You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.15 | আনন্দবাজার পত্রিকা | ঢাকা দখলের লড়াই - সংগ্রামের নোটবুক

আনন্দবাজার পত্রিকা
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বগুড়া মুক্ত। চট্টগ্রাম ও ঢাকার গভর্নরের প্রাসাদ জ্বলছে
ঢাকা দখলের লড়াই
খান শাহীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে মন্ত্রিসভাসহ
ডঃ মালিকের পদত্যাগঃ নিরপেক্ষ একালায় আশ্রয়

নয়াদিল্লী, ১৪ই ডিসেম্বর (ইউএনআই)- ঢাকায় ‘গভর্নরের’ বাড়ি ও অন্যান্য কয়েকটি লক্ষ্যস্থলে এখন আগুন জ্বলছে। গভর্নর ডঃ এ মালিক, তার মন্ত্রী পরিষদ ও ঊর্ধ্বতন অসামরিক কর্মচারীরা ইতিমধ্যে তাদের নিজ নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে নিরপেক্ষ এলাকা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পালিয়ে গিয়েছেন।

এই খবরে আরও জানা যায় যে, ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে এখন যুদ্ধ চলছে।

বাংলাদেশের জনসাধারণের যুগান্তকারী স্বাধীনতা সংগ্রাম এখন শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ঢাকায় পাকিস্তানীদের চূড়ান্তভাবে উচ্ছেদ করে একটি প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার গঠনের জন্য ভারতীয় সৈন্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান সরকার আজ বিকেলে সদলবলে পদত্যাগ করেছেন এবং ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে নিজেদের সরিয়ে এনেছেন।

ঢাকার শহরতলীতে প্রচণ্ড হাতাহাতি লড়াই চলছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় জোয়ানরা তীব্রবেগে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। একটি শক্তিশালী পাকবাহিনীর মোকাবেলা করে তাঁরা তাদের সম্পূর্ণভাবে পর্যুদস্ত করেছেন। ঢাকা শহরের সেনাবাহিনীর ছাউনির ওপর ভারতীয় গোলান্দাজ বাহিনী গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে।

এদিন রংপুর সেক্টরে শত্রু সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ডিভিশনাল হেডকোয়ার্টার বগুড়ার পতনের মধ্যদিয়ে ঐ সেক্টর মোটামুটিভাবে শত্রুমুক্ত হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

গভীর রাতে ঢাকা সেক্টরের আরো যে সংবাদ এসেছে, তাতে দেখা যায়, ভারতীয় জওয়ানরা শুধু জয়দেবপুর, টঙ্গী কালিক্টর দখল করেই ক্ষান্ত হন নি, তাঁরা আরো দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছেন। শহরতলীতে পাক সেনাবাহিনীর পুরো একটা ব্রিগেড আটক পড়েছে। ঐ বাহিনীর অধ্যক্ষ একজন ব্রিগেডিয়ার ও ময়মনসিংহ এর মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটারসহ কমপক্ষে ১২ জন জাঁদরেল পাক সেনাবাহিনীর এই ব্রিগেড জয়দেবপুর-টঙ্গীর নিকটে গিয়ে জমায়েত হয়েছিল। কিন্তু অতর্কিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী উপস্থিত হওয়ায় তারা আটক পড়েন।
চট্টগ্রাম সেক্টরে কুমিরার দক্ষিণে ভারতীয় জওয়ানরা বেশ জোরের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর জ্বলছে। তাছাড়া শ্রীহট্টের নিকটে একটি পেট্রোলিয়ামের পরিশোধনাগারও দখলে এসেছে।

দখলদার বাহিনীর প্রধান অধিনায়ক জেনারেল এ এ কে নিয়াজী অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়ায় ভারতীয় সৈন্যরা ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ঢাকার অভ্যন্তরে সামরিক লক্ষ্যস্থলগুলির উপর প্রচন্ড বোমা বর্ষণ করেন এবং তারা এখন শহরের মধ্যে এগিয়ে চলেছেন। ঢাকায় এবার তাদের রক্তাক্ত সংগ্রাম শুরু হয়েছে।

ভারতীয় সৈন্যদের একটি দল ঢাকা নগরীর ১১ কিলোমিটারের মধ্যে এগিয়ে গিয়েছিল। আর একটি মাত্র নদী অতিক্রম করলেই তারা শহরের অভ্যন্তরে যেয়ে পৌঁছবেন।

আজ দুপুরের দিকে একটি পাক পরিবহন বিমান থেকে পুস্তিকা ফেলে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে সব অবাংগালীদের হাতে অস্ত্র দিয়েছে তারা যেন নিজ নিজ এলাকা থেকে দ্রুত সরে যায়।

প্রকাশ, বাঙ্গালী পুলিশের মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে, এই সম্ভাবনায় পাক কর্তৃপক্ষ তাদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে।

উর্ধ্বতন অফিসারদের পদত্যাগের হিড়িক
বাংলাদেশে পাক সরকারের অধীনস্থ উচ্চপদস্থ অসামরিক অফিসাররা পদত্যাগ করেছেন বলে নয়াদিল্লীর এক সরকারী মুখপাত্র জানিয়েছেন। মুখপাত্র বলেন, সরকারের কাছে খবর এসেছে যে, এই অফিসাররা ঢাকার রেডক্রসের নিরপেক্ষ অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের সংখ্যা প্রায় ৬৫ জন। এই সংবাদটি ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধি মিঃ রেনার্ড জেনিভায় রেডক্রসকে পাঠিয়েছেন। ভারতীয় রেডক্রস আজ বেলা আড়াইটায় সংবাদটি পান। রেনার্ডের বার্তায় ছিলঃ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ শ্রেণীর অফিসাররা পদত্যাগ করছেন এবং রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকায় আশ্রয় চেয়েছেন। অবিলম্বে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সরকারকে খবরটি জানান। আমরা এখানে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া হয়নি।

ভারত সরকার নয়াদিল্লীর আন্তর্জাতিক রেডক্রস প্রতিনিধির উপরোক্ত অনুরোধে সম্মত হয়ে ঢাকার হোলিফ্যামিলি হাসপাতাল এবং ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলকে নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষণা করেছেন।

এছাড়া ভারত বর্ষের মধ্যে রেডক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটিকে কাজ করবার সুযোগ ভারত সরকার দিয়েছেন। মুখপাত্র আরো বলেন, নিরপেক্ষ এলাকা এবং ঢাকা সম্পর্কে ভারত জেনিভা চুক্তি অনুসরণ করছেন। এর অর্থ হচ্ছে আহত এবং অসুস্থ সৈন্য এবং অসামরিক নাগরিকদের আশ্রয়দান, রাষ্ট্রসংঘ এবং বিদেশীদের যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা করা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কও এই মর্মে ভারতীয় কমান্ডারদের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে মুখপাত্র বলেন, ব্যবস্থাগুলি কার্যকরী করতে হলে ঢাকার পাক দখলদার বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন। তাঁরা যেন নিরপেক্ষ এলাকা সামরিক প্রয়োজনে ব্যবহার না করেন। পিটিআই ইউএনআই।

ঢাকা থেকে রয়টারের অপর এক খবরে জানা যায় যে, পূর্ববঙ্গে অসামরিক সরকারের সমস্ত কাজকারবার সব বন্ধ হয়েছে।

পুলিশ ইন্সপেক্টর জেনারেল মিঃ এম এ চৌধুরীসহ প্রায় ১৬ জন পদস্থ সিনিয়র অসামরিক অফিসার আজ সকালে এখানে রেডক্রসের নিরপেক্ষ এলাকা বলে ঘোষিত ইন্টারকন্টিনেন্টালে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

‘গভর্নর’ মিঃ এ এম মালিকের বর্তমান মতলব জানা যায়নি। যারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেটালে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা মিঃ মালিকের লিখিত আদেশেই তা করেছেন। মিঃ মালিক তাঁদের নির্দেশ দিয়েছেন তাঁরা যেন কাজকর্ম বন্ধ করে নিরপেক্ষ এলাকায় পালিয়ে যান।

খুলনাকে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। পাক সেনাবাহিনী সেখানে ‘শেষ যুদ্ধ’ লড়ে চলেছে।
রংপুর সেক্টরে এদিন আরো যে কয়েকটি শহর ও অঞ্চল দখল করা হয়েছে, তার মধ্যে আছে খেতলাল, জয়পুরহাট ও খানসামা।

ভারতীয় বিমান এদিনও খুলনা, দৌলতপুর, গোকুল, খাসনামা, জয়দেবপুর ও ময়নামতির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছে। খুলনা, গোয়ালন্দঘাট, আড়িয়াঘাট ও সিরাজগঞ্জে শত্রুসেনারা লঞ্চে, নৌকাযোগে আক্রমণ করতে উদ্যোগী হয়েছিল। তবে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর
সাফল্যজনক আক্রমনের ফলে স্থল বাহিনীর অগ্রগতি অব্যাহত আছে বলে এখানে মনে করা হচ্ছে।

ঢাকার দিকে

পুর্বাঞ্চল কম্যান্ডের একজন মুখপাত্র কলকাতায় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বলেছেনঃ ভৈরব বাজারের দিক থেকে ভারতীয় জোয়ানের নির্দিষ্ট পথে ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে খবর হচ্ছে ঢাকায় পাক সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশেষ বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের প্রধান জেনারেল নিয়াজি ও ফরমান আলির মধ্যে বিশেষ মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। একজন এই প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে বলছেন। অপরজন তা অস্বীকার করছেন।

তিন দিক থেকেই ভারতীয় সেনারা যে এগিয়ে চলেছেন, তা ঐ মুখপাত্র এদিন স্বীকার করেছেন। বিমান থেকে যে সকল ছত্রী ভারতীয় সৈন্যকে গত দু’দিনে ঢাকার উপকণ্ঠে নামানো হয়েছিল, তারাও আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা ঢাকা শহরের মধ্যে প্রবেশ করেছেন বলে জানা গেছে।

শত্রুসেনা রক্ষাব্যূহ

উক্ত মুখপাত্র মনে করেন, পাক সেনারা ঢাকার রক্ষাব্যূহ আরো সুদৃঢ় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, ভারতীয় জোয়ানরা সব অবস্থায় মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।

আরো জানা গেছে, পাক সেনাদের হতাহতের সংখ্যা অনেক বেশী। ইতোমধ্যে ৪১০২ জন পাক সেনাকে বন্দী করা হয়েছে এবং ৪০৬৬ জন তাদের প্যারা মিলিটারি সৈন্যও ধরা পড়েছে।

বন্দী শত্রুসেনাপতি
কালিয়াকৈরে যে নয়জন পাক সেনাপতিকে বন্দী করা হয়েছে, তার মধ্যে আছেনঃ ৯৩নং ব্রিগেডের কম্যান্ডার খাদির খান, সিভিল আর্মড ফোর্সের সেক্টর কম্যান্ডার লেঃ কর্নেল মোহাম্মদ আকবর, ময়মনসিংহ-এর মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর লেঃ কর্নেল আমির মোহাম্মদ খান, ৯৩নং ব্রিগেডের মোহাম্মদ আকবর, রেঞ্জার্সের উইং কম্যান্ডার মেজর আসগর, মেজর আলধর, মেজর মসজিদ, বসির আহমেদ এবং ৯৩নং ব্রিগেডের ৩ নম্বর গ্রেডের জি এস এ ক্যাপ্টেন আনজাম।

ঢাকার দিকে ময়মনসিংহের পথ ধরে ভারতীয় জোয়ানদের যে দলটি এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের চলার পথে বিশেষ বড় কোন নদীর বাধা নেই বলে সামরিক বাহিনীর একজন অফিসার জানান। আর নরসিংদীর দিক থেকে যে দলটি রয়েছেন তা ঢাকা শহর থেকে প্রায় এগার মাইল দূরে। উত্তর ও পূর্বদিক থেকে বাংলাদেশের রাজধানী অভিমুখে ধাবিত ভারতীয় বাহিনী আশাব্যঞ্জক গতিতে এগুচ্ছে বলে ধরা হয়েছে। কারণ টাঙ্গাইল-এ ভারতীয় জোয়ান ও মুক্তিবাহিনীর সমবেত শক্তি কুর্মীটোলার ক্যান্টনমেন্টের চার পাঁচ মাইলের মধ্যে পৌঁছেছে।

আরো নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পাক জঙ্গী শাসকদের প্রধানরা তাদের কর্মস্থল ত্যাগ করে রেডক্রসের কাছে নিরপেক্ষ অঞ্চলে আশ্রয় চেয়েছেন; লেঃ জেনারেল নিয়াজি ঢাকা ধ্বংস হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চাইছেন। প্রকাশ, শুধু গোলান্দাজ বাহিনী নয়, ভারতীয় বিমান বাহিনী পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের উপর বিকেলের দিকে বোমা বর্ষণ করেছেন।

ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আরো জানিয়েছেনঃ স্থল বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেকশা’র বাণী সম্বলিত প্রচারপত্র বিমান থেকে গতকাল রাতে ঢাকা শহরে ফেলা হয়েছে। উক্ত মুখপাত্র আশঙ্খা প্রকাশ করেছেনঃ অসামরিক লোকজনদের এলাকায় যাতে সংঘর্ষ না হয়, তার জন্য বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে। তবে, ঢাকা মিলিটারী গ্যারিসন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করেছে। অবশ্য তাতে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের তিক্ততা বৃদ্ধি পাবে। আজ পুনরায় সামরিক মুখপাত্র বলেন, ভারতীয় গোলান্দাজরা অসামরিক লোকজনের ওপর গোলাবর্ষণ করছে না।

বগুড়ার পতন

বগুড়ার পতনের পর চারজন পাক অফিসার বন্দী হয়েছে। তবে একজন পলায়ন করতে সক্ষম হয়। পাক সেনারা রংপুর সেক্টরে ক্যান্টনমেন্টকে ঘিরে এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রামের বন্দর জ্বলছে

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কম্যান্ডের যুদ্ধ জাহাজ এদিন পুনরায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দরের ওপর বোমা ও রকেট নিক্ষেপ করায় বন্দরটি জ্বলতে দেখা গেছে বলে খবর এসেছে। এই দুই বন্দরের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার জন্যই এই আক্রমণ চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়া শত্রুদের অনেক ব্যারাক, হেড কোয়ার্টার ও ট্রানজিট ক্যাম্পের ওপর আক্রমণ করা হয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর দপ্তরখানা জানিয়েছেনঃ এই আক্রমণের ঘটনার পরে একটি জাহাজও বন্দর ছাড়তে পারেনি। চট্টগ্রাম বন্দর এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর চলার পথে মাত্র চার-পাঁচ মাইলের মধ্যে।
চট্টগ্রামের দিকে সাঁড়াশী অভিযান চালানো হয়েছে। তাছাড়া নৌবাহিনী শত্রুসেনাদের সব জলপথে যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। পূর্বাঞ্চলের নৌবাহিনী যখন এই যুদ্ধ চালাচ্ছিল, তখন ফ্ল্যাগসীপ বিমানের সাহায্যে আক্রমণের পুরোভাগে ছিল। তারা ‘অপূর্ব’ কাজ করেছে বলে দাবী হয়েছে। নৌবাহিনীর কোন ক্ষতি হয়নি।

শ্রীহট্টের অগ্রগতি

শ্রীহট্ট শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে এক গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের পেট্রোলিয়াম পরিশোধনাগারটি অক্ষত অবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনীরা দখল করেছেন। গতকাল বিকেলে যখন এটি দখল করা হয়, সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তখন সেখানে বারো হাজার গ্যালন পেট্রোলিয়াম ও পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্যাস ছিল। এই পরিশোধনাগার থেকে কুশিয়ারা নদীর তীরে অবস্থিত সার কারখানায়ও গ্যাস পাঠানো হতো। উক্ত মুখপাত্র আরো বলেন, পাক সেনাদের তিনটি বাহিনী ঐ পরিশোধনাগারটি রক্ষা করেছিল। কিন্তু ভারতীয় জোয়ান ও মুক্তিবাহিনী সমবেতভাবে তা আক্রমণ করেন; শত্রুপক্ষের অনেক লোক হতাহত হয়।

১৮ জন পাক সেনার মৃতদেহ এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে। শত্রুরা দুটি চীনের ভারী মেশিনগান, চারটি ভারী গাড়ি, কিছুসংখ্যক গোলা ও অন্যান্য অস্ত্র রসদ ফেলে গেছে। তিনজন আহত শত্রুসেনাকে বন্দী করা হয়েছে। শত্রুরা এই কারখানাটি ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু সার্থক হয়নি।

খুলনা রনাঙ্গন
এই রনাঙ্গনের শত্রুসেনাদের হতাহতের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কারণ, তারা মরণপণ করে লড়ছে। পদ্মার ওপরের হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিকটে ভারতীয় জওয়ানরা শত্রুদের পাঁচটি বন্দুক, একটি ট্যাঙ্ক, ৮৫টি গাড়ী এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র পেয়েছেন।

১৭৫টি পাক ট্যাঙ্ক
সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেনঃ গতকাল পর্যন্ত বিভিন্ন রনাঙ্গনে ১৭৫টি পাক ট্যাঙ্ক ও ৮৩টি বিমান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে ১৮টি ট্যাঙ্ক অক্ষত আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একদিনের যুদ্ধে নৌবাহিনীর একটি বিমান সমেত ৪১টি বিমান ও ৬১টি ট্যাঙ্ক খোয়া গেছে।
দৌলতনগরে (খুলনা ক্যান্টনমেন্ট) এদিক প্রচণ্ড লড়াই চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। শত্রুসেনাদের সঙ্গে তাদের গোলান্দাজ বাহিনী আছে। তবে, ভারতীয় জোয়ানরা তাদের কাছ থেকে দু’টি ট্যাঙ্ক কেড়ে নিয়েছে।

কুমিল্লা সেক্টরে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের দিকেও ভারতীয় সেনারা এগিয়ে চলেছে। ঐ ক্যান্টনমেন্টে এক হাজার পাক সৈন্য আছে বলে মনে করা হচ্ছে।

যশোর সেক্টরের দিক থেকে খুলনার দিকে যখন ভারতীয় জোয়ানরা এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তারা শত্রুদের ছ’টি ট্যাঙ্কের ক্ষতি করতে সক্ষম হন।

সর্বশেষ সংবাদে জানা গেছে, বগুড়ার নিকটে ইউনিসেফ-এর গাড়ীতে করে পাক সেনাবাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। সেনাবাহিনী গাড়ীগুলি আটক করেছেন।
মালদা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা শ্রী ধীরেন ঠাকুর জানাচ্ছেনঃ সীমান্তের ওপর থেকে পাওয়া খবরে প্রকাশ যে মুক্তিবাহিনী চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সেখানে জোর লড়াই হয়েছে। শিবগঞ্জ থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। পাক বাহিনী এখন রাজশাহী সদরে জমা হচ্ছে। মুক্তিবাহিনী সূত্রে প্রকাশ যে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শ্রীঘ্রই মুক্ত হবে।