You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.07 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | যাত্রা হল শুরু | সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: বুধবার ২৪শে মাঘ, ১৩৭৯ ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

যাত্রা হল শুরু

প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিল করার কাজ শেষ হয়েছে গত পরশুদিন। সকল দল মিলে প্রায় বারোশো’ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। মূলতঃ এই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছে। যদিও সরকারিভাবে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর চূড়ান্ত ঘোষণা এখনো হয়নি। গতকালের সংবাদে প্রকাশ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপালগঞ্জ ও ভোলা নির্বাচনী এলাকায় কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই; অর্থাৎ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বঙ্গবন্ধু এই দুটো আসন থেকে নির্বাচিত হবেন। এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বন ও পশুপালন মন্ত্রী জনাব সোহরাব হোসেন, কে. এম, ওবায়দুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ ও মোতাহার উদ্দিনের বিরুদ্ধেও কোন মনোনয়নপত্র দাখিল হয়নি। অতএব এঁরাও এরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন বলে নিশ্চিত বিশ্বাস। ছয়টি আসনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিপক্ষ প্রার্থী নেই-এই শুভসংবাদ কে আশ্রয় করেই আওয়ামী লীগের বিজয়ের শুরু হলো। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় সূচনা পর্বেই যেন আরও নিশ্চিত করে দিল। আর একে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা। অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের স্ব স্ব কর্মসূচীর মাধ্যমে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়েছেন। অবশ্য এখনও সে সকল কর্মসূচী জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। তবে ধরে নেওয়া যেতে পারে, তাদের একটি কার্যক্রম রয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরসমূহ থেকে ইতি পূর্বে বিভিন্ন প্রচার মন্তব্য নির্বাচন সম্পর্কে করা হয়েছিল। তারা নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিয়ে যথেষ্ট বাক-বিতণ্ডা করেছেন। সর্বোপরি জাসদ নেতৃবৃন্দ নির্বাচনে নিরপেক্ষতা থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশও করেছেন। গতকালের জাসদ সমর্থিত বাংলা দৈনিকটি কতকগুলো আজগুবি সংবাদ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে ক্ষমতাসীন সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়নি। জাসদ নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশনারের নিকট এ ব্যাপারে তাদের অভিযোগও পেশ করেছেন। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে শান্তিপূর্ণভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল হয়েছে। কোথাও কোনো ভিত্তি বা আশঙ্কার কারণ ঘটেনি। অবশ্য চিটাংগায়ের আর আর পাটকলের নিকট একটি অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ পাওয়া গেছে যাতে অনেকগুলো জীবন বিনষ্ট ও আহত হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে মনোনয়নপত্র দাখিল সংক্রান্ত কোনো কারণে সংযোগ নেই। এর পেছনে কোন শক্তি সক্রিয়তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু স্বার্থান্ধ বিশেষ রাজনৈতিক মহল টি নির্বাচনের এই মুহূর্তে উক্ত ঘটনাকে উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। এদিকে শান্তিপ্রিয় দেশ প্রেমিক মানুষের মনে সন্দেহ হয়েছে, যারা নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরেছে তারা নির্বাচনের পথ ছেড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এবং যাতে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন না হতে পারে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে এবং নিজের দোষ অপরের ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টা মেতেছে। নির্বাচনের আর মাত্র আঠাশ দিন বাকী। এই মুহূর্তে যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের সকলকে পৃথক পৃথক ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচন বানচাল কারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জাতির সামনে এ নির্বাচন শুতে একটি সরকার পরিবর্তনের পরীক্ষা নিয়ে থাক আনেনি-এসেছে জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের প্রত্যয় নিয়ে। এর বিরুদ্ধে যে অসভ্য চক্রান্ত চলুক না কেন তা প্রতিহত করতেই হবে।
আমরা নিশ্চিত বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিজয় অবধারিত। মনোনয়নপত্র দাখিলের সূচনাপর্ব থেকেই তা অনুমেয়। যারা এই বিজয়কে নিশ্চিত জেনেও নির্বাচন নিয়ে নেমেছেন তারা নির্বাচনের স্বাভাবিক গতিতে ব্যাহত করতে পারেন। এমন কেউ রয়েছেন যারা নির্বাচনকে বানচাল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারেন। আর সেই সন্ত্রাসী পথে অগ্রসরমান যারা তারাই আজ বিভিন্ন বাহানা করছেন। নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্ভট প্রশ্ন তুলছেন।
আসন্ন নির্বাচনে তাদের ন্যূনতম হলেও জামানত রক্ষা করার মত মনোবল রয়েছেন তারা নির্বাচন চান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ এর মধ্যেও তাদের সাংগঠনিক উৎফুল্লতা রয়েছে। কিন্তু যে সংগঠন দেশে অরাজকতা ও সন্ত্রাস সৃষ্ট এবং ভুয়া স্লোগান নিয়ে চলে লাভ করেছে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের নামে তা বানচাল করার অপপ্রসারেই লিপ্ত হয়েছে। এরাই আজ নিজেদের কারসাজিকে অপরের নামে চালাবার অপূর্ব কৌশল গ্রহণ করেছে। কতৃপক্ষ ও দেশবাসী এদের ব্যাপারে অবশ্যই সজাগ রয়েছেন বলে আমরা মনে করি। শান্তি ও শৃঙ্খলা মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচন পর্ব অতিক্রান্ত হোক-এটাই দেশপ্রেমিক’ জনসাধারণের ঐকান্তিক ইচ্ছা। সরকার জনগণের এই সদিচ্ছা পূরণে অবশ্যই সচেতন বলে আমরা বিশ্বাস করি।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

ভারতের নয়াদিল্লিতে এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘এক এশিয়া’ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জনারেল ডঃ কুর্ট ওয়ান্ড হেইম বলেন যে এশিয়ার সার্বিক উন্নয়নে স্বাধীন ও প্রাণবন্ত সংবাদপত্র এবং গণসংযোগ মাধ্যমগুলোর মুখ্য ভূমিকা রয়েছে।
ডঃ ওয়ান্ডহেইম ছাড়াও সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ গুনার মেইরডেল এ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে অভিমত প্রকাশ করেন যে সমালোচনা ছাড়া কোন সরকারি সত্যিকারভাবে সর্বাঙ্গ সুন্দর হতে পারে না। সুতরাং এ কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অবশ্যই প্রয়োজন। এতে পাঠকরাও জানতে পারবেন যে সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে তার শুধুমাত্র সরকারি প্রচার নয়।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আইন মন্ত্রী ডঃ কামাল গণসংযোগ মাধ্যমগুলোর যে একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে সে সম্পর্কে আলোকপাত করেন। যেকোনো দেশের সার্বিক উন্নয়নে যে সংবাদপত্র ও গণসংযোগ মাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা থাকা প্রয়োজন এ বিষয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না। এদেশের সাংবাদিকরাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন। ‘যা দেখবো তাই লিখব’ এবং লেখার স্বাধীনতা আমার থাকা প্রয়োজন এ দাবি সার্বজনীন।
সাবেক পাকিস্তানের আমলে আমরা দেখেছি সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করার জন্য নানারকম ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলেছে। কিন্তু সে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শেষপর্যন্ত সফল হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ বলেছেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আছে, কেউ বলেছেন নেই। প্রশ্নটি বিতর্কমূলক। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে উত্থাপিত হবে মূল বিষয়টিকে আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিশ্লেষণ করবো।
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে। সে সময় জনগণের সামনে শাসন ও শোষণের আসল চেহারাটা তুলে ধরার জন্য সংবাদপত্রসেবীদের কঠোর সংগ্রাম করতে হয়েছে। সে সময়ের যে ভাষা তা ছিল শাসন, শোষণ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার ভাষা। তারপর একটা রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের বর্তমান সরকার শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমে বদ্ধপরিকর। এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিকে উপহার দিয়েছেন সংবিধান। এক বছরের মধ্যে ঘোষণা করেছে নির্বাচনের দিন তারিখ। তাছাড়া একবারে শূন্য থেকেই বর্তমান সরকারকে যাত্রা করতে হয়েছিল। তাছাড়া চারটি মৌল আদর্শের ভিত্তিতে এগিয়ে দেশ যাচ্ছে অনাগত সুখী ও সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের দিকে। এ হল বাস্তব অবস্থা। অথচ এ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে যদি কেউ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সম্পূর্ণ ভূয়া তথ্য পরিবেশন করেন এমনকি দেশের চারটি মৌলনীতি বিরুদ্ধে সংবাদ নিবন্ধাদি প্রকাশ করতে থাকেন তখন তাকে কোন অবস্থাতেই প্রশ্রয় দেয়া যায়না বৃহত্তম জাতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে। একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো সরকারি প্রশাসনযন্ত্রে যারা রয়েছেন তারা অনেক সময় সমালোচনা সহ্য করতে চান না। নিজেদের প্রশাসনিক ত্রুটি-বিচ্যুতি ঢাকাবার জন্য নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের সামনে ভুল তথ্য পেশ করেন। এমনতো অবস্থায় কেউ যদি সেইসব ভুলত্রুটি তুলে ধরেন তখন তারা তাকে দেশের স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপ রূপে চিহ্নিত করতে উঠে পড়ে লাগেন। অথচ এ প্রবণতা যে দেশ ও জাতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক তা তারা বুঝতে চান না। এক্ষেত্রে যে সহনশীলতা থাকা প্রয়োজন তা তারা ভুলে যান। সুতরাং যারা সংবাদ লিখবেন তাদের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি সামনে দায়িত্ব রয়েছে দেশের ভবিষ্যৎ যাঁরা নির্ধারণ করবেন তাদের।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন