You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.02.06 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ওয়াল্ড হেইমের উপমহাদেশ সফর | সৌন্দর্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: মঙ্গলবার ২৩শে মাঘ, ১৩৭৯ ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৩

ওয়াল্ড হেইমের উপমহাদেশ সফর

জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম ভারতীয় উপমহাদেশের সফরে এসেছেন। তিনি ইতিমধ্যে ভারতে এসে পৌঁছেছেন। আগামী সাতই ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে যাবেন এবং নয়ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসবেন। মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম এর সফরের কোন বিশেষ ফর্মুলা নেই। তবে এশিয়ার এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সমস্যা আলোকেই দিল্লি- ইসলামাবাদ-ঢাকার সঙ্গে তিনি আলাপ আলোচনা করবেন। এতদ অঞ্চলের রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে মহাসচিবকে যে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে করবেন তা ভারতে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন। ‘যেখানেই আমরা চাই না কেন আমরা রাজনৈতিক সমস্যা নিয়েই আলোচনা করি।’ মহাসচিবের এই সফরের গুরুত্ব রয়েছে নিঃসন্দেহে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে একথা শান্তিপ্রিয় প্রতিটি রাষ্ট্রের স্বীকার করে। এবং যারা এইসব বুকে স্বীকার করে একমাত্র তাদের জন্যই জাতিসংঘ বা তার মহাসচিবের কিছু করণীয় থাকে। কিন্তু যারা শান্তির বাণী মুখে বলল কর্ম ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেন না তাদের বেলায় জাতিসংঘ অনেকখানি ব্যর্থ। ভারত উপমহাদেশে বাংলাদেশের জন্ম লাভের উদ্ভুত সমস্যাদি ছাড়াও পূর্ব থেকেই কিছু কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যার আজও কোন সম্মানজনক মীমাংসা হয়নি। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার কাশ্মীর সমস্যা বহু পুরানো। কিন্তু সেদিনও আমরা লক্ষ্য করেছি ভারতের সদিচ্ছা থাকা সত্বেও পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের একগুয়েমীর জন্য আজও কাশ্মীর সমস্যা আদতে যা কোনো সমস্যাই নয় তা নিয়ে পাকিস্তান তার যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তির প্রকাশ ও হুমকি প্রদর্শন করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ঘৃণা আক্রমণ থেকে স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তির স্বপক্ষে এবং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ তাঁর সুদীর্ঘ ইতিহাসে কতটুকু বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পেরেছে সে আলোচনায় না গিয়ে আমরা বলতে পারি ভারত উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘের বিশেষ কিছু করণীয় রয়েছে। আর তেমনি একটি প্রত্যয় নিয়েই যে মহাসচিব এর সফরে এসেছেন তাও আমরা আশা করতে পারি। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য সমস্যাদি মধ্যে পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালীদের সমস্যা একটি অন্যতম সমস্যা। এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে এ সমস্যা সমাধান হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের প্রায় একশতটি দেশ বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিল পাকিস্তান আজও বাংলাদেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে পারেনি। নিরীহ নিরপরাধ চার লক্ষ বাঙালি কে আটকে রেখে এবং তাদের উপর নির্লজ্জ নির্যাতন চালিয়ে বিশ্বের চোখে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে। এতে করে উপমহাদেশে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। এ ব্যাপারে অবশ্যই জাতিসংঘের করণীয় রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যকার আটক বাঙালি সমস্যার সমাধান সর্বাগ্রে হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ইতিপূর্বে এই আটক বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে জাতিসংঘসহ বিশ্বের শান্তিকামী দেশসমূহের কাছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বার বার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব মানবতার কাজে আটক অসহায় বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বার বার তাঁর যে আবেদন রেখেছেন তার প্রতি বিশ্ব-বিবেক যে সাড়া দেয়নি তা নয় তবু পাকিস্তানের অবজ্ঞা প্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে। আমরা আশা করি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আটক বাঙ্গালীদের দুর্ধর্ষ মহাসচিবকে না দেখাতে চাইলে তিনি তা দেখবেন এবং তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশে এই প্রথম আসছেন। বিধ্বস্ত বাংলার প্রতিটি পাকিস্তানি বর্বরতার নিদর্শন তিনি স্বচক্ষে দেখে যেতে পারবেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পূনর্গঠনের জন্য জাতিসংঘের আরও সাহায্য আমরা আশা করি। স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্য না হলেও কোন মত বেঁচে থাকার জন্যও সাহায্য প্রয়োজন। জাতিসংঘের এই মানবিক কর্তব্য আমাদের প্রতি সম্প্রসারিত হবে বলেই আমরা আশা করি। এবং এই সঙ্গে উপমহাদেশের তথা বিশ্ব শান্তির জন্য আমরা জাতিসংঘের নেতৃত্বে কাজ করে যেতে ও বদ্ধপরিকর বলে মহাসচিবকে আশ্বাস দিতে পারি। আর সেজন্যই জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি যে একান্ত অপরিহার্য তা উপলব্ধি করার জন্য আমরা তাঁকে অনুরোধ করছি।

সৌন্দর্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ

রাজনীতি, মনোনয়ন, নির্বাচন ইত্যাকার নানা খবরের মধ্যে একটা ভিন্ন স্বাদের খবর : ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছে পুষ্প প্রদর্শনী। গত রোববারের এই পুষ্প প্রদর্শনী এবং বাগান প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্যমন্ত্রী জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ এ ধরণের অনুষ্ঠানে এই প্রথম। প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতি। শুধু প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতার মধ্যে অনুষ্ঠানকে আবদ্ধ না রেখে সমিতি সেই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকেই-ঢাকা নগরীকে পুষ্পশোভিত করে তোলার জন্য একটি প্রস্তাব রেখেছে। মন্ত্রী মহোদয় তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে সমিতির কর্মকর্তাদের উক্ত প্রস্তাবে একটি নীলনকশা সরকারের কাছে পেশ করার আবেদন জানিয়েছেন।
বস্তুত নানা সমস্যার টানাপোড়নে পুষ্প চর্চার মত সৌন্দর্যের নিস্কলুয লালনকেও আমরা যেন ভুলতে বসেছি। বাস্তবতার নিদারুণ আঘাতে মানবিক অনুভূতি সুকুমার বৃত্তি গুলো আজ লোক পেতে বসেছে। যান্ত্রিক সভ্যতার অগ্রযাত্রা ও বাস্তববাদী চেতনা কখন অনুভূতির সুক্ষ মননকে ক্রমাগত পিষিয়ে দিচ্ছে তা একবার ভেবে দেখবার অবসরও যেন নেই। অথচ সুক্ষ সেই মানবিক অনুভূতি নিয়েই আমরা মানুষ। আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের চেতনা-একে বিকশিত করার প্রেরণা আসে সুন্দরের নিকট থেকে, সৌন্দর্যের সাধনা তাই চেতনার সাধনা, সভ্যতা ও মুক্তির সাধনা। আমাদের সংগ্রাম, আমাদের যা কিছু সবই সেই লক্ষ্যাভিমুখী। অথচ সেই সৌন্দর্য তা থেকে আমরা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় গভীরে রেখেছি। ঢাকা নগরীতে পুষ্পশোভিত করবার প্রস্তাব এসেছে। মূল পরিকল্পনা ও হয়তো কিছুদিনের ভিতর সরকারি দফতরে যাবে। তারপর একদিন শুরু হবে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ। আইল্যান্ডে আইল্যান্ডে যূঁই, বেলী, চামেলীর চাষ হবে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে ঢাকা শহর। অবশ্য এসব আমার কথা, একটা স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু তারপর? সমস্ত দেহকে ত্যাগ করে অঙ্গ বিশেষে মেয়াদ বৃদ্ধির প্রয়াস? সুস্থতা এতে আসেনা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি ঘটেনা। তবে প্রেরণা যোগাবে এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। সারা দেশব্যাপী ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ কি সম্ভব? এজন্য প্রয়োজন গণ মানসিক তাকে এখাতে বইয়ে দেবার। তেমন কোনো পরিকল্পনা কি রয়েছে জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতির কাছে?
আমরা জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতির এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই। তারা যে মানবিক অনুভূতি এই দিকটা ভেবে দেখেছেন সেজন্য জাতি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু একটা কথা এ প্রসঙ্গে না বলে পারছিনা। আমাদের জাতীয় চরিত্রের একটা দোষ হল কোন বিষয় নিয়ে অধিককাল লেগে থাকবার মানসিকতার অভাব। প্রবল উচ্ছাসে একটা বিষয় নিয়ে আমরা অতিসত্বর নিজেদের সংগঠিত করি কিন্তু উচ্ছ্বাসে প্রাবল্য কমে আসলেই আবার মিইয়ে পড়ি। পরিকল্পনা শুধু কল্পনায় থেকে যায় কাজ শুধু ‘আজ’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা আশা করব জাতীয় চিত্তবিনোদন সমিতি এর ব্যতিক্রম হিসেবে নিজেদের উপস্থাপিত করবেন। ঢাকা নগরীর পরিকল্পনা এবং সঙ্গে সঙ্গে গণ মানসিকতার উৎকর্ষ সাধনে তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সৌন্দর্যচর্চা এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের জনচিন্তা ও চেতনাই মূল কথা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন