You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | যুগান্তর, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, লাকসামের পতন, লক্ষ্য ঢাকা - সংগ্রামের নোটবুক

যুগান্তর
৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
লাকসামের পতন, লক্ষ্য ঢাকা
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ৫ই ডিসেম্বর- বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের লক্ষ্য ঢাকা। আজ কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের জনৈক মুখপাত্র ভারতীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের বলেছেন যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী মুক্তিবাহিনী ও সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় বাংলাদেশের রণাঙ্গনে কয়েকটা উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে।

বাংলাদেশে আজকের জয়লাভের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল লাকসাম, আখাউড়া, বকসিগঞ্জ (ময়মনসিংহ), মিয়াবাজার, পারিকোট, লালবাগ (কুমিল্লা) ও যশোরের কোটচাঁদপুর।

যশোর শহর ও ক্যান্টনমেন্ট ভারতীয় বাহিনীর সাফল্য সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ঐ মুখপাত্র বলেন যে, যশোরকে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ থেকে মাইকে বলা হচ্ছে “আত্মসমর্পণ অথবা মৃত্যু, এর একটি বেছে নাও।” এদিকে ভারতীয় বাহিনী আজ সন্ধ্যায় দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে।

ইস্টার্ণ কম্যান্ডের সামরিক মুখপাত্র আজ বলেছেন, বাংলাদেশে আমাদের অভিযানের সাফল্যের একটা বড় সুবিধা হল যে মুক্তিবাহিনী আগেই বহু এলাকা মুক্ত করে রেখেছেন।

ঐ মুখপাত্র বলেন যে, চট্টগ্রামের দরিয়া এখন ভারতীয় নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী ‘বিক্রান্ত’ কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ঘাঁটিগুলি ধ্বংস করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বাংলাদেশে এখন চারটির বেশী নেই।

ইস্টার্ণ এয়ার কম্যান্ডের অধিনায়ক এয়ার মার্শাল দেওয়ান শিলংয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশের আকাশে এখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর পূর্ণ আধিপত্য। আজ ভারতীয় বিমান বাহিনী ময়মনসিংহের জামালপুরে পাকিস্তানী কলামের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৯০টি সামরিক গাড়ী ও কয়েকশ’ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে নিহত করেছে।

রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন
আখাউড়া ও লাকসামের পতনের ফলে চট্টগ্রাম, ফেনী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, শ্রীহট্ট ও ঢাকার মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

কলকাতায় ইস্টার্ণ কম্যান্ডের মুখপাত্র বলেছেন যে, ১২ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলসের একটি ব্যাটেলিয়ান আখাউড়ায় যুদ্ধ করছিল। তাদের সঙ্গে ট্যাংক ছিল। সকাল সাড়ে ছটায় ভারতীয় বাহিনী চূড়ান্ত আঘাত দিলে আখাউড়ার প্রতিরক্ষা ভেঙ্গে পড়ে। বহু পশ্চিম পাকিস্তানীকে বন্দী করা ছাড়াও ২টি ট্যাংক ও কয়েকটি ফিল্ডগান ভারতীয় সৈন্যদের কাছে ধরা পড়েছে।

কুমিল্লা সেক্টরের মিয়াবাজারে ভারতীয় বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের ২৫ নম্বর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রাইফেলসের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল বেগকে আটক করেছে। তিনি তাঁর সকল সৈন্য ও অস্ত্রশত্র নিয়ে আত্মসমর্পণ করেছেন। লেঃ কর্নেল তাঁর ২৩৫ জন লোক নিয়ে ভারতের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করেছেন।

খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুমুল লড়াই চলছে।
ময়মনসিংহ সেক্টরের মিয়াবাজারে ৩১ নম্বর বালুচ ও ৭১ নম্বর উইং রেঞ্জার্সের ১৬০ জন লোক তাদের অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করেছে। শ্রীহট্ট সেক্টরের মুন্সিবাজার ভারতীয় বাহিনী দখল করেছে। মুন্সিবাজারে ৩০ জন পাকিস্তানী সৈনিককে বন্দী করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী পশ্চিমে হাতিকান্দা ও পুবে নাগেশ্বরী থেকে রংপুরের গুরুত্বপূর্ণ রেল জংশন লালমণিরহাটের দিকে অভিযান করেছে।

হিলি সেক্টরে পাকিস্তানী সৈন্যরা চারখাই, ফুলবাড়ী দখল করে পার্বতীপুরের রেল জংশনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নৌবাহিনীর সাফল্য
ভারতীয় নৌবাহিনীর গোলায় চট্টগ্রামের তৈল শোধনাগারের ক্ষতি হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তর চট্টগ্রাম বন্দরের ধারে কাছে নিরপেক্ষ জাহাজগুলিকে না যাবার নির্দেশ দিয়েছেন।

বিমান বাহিনীর কৃতিত্ব
শিলং-এ ভারতীয় বিমান বাহিনীর মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিগুলির উপর ভারতীয় বিমানগুলি ২৩০ বার আক্রমণ চালিয়ে বিপুল ক্ষতি করেছে। বাংলাদেশে কোন ভারতীয় বিমানের ক্ষতি হয় নি। সবগুলি বিমান নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে এসেছে। তিনি বলে যে, ভারতীয় বিমানগুলি ঢাকা শিল্পাঞ্চলে ও বিমান ঘাঁটির রানওয়েতে ৩৪ বার বোমা ও গুলী মেরে ক্ষতি করেছে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের বিমান ঘাঁটি ও তেজগাঁও বিমান ঘাঁটিতে আজ পাকিস্তানীদের কোন বিমান ওঠানামা করতে পারে নি। কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমানের গোলা দশ ফুট গভীর ও ৩০ বর্গ ফুট পরিমিত এলাকায় গর্ত করেছে। গতকালের হানায় ১৪টি পাকিস্তানী বিমান ধ্বংস হয়েছে। ভারতের ৫টি বিমানের ক্ষতি হয়েছে।

মুক্তিবাহিনীর সাফল্য
মুক্তিবাহিনী ঢাকা থেকে ৩১ কিলোমিটার উত্তরের রেল জংশন টঙ্গী দখল করেছে। ফলে ঢাকা ও ভৈরববাজারের মধ্যে রেল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে মনোহরদি ও নরসিংদী থানাগুলি মুক্তিবাহিনী দখলে এনেছেন। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের পুরা মহকুমায় মুক্তি বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করেছে। এর ফলে ঢাকার পশ্চিম পাকিস্তানীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের রণাঙ্গন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা রাওয়ালপিন্ডিতে এই এস-ও-এস পাঠাচ্ছে যে তাদের অস্ত্র ও গোলা বারুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত সমরসম্ভার পাঠানো হোক। কিন্তু বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে যাতে কোন রসদ না পৌঁছায় সেজন্য ভারত আকাশ ও নৌপথে অবরোধ ব্যূহ রচনা করেছে।
বাংলাদেশে পাক বাহিনী বিচ্ছিন্ন
(দিল্লী অফিস)

৫ই ডিসেম্বর- বাংলাদেশে পাক বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে। ক্রমশ, জল আর স্থলপথে পশ্চিমের সঙ্গে এখন আর কোন যোগাযোগ নেই। এরা এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এখন এদের চাঙ্গা করে তোলার জন্য ইসলামাবাদে তৈরী করা কাহিনী শোনানো হচ্ছে। এদের বলা হচ্ছে অমৃতসর, পুঞ্চ, ছাম্ব আর ফিরোজপুর এখন পাকিস্তানের দখলে। অতএব মুজাহিদের দল ভয় পেওনা, জেগে ওঠো।