পূর্ব বাংলায় খান আবদুল কাইয়ুম খানের আগমন উপলক্ষে ‘মিল্লাত’ ও ‘আজাদ’ পত্রিকায় শেখ মুজিবের বিবৃতি
১০ আগস্ট ১৯৫৩ তারিখের পাকিস্তানী গোয়েন্দা রিপোর্টে জানা যায়, পূর্ব বাংলায় খান আবদুল কাইয়ুম খানের আগমন উপলক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের দুটি বিবৃতি যথাক্রমে ‘মিল্লাত’ ও ‘আজাদ’ পত্রিকায় ছাপা হয়।
‘মিল্লাত’ পত্রিকার বিবৃতিটি নিম্নরূপ –
মুসলিম লীগের সমালােচনা
- শেখ মুজিবুর রহমান
খাদ্য কৃষি ও শিল্প সচিবের মুখ হইতে যেই সকল আশাবাদি মহল নতুন কিছু শুনিবার আশা করিয়াছিলেন খান আবদুল কাইয়ুম খানে পূৰ্ববংগ সফর তাহাদের সেই মােহ ভাংগিয়া দিয়াছে। এক শ্রেনীর লােকের আশাবাদের পরিবর্তে সীমান্তে “মহান” খান গতানুগতিক পন্থায় মুসলিম লীগ হােমরা চোমরাদের ন্যায় গাল ভরা বুলি আওড়াইয়াছেন। পূর্ব পাকিস্তানের শােচনীয় খাদ্য সঙ্কট , দুর্ভিক্ষ পাট ব্যবসায়ে কেলেঙ্কারি এবং অন্যান্য বর্তমান সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কোন আলােচনা না করিয়া তিনি আসল সমস্যা এড়াইয়া গিয়াছেন। তিনি যাহা করিয়াছেন তাহা হইতেছে এই যে, অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ন্যায় ইতিপূৰ্ব্বে মৃত মুসলিম লীগকে পূনরুজ্বীবিত ও নিজকে আগামি নির্বাচনে মুসলিম লিগের বিজয় সম্পর্কে একজন ভবিষ্যত্বক্তা প্রমানিত করার কসরৎ করিয়াছেন।
খান অবদুল কাইয়ুম খান সম্ভবতঃ পাকিস্তানের এই অংশের জনগনের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে অবহিত নন। এবং সেই জন্যই তিনি পূর্ব বংগের সহিত তাহার নিজ প্রদেশের সহিত তুলনা করিয়া মস্তবর একটা ভুল করিয়াছেন। খান আবদুল কাইয়ুম খান আরও জানেন না যে, এখানকার তাহার বন্ধুরা কিভাবে অপমানিত, অপদস্ত ও ঘৃণিত হইতেছেন এবং যেখানেই যান সেখানে কাল পতাকা দ্বারা সম্বৰ্দ্ধিত হইতেছে। এই জন্যই তাহার সম্মানার্থে এখানে কোন প্রকাশ্য সভার বন্দোবস্ত না করিয়া নারায়নগঞ্জ ও ঢাকার পাবলিক হলে সেখানে তিনশত লােকেরও স্থান সঙ্কুলান হয় না। সেখানে ২টি সভা করিয়াছেন। যদি তিনি কোন প্রকাশ্য সভা করিতেন তবে তিনি জনগনের নাড়া অনুভব করিতে সক্ষম হইতেন। তিনি যে উহা করেন নাই সেই জন্য খােদাকে ধন্যবাদ।
আমি খান আবদুল কাইয়ুম খানকে তাহার নিজ প্রদেশের মধ্যেই তাহার এসব বড় বড় বুলি সীমাবদ্ধ রাখিতে অনুরােধ করি। তথায় তিনি তাহার প্রসংসা পাইতে পারেন। যদি তিনি স্বীয় শক্তি ও ক্ষমতা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চান তবে আমি তাহাকে ও তাহার বন্ধু জনাব নুরুল আমীনকে ব্যবস্থা পরিষদের যে কোন শুন্য আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে অনুরােধ করি। জনগনের অনবরত দাবি সত্ত্বেও মুসলিম লীগ নির্বাচনে সাহসী হইতেছেন।
খান আবদুল কাইয়ুম খান, আওয়ামী লীগকে মােশমা প্রতিষ্ঠান বলিয়া আখ্যায়িত করার সৎসাহস কোথায় পাইলেন। উপরােলিখিত যে কোন আসনে যে কোন আওয়ামি লীগ পন্থার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্ধীতা করার জন্য আমি তাহাকে চ্যালেঞ্জ করিতেছি। তাহা হইলেই তিনি আওয়ামী লীগের স্বরুপ জানিতে পারিবেন।
মুসলিম লীগ সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই শ্রেয়ঃ। মুসলিম লীগ সভাপতি খাজা নাজিমুদ্দিনের পদচ্যুতি ও তাহার অপমানজনক পদত্যাগের সময় মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ যে ভুমিকা অভিনয় করিয়াছেন তাহা জনসাধারণ এত শীঘ্রই ভুলিতে পারে নাই।
‘আজাদ’ পত্রিকার বিবৃতিটি নিম্নরূপ –
কাইয়ুম খানের পূর্ববঙ্গ সফর
– শেখ মুজিবুর রহমান
খাদ্য, কৃষি ও শিল্প সচিব খান আবদুল কাইয়ুম খানের পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের ফলে যাহারা নুতন কিছু আশা করিতেছিলেন তাঁহারা সম্পূর্ণ নিরাশ হইবেন। তিনি গুরুতর খাদ্য পরিস্থিতি, দুর্ভিক্ষ, পাটের কারবারে দূর্নীতি প্রভৃতি সম্পর্কে কোন কিছু না বলিয়া পূৰ্ব পাস্তিানের সমস্যাবলীকে এড়াইতে চেষ্টা করিয়াছেন। তিনি আসলে অন্যান্য লীগ নেতাদের মতই লীগ প্রতিষ্ঠানকে পূনরুজ্জীবিত করার জন্য বৃথা চেষ্টা করিয়াছেন এবং পরবর্তী নির্বাচনে মােছলেম লীগেরই জয় হইবে বলিয়া ভবিষ্যদ্বানী করিয়াছেন। কিন্তু জনাব কাইয়ুম খান সম্ভবতঃ পাকিস্তানের এই অঞ্চলের জনসাধারণের রাজনৈতিক চেতনা সম্পর্কে অবগত নহেন। তিনি হয়ত জানেন না যে, তাঁহার এখানকার বন্ধুরা অপমানিত এবং বিকৃত হইয়াছে। তাহারা সর্বত্রই কৃষ্ণ পতাকার দ্বারা সংবর্ধিত হইয়া থাকেন। এই কারণেই তাঁহারা তাঁহার সম্মানার্থ কোন জনসভার ব্যবস্থা করেন নাই। ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে পাবলিক হলে যে সভার আয়ােজন করা হইয়াছিল তাহাতে মাত্র দুই তিন শত লােকের স্থান সঙ্কুলান হইতে পারে। কোন প্রকাশ্য জনসভায় যােগদান করিলে তিনি জনসাধারনের প্রকৃত মনােভাব বুঝিতে পারিতেন।
খান আবদুল কাইয়ুম খান আওয়ামী লীগকে ভুইফোড় প্রতিষ্ঠান বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। আমি তাঁহাকে চ্যালেঞ্জ করিতেছি, পূর্ববঙ্গ পরিষদের যে কোন শূন্য আসনের জন্য আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সহিত প্রতিদ্বন্দিতার ব্যবস্থা করেন। তাহা হইলেই তিনি আওয়ামী লীগের প্রকৃত স্বরুপ উপলব্দি করিতে পারিবেন। [1, pp. 337–340]
References:
[1] S. Hasina, Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation, Bangladesh Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Declassified Documents Vol – III (1953). Hakkany Publisher’s, 2019.