You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.08 | হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ডিসেম্বর ০৮, ১৯৭১, জাওয়ানদের যশোর ও সিলেট মুক্ত করা - সংগ্রামের নোটবুক

হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড ডিসেম্বর ০৮, ১৯৭১
জাওয়ানদের যশোর ও সিলেট মুক্ত করা
অমিতাভ দাস গুপ্ত

ভারতীয় সেনাদের দ্বারা মঙ্গলবারে সিলেট ও যশোর মুক্ত হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটা চরম পর্যায়ে পৌঁছে। দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের মুক্ত হওয়া বাংলাদেশে নির্বাচনের প্রথম জয়ন্তী নির্দেশ করেছিল যেটা স্বাধীনতার পথে একটা গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।

যশোরে অগ্রগামী ভারতীয় সৈন্যদের পাকিস্তানী আর্মির রক্ষণাত্মক অবস্থানের ধ্বংস সাধন ছিল উল্লেখযোগ্য এই মর্মে যে শত্রুরা আরও কঠোর যুদ্ধের জন্য ক্যান্টনমেন্টের এই বিভাগীয় সদর দপ্তরে(পাকিস্তানী বাহিনীর আর দুইটি বিভাগীয় সদরদপ্তর ছিল নাটোর ও ঢাকাতে) ঘাঁটি গেড়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর এই অবস্থানের বিচ্ছিন্নকরণ একটা বিশাল এলাকা খুলে দিয়েছিল খুলনা সেক্টরে ভারতীয় মিত্রদের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রসরের জন্য। আসলে, পাকিস্তানীরা ইতোমধ্যেই মঙ্গলা বন্দর পরিত্যাগ করেছিল এবং খুলনা ছেড়েছিল।

যশোর ও সিলেটের, বাংলাদেশের সুরমা ভ্যালির একটি গুরুত্বপূর্ণ চা শহর মুক্তি নিঃসন্দেহে নির্দেশ করে ভারতীয় সেনা পাকিস্তানী বাহিনীর উপরে পূর্ব সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে পুরোপুরি প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পাকিস্তানী সেনাদের কাছে ঢাকা ছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বাকী ছিল না।

এ পর্যন্ত যশোর সেক্টরের সংঘর্ষের সময় জুড়ে পাকিস্তানী বাহিনী ক্যান্টনমেন্টে গভীরভাবে আবদ্ধ হয়েও চেষ্টা করে যাচ্ছিল গত ৩৬ ঘণ্টা ধরে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধ করতে। আসলে, যশোর ক্যান্টনমেন্টে সোমবার সকালে যখন ভারতীয় আর পাকিস্তানী সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হল তুমুল যুদ্ধ হল। আন্দাজ করা হয় ব্রিগেডের পাকিস্তানী সেনারা প্রতিরক্ষী অবস্থান থেকে প্রতিরোধ করতে থাকে। মঙ্গলবার সকালে, যেকোনোভাবে, যখন ভারতীয় সেনারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে সুনির্দিষ্ট আক্রমণ করতে থাকল তখন পাকিস্তানী প্রতিরক্ষার মেরুদণ্ড ভাঙ্গা শুরু হয়েছিল। এটা নির্দেশিত হয়েছিল এই বিষয়ের দ্বারা যে ভারতীয় সেনারা বিমানঘাঁটিগুলো দখল করেছিল মঙ্গলবার সকালে। এটা সম্ভব ছিল ক্যান্টনমেন্ট এবং প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোতে ভারতীয় বাহিনীর সুপরিকল্পিত আক্রমণের জন্য।

এরপরেই ক্যান্টনমেন্ট ভূমিতে ভারতীয় সেনারা আবারও একটি আক্রমণ চালায় এবং এতে পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। এরপরে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং মঙ্গলবার বিকেলের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্ট সফলভাবে দখল করে। পাকিস্তানীরা আসলে যশোর শহরে নিজেরাই চলে গিয়েছিল কিন্তু এটাও ভারতীয়দের চলমান চাপের মুখে তাদের অকর্মণ্যতা প্রমাণ করে। রাত শেষ না হতেই পাকিস্তানী বাহিনী নদীর পূর্ব দিক থেকে যশোর শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় যাতে তারা কিছু সময় পায় পুনপ্রস্তুতির জন্য। এই প্রক্রিয়ায় যশোর শহর পুরোপুরি পাকিস্তানী মুক্ত হল।

যশোরের এই যুদ্ধের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে ভারতীয় সেনারা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট মুক্ত করার পরে আর কোন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। এটা আসলে পাকিস্তানীদের তড়িঘড়ি করে ঢাকার আশেপাশের প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা থেকেই বোঝা যায়। এই পুনরুদ্ধার দুই দিন এক রাতে শত্রুপক্ষ থেকে ভারতীয় সেনাদের প্রতিরোধ দ্বারা সহায়তা পেয়েছিল। যে কোন মূল্যে রিপোর্ট করা হয়েছিল যে পাকিস্তানী বাহিনিরা মাগুরার দিকে চলে যাচ্ছে।

একই চিত্র পাওয়া গিয়েছিল সিলেট শহরের যুদ্ধ থেকেও। আটটি আইএএফ হেলিকপ্টার ভারতীয় সেনাদের নামিয়ে দিয়েছিল শহরে যা পাকিস্তানীদের আকস্মিকভাবে পরাস্ত করেছিল।

যদিও এই যুদ্ধের বিস্তারিত তাৎক্ষণিক জানা যায়নি, এটা দৃশ্যমান ছিল যে পাকিস্তানী সৈন্যরা সম্পূর্ণ অবস্থানের হতাশার কথা বিবেচনা করে হাল ছেড়ে দিচ্ছিল। যদি এই সেক্টরের পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকার দিকে ফেরত নেওয়া হয়ে থাকে তাহলে একই প্রক্রিয়া ছিল ফরিদপুর এবং কুষ্টিয়াতে। এই রকম ফেরত নেওয়ার যাই উদ্দেশ্য থাকুক এই অবস্থা হয়েছিল যে ভারতীয় সেনারা যথাক্রমে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুমিল্লাকে বিচ্ছিন্নকরণে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল এবং কুমিল্লাকে বাইপাস করা হয়েছিল এবং ভারতীয়রা কুমিল্লা ও দাউদকান্দির একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সম্ভবত মেঘনার নিকটতম স্থানে পৌঁছানোর জন্য। অন্যদিকে ভারতীয় সেনারা মৌলভীবাজার মুক্ত করেছিল সমশেরনগরের দিক থেকে অগ্রসর হয়ে এবং ঢাকা ও সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌঘাঁটি চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

একজন সেনা মুখপাত্র বর্ণনা করেছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত আক্রমণগুলো পূর্ব সেক্টরের সমস্ত অঞ্চল জুড়ে পরিচালিত হচ্ছিল যাতে শত্রুরা আন্দাজের উপরেই থাকে। যশোর সেক্টরে একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ কেন্দ্র ঝিনাইদহ মুক্ত হল। যশোরের ২৫ মাইল উত্তরের এই জায়গাটা পাকিস্তানের এই অঞ্চলের প্রতিরক্ষার ভিত্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেনা মুখপাত্র এটা পরিষ্কারভাবে সংবাদকর্মীকে জানিয়েছিল যে পুরো অভিযানেই ভারতীয় সেনারা চমৎকার সহযোগিতা পেয়েছে মুক্তি বাহিনীর। তিনি এটাও পরিষ্কার করেছিলেন যে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মুক্তি সেনাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ভারতীয় সেনারা শুধু তাদের প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছিল যেখানেই সম্ভব হয়।

মাধ্যম যুক্ত করেছিলঃ “পাকিস্তানীরা দৌড়ের উপর আছে এবং পুনরুদ্ধারের গতি গত রাত থেকে অনেক দ্রুত”, একজন অফিশিয়াল মুখপাত্র দিল্লিতে বলেছেন।

পাকিস্তানীরা ভার্চুয়ালি স্বীকারোক্তি দিয়েছে তাদের নড়বড়ে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে যখন অফিশিয়াল রেডিওতে বলা হয়েছিল তারা যশোর খালি করেছে। একই রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও।

বিশাখাপত্তনমে পূর্ব নৌ কমান্ড সদরদপ্তরে পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী পাকিস্তানীরা মঙ্গলা পরিত্যাগ করেছে এবং খুলনা খালি করেছে।

পূর্ব দিকে নৌ সেনাদের এয়ারক্র্যাফট এবং ইউনিটের নৌ আক্রমণের কারনে পাকিস্তানী নৌ ক্র্যাফট এবং সেনা দল এই দুই জায়গা ছেড়ে যাচ্ছে।

সিলেট মুক্ত হয়েছিল ভারতীয় সেনাদের দ্বারা সকাল ১১টা ৩০মিনিটে মঙ্গলবারে।
এর আগে, ভারতীয় সেনারা সিলেটের শালুতিকর বিমানঘাঁটি মুক্ত করেছিল।

সিলেট শহর এবং বিমানবন্দর দখল হয়েছিল ভারতীয় স্থল ও নৌ সেনাদের দ্বিমুখী আক্রমণের দ্বারা।

এয়ার মার্শাল এইচ, সি, দেওয়ান এটা উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল যে আটটি হেলিকপ্টার ১০০ সেনা সম্বলিত বাহিনী দ্বারা সিলেট শহর এবং বিমানবন্দর দখলের জন্য প্রথমবারের মত অভিযানে পাঠানো হয়েছিল।

একজন সেনা মুখপাত্র বলেছিলেন, গোমতী নদি পার হবার সময় অগ্রগামী সৈন্যরা সুরক্ষিত ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টকে পশ্চিম থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকের রাস্তা বিচ্ছিন্ন করে।

মেহেরপুর, কালীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ছাতক সহ গত অন্য পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলো গত ২৪ ঘণ্টায় মুক্ত হয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনী ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল পদ্মার গোয়ালন্দ ঘাঁট দিয়ে রাজধানী ঢাকার দিকে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে।

এরপর দিনাজপুরের হিলিতে যুদ্ধ চলছিল পাকিস্তানী সুসজ্জিত অবস্থানের বিরুদ্ধে। ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী ব্রিগেডের বিরুদ্ধে নতুন আক্রমণ পরিচালনা করেছিল হিলিতে থেকে ফুলবাড়ি পর্যন্ত পেছন থেকে পূর্ব এবং উত্তর দিক থেকে শত্রুপক্ষকে ঘায়েলের জন্য।

ময়মনসিংহ সেক্টরে ভারতীয় বাহিনী পৌঁছে গেছিল জামাল্পুরের কাছে এবং যমুনার জগন্নাথগঞ্জ ঘাঁট এর দিকে এই শহর মুক্ত করার জন্য অগ্রগামী অভিযান পরিচালনা করছিল যা পশ্চিম তীরে বগুড়াকে একটি ব্রিজহেড প্রদান করেছিল।

গত ২৪ ঘণ্টার অভিযানগুলো নিয়ে বর্ণনায় মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব, চিফ অফ জেনারেল স্টাফ, পূর্ব কমান্ড সংবাদকর্মীকে কলকাতায় বলেছিল যে অন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন ছিল উত্তরে রংপুর জেলার লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি মুক্ত করা এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টকে এবং দক্ষিণপূর্ব সেক্টরে শহর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নকরণ।

আখাউরা দিয়ে ঢাকা আক্রমণ নিয়ে জেনারেল বলেছিল ভারতীয় সেনা শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভৈরব বাজারের এবং টঙ্গী জংশনের দিকে সরাসরি সংঘর্ষ করেছে যেটা রাজধানী শহরের দক্ষিণে ছিল।
অভিযানের অগ্রগতি নিয়ে জেনারেল জ্যাকব বলেছিল যে একবার পাকিস্তানী প্রতিরক্ষার বহির্ভাগ ভেঙ্গে গেলে অগ্রসর আরও ত্বরান্বিত হবে বর্তমানের চেয়ে। তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন পাকিস্তানীরা কিছু শহরে এবং কেন্দ্রে সুসজ্জিত হয়েছিল বাঙ্কার মাইনফিল্ড এবং আর্টিলারি অবস্থান নিয়ে ভারতীয় অগ্রসরকে রুখে দিতে।

বর্তমান অভিযানের দিকে গুরুত্ব দিয়ে জেনারেল জ্যাকব বলেছিল আমরা শহরগুলোকে বিবেচনা করিনি “আমরা জনগণকে আক্রমণ করতে চাইনা, এটা আমাদের নীতি বহির্ভূত”
মেঘালয় সেক্টরে সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মুক্ত হয়েছিল ভারতীয় সেনাদের দ্বারা।

একটি উপ-বিভাগীয় সদরদপ্তর হিসেবে অন্য জায়গায় ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে পতনের ফলে রিপোর্ট ছিল যে ঢাকা জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তানীরা সৈন্য বৃদ্ধি করছিল।
সাবেক পূর্ব বাংলা রাইফেলসের সদস্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় মুক্তি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে ময়মনসিংহ জেলার অনেক থানা মুক্ত করেছিল।

আসলে তারা লালমনিরহাটের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং পাকিস্তানীদের বিমানঘাঁটি থাকা শহরে প্রথম পৌঁছেছিল। বাংলাদেশী স্বাধীনতা যোদ্ধারা এখন শত্রুদের যোগাযোগের সমস্ত মাধ্যম এবং সবরকম চালান বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল।