আনন্দবাজার পত্রিকা
১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১
রাজনৈতিক সংবাদদাতা
মুক্তি সংগ্রাম ঢাকার দ্বারপ্রান্তে
বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই এখন বাংলার রাজধানীর দ্বারপ্রান্তে চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিসেনারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। মাঝে কয়েকটা নদী, পদ্মা আর মেঘনার শাখা-প্রশাখা। তারপরই ঢাকা। এবং এরপরই ঢাকার লড়াই-বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই।
এই চূড়ান্ত লড়াই-ই কি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লড়াই হবে, পাক সেনাবাহিনী কি ঢাকায় দখল বজায় রাখার জন্য মাটি কামড়ে যুদ্ধ করবে? কেউ জানে না। তবে ভারতীয় বাহিনী সেই বড় লড়াইর জন্য প্রস্তুত হয়েই ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে পূর্বাঞ্চলীয় সেনাধ্যক্ষ লেঃ জেঃ জগজিৎ অরোরা সাংবাদিকদের সেই কথাই জানালেন।
বললেনঃ ওরা কী করবে জানি না। তবে আমরা সেজন্য প্রস্তুত হয়েই এগোচ্ছি।
মুক্তিসংগ্রামীরা এগোচ্ছেন সব দিক থেকে। আশুগঞ্জ এখন মুক্ত। কিন্তু ওখানে মেঘনার ওপাড়ের বিরাট পুলটা পাক সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দিয়েছে। আর একটা বাহিনী এগোচ্ছেন দাউদকান্দির দিক দিয়ে। দাউদকান্দি থেকে পাক বাহিনী পালিয়েছে। উত্তর দিক থেকে মুক্তিসংগ্রামীরা এগোচ্ছেন জামালপুর হয়ে। ওদিক থেকে অবশ্যই পথ এখনও অনেকটা। তবে পথে কোনও বড় নদী নেই। এদিকে অর্থাৎ পদ্মার দিকে আমাদের সেনাবাহিনী মধুমতীর তীরে। মধুমতী পাড় হলেই পদ্মা তারপরই ঢাকা। কুষ্টিয়া মুক্ত করে আর একটা বাহিনী এগোতে চলেছে গোয়ালন্দ ঘাটের দিকে। গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর চাঁদপুর থেকেও আমাদের বাহিনী ঢাকার দিকে এগোবার জন্য প্রস্তুত।
ঢাকা মুক্ত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ে পুরোদমে যোগ দেবেন সব কটা বাহিনী-সেনা, বিমান এবং নৌ। বিমান বাহিনী লড়াইর প্রথম দিন থেকেই ঢাকা আক্রমণ শুরু করে দিয়েছেন। ঢাকার সামরিক এবং অসামরিক দুই বিমানবন্দরই এখন অকেজো। নৌবাহিনীও এগিয়ে আসছেন দুই নদীতে-পদ্মা এবং মেঘনায়। ঢাকা দখলের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নৌবাহিনীর গানবোটগুলিও পুরোদমে যোগ দেবেন।
জেনারেল অরোরাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাস করেছিলেন, ঢাকাকে মুক্ত করার পথে আপনার সামনে সবচেয়ে বড় বাধা কি? জেনারেল একটা কথায় জবাব দিলেনঃ নদী। এবং তারপরই বললেন, নদী অতিক্রমের ব্যবস্থা আমরা করে ফেলেছি।
আমাদের পদাতিক বাহিনী ও রসদ পারাপারের জন্য ব্যবস্থা চাই, কিন্তু আমাদের পিটি-৬৭ ট্যাংকগুলি নিজে থেকেই নদী সাঁতরে যেতে পারবে। তার জন্য স্টিমার বা লবির প্রয়োজন নেই।
বাইরে থেকে বা গোটা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ঢাকা রক্ষার জন্য সৈন্য আনাও পাক বাহিনীর পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। এর দুটি কারণ, আমাদের সেনাবাহিনী তাদের পালাবার পথ আটকে দিয়েছেন। সিলেট সেক্টরে তারা অবরুদ্ধ। উত্তরখণ্ডে দিনাজপুর-রংপুর অঞ্চলেও আটকে গিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশের আকাশে ঢাকার সব পথের ওপর নজর রাখছেন। পাকসৈন্যবাহী স্টিমার বা বোট দেখলেই আক্রমণ চালাচ্ছেন।
ঢাকার পাক বাহিনীর কত সেনা আছে? সে হিসাবও কেউই জানেন না। জেনারেল অরোরা এইদিনও বলেন, গোটা বাংলাদেশে ওদের চারটা ডিভিশন ছিল। এবং আমাদের সামরিক বাহিনী আগে বলেছিলেন, ঢাকায় রয়েছে একটা ডিভিশন। যদি তাই হয় এবং যশোর সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চল থেকে কিছু পাকসৈন্য গিয়ে সত্যিই ঢাকায় আশ্রয় নিয়ে থাকে তাহলে ঢাকায় অন্তত দেড় ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি ওদের অত সৈন্য ঢাকায় আছে? ঢাকার লড়াই শেষ হলেই তা জানা যাবে-তার আগে নয়।
ঢাকায় ওদের দূরপাল্লার ভারী কামানই বা কত রয়েছে? বাংলাদেশে এখন পাক বিমান বাহিনীর কোনও অস্তিত্ব নেই। তাই ঢাকার লড়াইয়ে ওদের মূলত নির্ভর করতে হবে দূরপাল্লার ভারী কামানের উপর। গোটা বাংলা যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোথাও পাক বাহিনী ভারী দূরপাল্লার কামান ফেলে যায়নি। যদি ওরা আগেভাগেই ভারী দূরপাল্লার কামানগুলি পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সরিয়ে না নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ঢাকার চূড়ান্ত লড়াইয়ে সে সব কামান দেখা যাবেই। হিলির যুদ্ধে নভেম্বর মাসেই ওরা ৩৫ মাইল পাল্লার কামান ব্যবহার করেছিল। ৩৫ মাইল পাল্লার দু’চারটি কামান শুধু সীমান্তের লড়াইয়ে ব্যবহার করে ওরা ভারতীয় বাহিনীকে ধাপ্পা দিতে চেয়েছিল, না সত্যিই ওই ধরনের কামান ওরা বাংলাদেশে আরও অনেক রেখেছিল ঢাকার লড়াইয়ে তাও বোঝা যাবে।
ঢাকা থেকে ইউপিআই এক খবরে জানিয়েছেন, আজ ভারতীয় সৈন্যরা অগ্রসর হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি থেকে নগরীর মধ্যে পশ্চাদপসরন করেছে।
ভারতীয় সৈন্যরা অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।
আমাদের লন্ডন অফিসের খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা থেকে সেখানে টেলিফোনে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে, অগ্রসরমান ভারতীয় বাহিনীর গোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অবস্থা খুবই সংকটজনক। ঢাকা শহর প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।