য, ২২ জন বেসামরিক ব্যক্তি। বিচার কাজী গােলাম রসুল আসামিদের বিরুদ্ধে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ পড়ে ও শুনিয়ে কাঠগড়ায় উপস্থিত ৫ আসামির মতামত নেন। এরা সবাই নিজেদের নির্দোষ দাবি করে । সবশেষে হয় রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আইনি যুদ্ধ আরগুমেন্ট বা যুক্তিতর্ক প্রদর্শন। রাষ্ট্রপক্ষে মুখ কৌসুলি সিরাজুল হক ও ১৯ আসামির ১৯ আইনজীবী স্ব-স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে আরগুমেন্ট উপস্থাপন করেন, সহযােগী আইনজীবীরা দেন সহায়তা।
 
১৩ অগোবর ‘৯৮ শেষ হয় মামলার দীর্ঘ শুনানির পালা। পায় দেড় বছরব্যাপী ১৪৯ কার্যদিবসে অনুষ্ঠিত হয় এই শুনানি। শুনানির সমাপনী দিনে বিচার কাজী গােলাম রসুল ৮ নভেম্বর ‘৯৮ সকাল ১০ টায় মামলার রায় ঘােষণার দিনক্ষণ নির্ধারণ করেন।
 
এই মামলার দীর্ঘ রায়ে আসামি ১, লেকর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, ২, লে, কনেলি সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, ৩, লে. কর্নেল মহিউমিন আহমেদ (আর্টিলারি) ৪, পলাতক মেজর বজলুল হুদা ৬, পলাতক লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম ৭, মেজর শরিয়ল হােসেন ওরফে শরফুর হােসেন ৮, লে. কর্নেল এএইচ এমৰি নুর চৌধুরী ১১, লে, কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশা ১২, ক্যাপ্টেন মো, কিম হাশেম ১৩, ক্যাপ্টেন নাজমুল হােসেন আনসার ১৪, ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ ১৫. রিসালদার মােসলেমউশিন ওরফে মােসলেম উদ্দিনকে দবি, ৩০২/৩৪ ধারার অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। রায়ে বলা হয়, ‘একটি ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রকাশ্যে তাহাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ হইল। নির্দেশ মােতাবেক তাহাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর কবিতে লকের কোনাে অসুবিধার কারণ থাকিলে তাহাদের মৃত্যুর প্রচলিত নিয়ামানুসারে হাসিতে ঝুলাইয়া কার্যকর করার নির্দেশ রইল । আসামি ১. তাহের উদ্দিন ঠাকুর ২. অনারারি ক্যাপ্টেন আব্দুল ওহাব জোয়ারদার ৩, দফাদার মারফত আলী ও ৪, এলজি আবুল হাশেম মুথাকে অন্য কোনাে মামলায় প্রয়ােজন না হইলে এই মামলা হইতে অবিলম্বে মুক্তি দেয়ার নির্দেশ হইল।’
 
৬, ‘৯৬ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ৮ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদের এক সিদ্ধান্তে ১৫ আগস্টকে জাতীয় শােক দিবস হিসেবে ঘােষণা করে। প্রজ্ঞাপন জারি হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও সরকারি ছুটি ঘোষিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতা, এই মর্মে সংসদে আইন পাস হয়। অফিস-আদালত, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজে জাতির পিতার প্রতিকৃতি পুনঃস্থাপিত হয়। | ২০০১ সালে বিএনপি জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ১৫ আগস্ট ছুটি বাতিল করে জাতির পিতার আইনি স্বীকৃতি সংসদে রহিত করে এবং প্রতিকৃতি টেনেহেঁচড়ে নামিয়ে ফেলে। এতে অবশ্য বেদনাহত হওয়ার কি নেই। আজ প্রমাণিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমান সংশ্লিষ্ট ছিলেন। খুনিদের সঙ্গে তার যােগাযোেগ, সেজন্য বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অনুষ্ঠানের পথ রুদ্ধ করা, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি, খুনিদের দেশে-বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদায় চাকরিতে পুনবাসন ও বঙ্গবন্ধু হত্যার তদন্তানুষ্ঠানে বাধা প্রদান করে। একই পথে বেগম খালেদা জিয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ইতিহাসবিকৃতির সব আয়ােজন ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
 
৭, দীর্ঘ আট বছর অতিক্রান্ত। বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের রায় আজও কার্যকর হয়নি। অতীতের সরকার করেনি। কিন্তু বর্তমান নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখনও নীরব কেন? বিগত জোট সরকারের পথে কেন তারা হাঁটবেন? বর্তমান নির্দলীয় সরকার ইতিহাসবিকৃতির ধাৱা বন্ধ করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে থার উদ্যোগ নিয়েছে। সেনাপ্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে  পাঠ্যপুস্তকে জাতির পিতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতির পিতাকে স্বমহিমায় ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়নি। সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে জাতির পিতার প্রতিকৃতি দৃশমান নয়।
 
সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট নানা টালবাহানায় সুপ্রিমকোর্টে বিচারকের পদ শূন্য রেখে হত্যার বিচারের পথে পদে পদে বাধা সৃষ্টি করেছে। এখন তাে সে অসুবিধা নেই। রায় কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিচারকের স্বল্পতা নেই। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবিলম্বে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় কার্যকর করে জাতির মাথায় যে কলঙ্কের তিলকচিহ্ন রয়েছে তা দূর করতে অবিলথে উদ্যোগী ও কার্যকর ভূমিকা নেবে, দেশবাসীর তাই প্রত্যাশা। | ৮, ইতিহাস সত্য বলে। কালাে মেঘের অন্ধকার কেটে সত্য-সূর্যের কিরণ ছড়িয়ে পড়ছে। বিবিসির জরিপে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঞ্জলি। মহাকালের ইতিহাস প্রভাত সূর্যের স্নিগ্ধতায় মহামানবের আসনে আজ তিনি বরিত। ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস পালন ও সরকারি ছুটির বিধান বাতিলের আদেশকে ২৭ জুলাই ২০০৮ অবৈধ ও বেআইনি ঘােষণা করেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এমএ রশিদ ও বিচারপতি মােঃ আশফাকুল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এক রায়ে এ আদেশ দেন। এ রায়ের পর সরকার ১৫ আগস্ট জাতীয় শােক দিবস পালন ও সরকারি ছুটি ঘােষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন যে কাজটি করতে হবে তা হল বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় অবিলম্বে কার্যকর করা।
 
যুগান্তর ১৪ আগস্ট ২০০৮
সূত্র: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী