আনন্দবাজার পত্রিকা
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১
করাচী ও ঢাকায় বোমাবর্ষণঃ
বাংলাদেশের ১১টি বিমান বন্দরে ভারতীয় বিমানের হানা
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ভারতীয় নৌ-আক্রমণ
৪ঠা ডিসেম্বর- আজ রাত্রে একজন সরকারী মুখপাত্র বলেন যে, গত ১৮ ঘণ্টায় তিনটি মিরাজ এবং দুটি এফ-১০৪ স্টার ফাইটারসহ ৩৩টি পাকিস্তানী বিমান ভূপাতিত অথবা ধ্বংস করা হয়েছে। গত রাত্রে ভারতীয় বিমান ঘাঁটিগুলির ওপর বিনা প্ররোচনায় পাকিস্তানের নির্লজ্জ আকস্মিক আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী গতকাল মধ্য রাত্র থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী প্রায় খতম হয়েছে, আর দুই-তিনটি বিমান সম্ভবত অক্ষত আছে। ভারতীয় বিমান বাহিনী ১১টি বিমান ধ্বংস হয়েছে-৬টি পশ্চিম পাকিস্তানে, ৫টি বাংলাদেশে।
পূর্ব সীমান্তে ময়মনসিংহ জেলার কমলপুর ঘাঁটির পতন ঘটেছে। এই ঘাঁটির ৩১তম বালুচ বাহিনী ও ভেজার্ট রেঞ্জাররা ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। শনিবার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন্দর শহরের ওপর ভারতীয় নৌবহন প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং বাংলাদেশের পাক দখলকৃত এলাকার বন্দরগুলোকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। আজ অপরাহ্ণে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রাম পোতাশ্রয় আক্রমণ করে এবং প্রভূত ক্ষতিসাধন করে।
ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকা-যশোর খণ্ডে ১৭০ বার ঝাঁক বেঁধে গিয়ে আক্রমণ করে ১৪টি বিমান ভূপাতিত করেছে এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হেনেছে।
পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় সৈন্য বাহিনী শত্রু এলাকার ৭ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে খেরি ও নুনিসহ পাকিস্তানের ৯টি গ্রাম দখল করেছে। মেন্ধার খণ্ডের বিপরীত দিকে একটি পাকিস্তানী ঘাঁটি দখল করেছে- এখানে বহু পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ছাম্ব-জোরিয়ান খণ্ডের বিপরিতে মাতোয়ালী শহরটি দখল করেছে।
ভারতীয় বিমান বাহিনী করাচী বন্দর ও নৌবন্দর সারগোধা, পোরকোট প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোর ওপর বোমা ফেলে এসছে। এই সীমান্তে ১৯টি পাক বিমান ধ্বংস করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ৮০ জন পাক সৈন্য ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। হুসেনীওয়ালাতে ১২টি পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক ধ্বংস করা হয়েছে। হুদিয়ারা নালায় এক কন্টিনজেন্ট পাক সৈন্য অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
ঢাকা চট্টগ্রাম করাচি-শত্রুর ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ
বাংলাদেশে চতুর্দিক থেকে জওয়ানেরা আগুয়ান
বরুণ সেন গুপ্ত
যুদ্ধের প্রথম দিনই ভারতীয় সেনা নৌ এবং বিমানবাহিনী বাংলাদেশের দখলদার পাক বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছি। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগোচ্ছে। চূড়ান্ত লক্ষ্য ঢাকা দখল এবং পাক বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। প্রথম দিনের প্রাথমিক ধাক্কাতেই বিভিন্ন সেক্টরে পাক বাহিনী বিপর্যস্ত, বাংলাদেশে পাক বিমান বাহিনীর অর্ধেকের বেশী বিধ্বস্ত এবং জলপথে তারা সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। সর্বত্র ভারতীয় বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন বীর মুক্তিবাহিনী।
এই খবর যখন আপনি পড়ছেন ততক্ষণে পূর্ব বাংলার বহু শত বর্গমাইল এলাকা থেকে পাক সেনাবাহিনী বিতাড়িত। শনিবার সন্ধ্যায়ই সরকারী হিসাবমত ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ভারতীয় বাহিনীর দখলে। কিন্তু এই হিসাব এতক্ষণে অনেক পালটে গিয়েছে। ভারতীয় বাহিনী আরও বহুদূর এগিয়েছেন। শনিবার সকালে যশোর সীমান্তে গিয়েছিলাম। ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক বললেনঃ আজ আমরা যশোর থেকে মাত্র সাত আট মাইল দূরে। কাল সকালে যদি আসেন দেখবেন আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।
তিনটি ভারতীয় বাহিনী তিনভাবে আক্রমণ করেছে। একই সঙ্গে বিমানবাহিনী ভোরেই সমগ্র বাংলাদেশে সবকটি পাক বিমানঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। এই আঘাতে এই দিন তাদের ১৪টি বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে তার মধ্যে ৭টি স্যাবর জেট। এছাড়া আমাদের বিমানগুলি ঢাকা, যশোর, হিলি, লালমনিরহাট, আখাউড়া, কক্সবাজার, মালাপুর প্রভৃতি ১১টি বিমানবন্দরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ওগুলিকে অনেকটা অকেজো করে দিয়ে এসেছে।
আমাদের বিমান বাহিনীর আক্রমণে এইদিন সৈয়দপুরে কয়েকটি পাক সেনা বোঝাই ট্রেন এবং যমুনায় ছ’টি স্টিমারও ধ্বংস হয়েছে।
চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জে তৈল ডিপোর ওপরও প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় ভারতীয় বিমান বাহিনী। দুটো এলাকায়ই এখনও আগুন জ্বলছে। বিমান আক্রমণ চলছে খুলনা স্টিমারঘাটের ওপরও। চট্টগ্রামে দুটি পাক জাহাজও বিধ্বস্ত।
অবশ্য এই ধ্বংসলীলা ছাড়াও পূর্ব বাংলার সমুদ্রপথ পাক বাহিনীর কাছে সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ। কারণ, নৌবাহিনী গোটা বঙ্গোপসাগরে অবরোধ সৃষ্টি করেছেন। সমুদ্রপথে বাংলাদেশের দিকে এগোনো পাক বাহিনীর পক্ষে অসম্ভব। স্বয়ং আই এন এস বিক্রান্ত চট্টগ্রাম বন্দরের মুখে। বিক্রান্ত বিমানবাহী জাহাজ। বিক্রান্ত থেকে বার বার বিমান উড়ে গিয়ে চট্টগ্রাম এবং নারায়ণগঞ্জ আক্রমণ করেছে। একটি পাক বাণিজ্য জাহাজ কলম্বো থেকে সামরিক উপকরণ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। ভারতীয় নৌবাহিনী তাকে আটক করেছে।
বিমান ও নৌবাহিনী যখন গোটা পূর্ব খণ্ডে আক্রমণে পাক দখলদারদের বিধ্বস্ত করছে ঠিক তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব দ্রুত আঘাত হেনে স্থলপথে অগ্রসর হচ্ছে। ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী গোটা পূর্ব বাংলায় পাক ঘাঁটিগুলির ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আর সেনাবাহিনী এগোচ্ছে কতকগুলি নির্দিষ্ট সেক্টর দিয়ে। মূল লক্ষ্য ঢাকা। কতকগুলি এলাকায় পাক বাহিনী শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে। কতকগুলি অঞ্চলে আবার সামান্য যুদ্ধের পরই তারা আত্মসমর্পণ করেছে। ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনী এইদিন প্রচণ্ডভাবে রকেট ব্যবহার করেছে।
এই সার্বিক বিমান আক্রমণের ফলে একদিকে যেমন গোটা বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনী প্রচণ্ড অসুবিধায় পড়েছে, তেমনি সুবিধা হয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর। অগ্রবর্তী ভারতীয় পদাতিক সেনাবাহিনীর ওপর বিমান আক্রমণ চালাবার তেমন ক্ষমতা আর পাক প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেই। এবং পাক ক্যান্টনমেন্ট ও গ্যারিসনগুলির ওপর যখন ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ চালাবে তখন তা প্রতিরোধের ক্ষমতাও পূর্ব বাংলায় পাক বিমান বাহিনীর থাকবে না। এখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আর বিমান আনাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর অগ্রগতি আসলে শুরু হয়েছে শনিবার বেশি রাত থেকে। শনিবার গোটা দিনে তাঁরা প্রধানত আক্রমণের প্রস্তুতি গড়েছেন। এবার চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে থাকবেন।
দর্শনা স্টেশন, ঠাকুরগাঁও, চরখাই, কমলপুর, কুলাউড়া, গাজিপুর এবং চৌদ্দগ্রামের পতন ঘটেছে। এখন ওগুলি ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখলে। সাতক্ষীরা এবং আখাউড়ায় শনিবার বিকেলবেলা প্রচণ্ড লড়াই চলছিল।
আজ যশোর, সিলেট, কুমিল্লা, রাজশাহী, রংপুর প্রভৃতি শহরের ওপর আক্রমণ বাড়বে। শনিবার রাত্রে ভারতীয় সেনাবাহিনী ওই শহরগুলির দিকে এগিয়েছেল।
এছাড়া বাংলাদেশের ভেতরের কতকগুলি শহর থেকেও পাক সেনাবাহিনী দ্রুতগতিতে ক্যান্টনমেন্টগুলির দিকে চলে আসছে। ফলে বরিশাল, ফরিদপুর এবং পটুয়াখালি এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। ওই সব জেলায় আর কোন পাক কর্তৃত্ব নেই।
এই স্থল ও বিমানযুদ্ধে এইদিন বিকাল পর্যন্ত বিভিন্ন সেক্টরে অন্তত তিনশত পাকসেনা নিহত হয়েছে। আর প্রায় একশত আত্মসমর্পণ করেছে। এই চরখাইতেই দু’জন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছে।
আসল স্থলযুদ্ধ অবশ্য হবে আজ রবিবার থেকে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা দফতরের এক মুখপাত্র জানান, এই দিনের যুদ্ধে ভারত চারটি জঙ্গী বিমান হরিয়েছে এবং কিছু সৈন্য মারা গিয়েছে।