হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৩ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
ঢাকার অদূরে ভারতীয় ছত্রীসেনাদের অবতরণ
অমিতাভ দাস গুপ্ত কর্তৃক
শনিবার বিকেল ৪টায় ঢাকার অদূরে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে ভারতীয় ছত্রীসেনারা অবতরণ করেছে। একইসময়ে, ভারতীয় স্থলবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে রাজধানীর দিকে এগিয়ে আসছে।
শুক্রবারে মেঘনার পশ্চিম পাড়ের অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করা অগ্রসরমান বাহিনী রবিবারে নরসিংদী মুক্ত করে এবং ঢাকার দিকে তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখে। রবিবার রাতের মধ্যে এই বাহিনী শহরের ৩০ মাইলের মধ্যে পৌঁছে যায়।
এ থেকে বলা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঢাকার উদ্দেশ্যে অভিযান খুবই চমৎকার ভাবে এবং পরিকল্পনামাফিক চলছে।
যে ছত্রীসেনারা বিপুল সংখ্যায় অবতরণ করেছে তাদের সাথে শত্রুপক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে এবং তারা শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলছিল। পূর্ব রণাঙ্গনের একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে জানা যায়, একজন পাকিস্তানী অফিসার ও অন্যান্য পদমর্যাদার ২২ জন নিহত হয়েছে এবং ১২ জনকে বন্দী করা হয়েছে। জানা গেছে যে, ঢাকায় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কারফিউ জারি করা হয়েছে।
ঐ এলাকায় চলমান যুদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের একটি পাল্টা আক্রমণের বিবরণ দিয়ে, এই মুখপাত্র বলেন, “ঢাকার দিকে আমাদের অগ্রগতি নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট”।
ভৈরববাজার-ঢাকা অক্ষে, নরসিংদী থেকে ভারতীয় বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসছে অবতরণকারী ভারতীয় ছত্রীসেনা এবং দক্ষিণের ময়মনসিংহ শহর থেকে এগিয়ে আসা বাহিনীর সাথে মিলিত হতে, তিনি বলেন।
মেজর জেনারেল জ্যাকব, চীফ অব স্টাফ, পূর্ব রণাঙ্গন, রবিবারে সাংবাদিকদের বলেন ঢাকার চারপাশে বাংলাদেশের বেশীরভাগ এলাকা মুক্ত করা হয়েছে।
এতে করে ভারতীয় সৈন্যরা হয়তো একটু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। তবে অপারেশন ঢাকা পরিচালনার ক্ষেত্রে ঢাকার চারপাশের ভৌগলিক অবস্থানগত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই তাদেরকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে নদী এবং জলাভূমির উপস্থিতির কারণে সৈন্য পরিচালনা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। তবে এসবকিছু বিবেচনা করেও বলা যায় যে তারা অত্যন্ত ভালো কাজ করছে।
অপারেশন ঢাকায় নিয়োজিত ভারতীয় সৈন্যদেরকে অতিরিক্ত সহায়তা দেয়ার জন্য মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ঢাকার অভ্যন্তরে হয়রানিমূলক কৌশল প্রয়োগ করা শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই তারা বেশ কয়েকটি জায়গায় শত্রুপক্ষের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং তাদেরকে ভালো আঘাত হেনেছে।
এই মুহূর্তে অপারেশন ঢাকা মূলত দুই দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে যার একটি ময়মনসিংহ থেকে টাঙ্গাইল হয়ে এবং অন্যটি মেঘনা নদী পার হয়ে ভৈরববাজারের দক্ষিন থেকে আসছে। ভৈরববাজার থেকে দক্ষিন দিকে অগ্রসরমান বাহিনীটির অগ্রগতি সন্তোষজনক যেখানে উত্তরদিকে ভারতীয় সৈন্যরা ময়মনসিংহ থেকে বেশ দ্রুত গতিতে টাঙ্গাইলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
মেজর জেনারেল জ্যাকব সাংবাদিকদের বলেন ঢাকার দিকে আসলে কয়েকটি বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনা করলে, নদী ও জলাভূমি এবং পাকিস্তানীদের দ্বারা বিপুল সংখ্যক ব্রিজ ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়ার কারণে সৈন্য পরিবহনে কিছু সমস্যা দেখা দিতে বাধ্য। তারপরেও ভারতীয় সৈন্যরা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হতে পারছে কেননা পাকিস্তানীরা বেশ মরিয়া হয়ে লড়াই করছে। যুদ্ধের গতি বেশ তীব্র তিনি বলেন।
অপারেশন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে ভারতীয় সৈন্যরা মেঘনা নদী অতিক্রম করেছে, যেটি প্রায় ১,২০০ গজ চওড়া এবং তারা সবাই এখন ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অতিরিক্ত শক্তি যোগানোর জন্য স্থানীয় অভিজ্ঞতা, ষ্টীমার, ইত্যাদি সবই কাজে লাগানোর সকল চেষ্টাই করা হচ্ছে। ভারতীয় কৌশলের কোন কিছু ফাঁস না করেই এটা বলা যায় যে ষ্টীমার, হেলিকপ্টার এবং অন্যান্য জলযান ব্যবহার করে বাহিনী গঠন চলমান রয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় অবস্থানরত গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানী কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার পেছনে হয়তো একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। তারা চুপিসারে বিমানে করে বা অন্যান্য উপায়ে এই চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে যে তারা এখনো পর্যন্ত সফল হতে পারেনি।
বিভিন্ন রণাঙ্গনে এখন পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যরা যে অগ্রগতি দেখিয়েছে তার বিশদ বিবরণ দিয়ে মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন যে ভারতীয় সৈন্যরা এই মুহূর্তে খুলনার উপর একটি বড়সড় আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে এবং “আমরা আশা করি অচিরেই আমরা সেখানে পৌঁছবো”।
শনিবারে কুষ্টিয়া মুক্ত হয় যেটি কঠিনভাবে রক্ষিত ছিল। সেখানে তীব্র যুদ্ধ হয়। শত্রুপক্ষ ভারতীয় ট্যাঙ্কগুলোকে আক্রমণ করে এবং অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করে রেখেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করার পর ভারতীয় সৈন্যরা এখন পদ্মা নদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
আরো পূর্ব দিকে, ময়মনসিংহ দখল করে নেয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়ে আসছে। এই মুহূর্তে তারা মধুপুরের ঘন জঙ্গলের কাছে রয়েছে। একইভাবে ভারতীয় সৈন্যরা জামালপুর থেকে দক্ষিন দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সিলেট সেক্টরে ঝাড়ামোছার অভিযান চলছে এবং পাকিস্তানী সৈন্যরা বিচ্ছিন্নভাবে চলাচল করছে এবং মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদেরকে সঙ্কেত দেয়া হচ্ছে ভারতীয় সৈন্যদের অবস্থান জানিয়ে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়ার জন্য।
ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ দিতে গিয়ে মেজর জেনারেল জ্যাকব বলেন যে পাকিস্তানী বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একটি যুদ্ধে ভারতীয় ক্ষয়ক্ষতিও অনেক বেশী হয়েছে কিন্তু বেশীরভাগ যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ স্বল্প থেকে মাঝারী ধরণের। পাকিস্তানীরা এখনো ময়নামতি সেনানিবাস দখল করে রেখেছে। অপ্রয়োজনীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সাধ মেটানো ভারতীয় সৈন্যদের অভিপ্রায় নয়। তাই তাদেরকে আত্মসমর্পণ করার জন্য আরেকবার সুযোগ দেয়া হবে। যদি তারা তা না করে তাহলে তাদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সংস্থাগুলো যোগ করেঃ রবিবারে ভারতীয় সৈন্যরা খুলনা সেনানিবাস (দৌলতপুর) পৌঁছে গেছে এবং শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে তুমুল যুদ্ধ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সামরিক মুখপাত্র বলেন পাকিস্তানীরা খুলনা এলাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে “একটি মরিয়া শেষ চেষ্টা” করছে বলে মনে হচ্ছে। যেহেতু চালনা এবং মংলা উভয় বন্দরই নৌবাহিনীর আক্রমণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের পালানোর আর কোন পথ নেই, তিনি যোগ করেন।
বাংলাদেশের আরো উত্তর পশ্চিমে, ভারতীয় সৈন্যরা শত্রুপক্ষের উপর চাপ বজায় রেখেছে হিলি ও গাইবান্ধা এবং ঘোড়াঘাট ও গোবিন্দগঞ্জ এর দিক থেকে দ্বি-মুখী আক্রমণ চালিয়ে। গোবিন্দগঞ্জের যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী চারটি শ্যাফি ট্যাঙ্ক, সাতটি কামান এবং দুটি আরসিএল আটক করে। আরও দুটি শ্যাফি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয় এবং ৬০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। চল্লিশজন শত্রুসেনাকে বন্দী করা হয়।
ভারতীয় বিমান বাহিনী শনিবারে কুষ্টিয়া সেনানিবাসে গুলি বর্ষণ করে ১০ টি রেল ওয়াগন এবং ১৫ টি যানবাহন ধ্বংস করে দেয়। তারা সিরাজগঞ্জ এবং ফুলছড়িঘাটে পিছু হটতে থাকা শত্রু সেনাদেরকেও আক্রমণ করে।
সকল মুক্ত এলাকায় পাকিস্তানের নিয়মিত বাহিনীর সদস্য এবং রাজাকাররা যারা বাংলাদেশ থেকে সাদা পোশাকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে তাদের ধরার জন্য পুর্নউদ্যমে অভিযান চলছে।
আমাদের সৈন্যরা হিলি এবং দিনাজপুরে শেষ প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছে সাঁজোয়া বহর ধ্বংস এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করার মাধ্যমে। পলাশবাড়ীর দক্ষিন পশ্চিমে অবস্থিত ঘোড়াঘাট যেটি বেশ কয়েকদিন টিকে ছিল রবিবারে মুক্তি বাহিনীর কাছে তার পতন হয়। মুক্তি বাহিনী পলাশবাড়ী থেকে ১৭ কিমি দক্ষিণে অবস্থিত গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত করে।
ঘোড়াঘাট এবং গোবিন্দগঞ্জ মুক্ত হওয়ার মাধ্যমে হিলি থেকে গাইবান্ধা পর্যন্ত ১২০ কিমি সড়ক এখন সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তানী সৈন্যমুক্ত।