হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ই নভেম্বর, ১৯৭১
সামরিক সরবরাহের অসুবিধায় পাক বাহিনী ক্ষতির সম্মুখীন
লেঃ. জেনারেল এল. পি. সেন, ডি. এস. ও.
আমাদের সামরিক প্রতিবেদক
প্রতিটি অভিযানে, কৌশলগত পরিকল্পনার আরোপিত প্রচেষ্টা অর্জনে সমমানের প্রশাসনিক সুব্যবস্থা থাকতেই হবে। এটি নিশ্চিত করতে যদি যত্নসহকারে ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে রণাঙ্গনে অধিনায়ক নিজেকে জয়লাভের সমান সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলে আবিস্কার করবেন এবং এমনকি পরাজয়ের সম্মুখীনও হতে পারেন। এটা মনে রাখতে হবে, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পশ্চিম মরুভূমিতে জার্মানির চৌকস বাহিনী আফ্রিকা কোরের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছিল। এমনকি এই বাহিনীর সুদক্ষ অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল আরউইন রোমেলও, একে রক্ষা করতে পারেননি। বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কি দীর্ঘ সময় ধরে টিকে থাকার সক্ষমতা সহ প্রশাসনিক সুব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে? মুক্তি বাহিনী যেখানে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
অনেক জায়গাতেই এই অনুভূতি রয়েছে যে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা যতটা স্বাস্থ্যকর হওয়া দরকার ছিল ততটা নেই এবং অদুর ভবিষ্যতে পরিস্থিতি তাদের জন্য আরো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। এরকম মনোভাব এই বাস্তবতার উপর নির্ভর করে তৈরী যে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যখন বাংলাদেশের জনগণকে দমন করার সিধান্ত নেয় তখন একটি দীর্ঘ-মেয়াদী অভিযান পরিচালনার পরিপ্রেক্ষিত থেকে তারা চিন্তা করেনি। এটি একটি স্বল্পমেয়াদের ঝটিকা অভিযান হবার কথা ছিল।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, যে তিনটি ডিভিশনকে আকাশ এবং সমুদ্রপথে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আশা হয় তারা তাদের শান্তি-কালীন সরবরাহ ব্যবস্থা সাথে নিয়ে আসে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা নয়।
গত আট মাস ধরে মুক্তি বাহিনী যে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের সীমিত সরবরাহের প্রায় সবটুকু ব্যবহার করতে অবশ্যই বাধ্য হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর সাথে তাদের এই সংঘর্ষ যেহেতু আরো লম্বা সময় ধরে চলবে তাই তাদের সরবরাহের মজুত নিশ্চিত করতে পুনঃসরবরাহ প্রয়োজন হবে। এর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি দীর্ঘ উত্তোলন প্রক্রিয়া প্রয়োজন হবে কিন্তু তাতে কোন সমস্যা হবার কথা নয় যদি ধরে নেয়া হয় যে এ প্রক্রিয়ায় কোনধরণের প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু এই ক্ষেত্রে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে খুব ভালোভাবেই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পেরেছে।
ব্যাপকহারে সড়ক ও রেল ব্রিজ, কালভার্ট এবং ছোটখাটো ব্রিজগুলো ধ্বংস এবং নড়বড়ে করে দেয়ার মাধ্যমে গেরিলারা পাকিস্তানী বাহিনীর জন্য গুরুতর মাথাব্যথার কারণ সৃষ্টি করেছে। মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় স্থানীয় শ্রমিকের সঙ্কট থাকার কারণে এটি উপদ্রবের চেয়েও বেশী বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে।
তবে সড়ক ও রেল ব্রিজ ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে বেশী ক্ষতির কারণ নয়। চট্টগ্রাম, চালনা, মংলা এবং চাঁদপুরের মত বন্দর এলাকায় সমুদ্রগামী জাহাজ এবং আভ্যন্তরীণ নদীতে চলমান জলযানগুলো আক্রান্ত হওয়াতে পাকিস্তানীদের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যশস্য এবং গোলাবারুদ বহনকারী কয়েকটি জাহাজ এবং একটি তেলবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের অরক্ষিত বাহিনীর পক্ষে স্থানীয়ভাবে কিনে খাদ্যশস্যের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এখন আর সম্ভব নয়।
উদাহরণস্বরূপ যশোরের ঘটনাটিই নেয়া যাক। এই সেনানিবাসটি ঢাকা থেকে তার প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর সরবরাহ পেত, প্রধানত গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে এবং আকাশ পথে। সাতক্ষীরায় এই পথের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়ক অবশ্য, পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পরিত্যাগ করতে হয়েছে এবং এই পথের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কুষ্টিয়া জেলার কিছু স্থান যেমন ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গায় কয়েকটি নিশ্চিত পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।
তারপরেও, চালনা বন্দর ব্যবহার করে একটি জরুরী সরবরাহের পথ ছিল। মুক্তি বাহিনীর ডুবুরীরা, অবশ্য এই সপ্তাহের শুরুতে বন্দরের নৌচালনার পথে গ্রীসের একটি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে এই পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। এইদিক দিয়ে যশোরে সরবরাহের পথ তাই, প্রভাবিত হয়েছে এবং এখন হয়তো শুধুমাত্র আকাশপথে বা বিমান থেকে সরবরাহ করার পন্থায় সীমিত থাকতে হবে। এটি একটি খরচান্ত ধরণের রক্ষনাবেক্ষন ব্যবস্থা, বিশেষ করে যখন বিমানের সংখ্যা সীমিত এবং সেগুলোও ভূমি থেকে নিক্ষেপিত গুলির আঘাতে হারানোর সম্ভাবনা সবসময়ই রয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে চট্টগ্রামের অবস্থাও খুব ভালো নয়। বন্দরের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হওয়ার পর থেকেই মুক্তি বাহিনীর কম্যান্ডোরা এই এলাকায় খুবই সক্রিয় রয়েছে। দুটি ছাড়া জাহাজ নোঙ্গর করার আর সবকয়টি স্থানই তারা অচল করে দিয়েছে। একারণে এই বন্দরে ভারী সামরিক সরঞ্জাম নাড়াচাড়া করার সক্ষমতা অনেক কমে গেছে এবং এখানে সবসময়ই এই আশঙ্কা থাকে যে নোঙ্গর করা জাহাজগুলো ডুবুরীদের আক্রমণের শিকার হতে পারে যেকোনো সময়েই।
বিদেশী পতাকাবাহী অনেক জাহাজই ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ঐ জাহাজগুলোর মালিকেরা অত্যন্ত পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে তাদের জাহাজ আর চট্টগ্রাম বন্দরে যাবেনা। তবে এটা হয়তো অপূরণীয় ক্ষতির কারণ নয় কেননা চট্টগ্রামের সাথে চাঁদপুর বা ঢাকার যোগাযোগ রক্ষাকারী আভ্যন্তরীণ সড়কপথ আগে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।
এই ক্ষতবিক্ষত একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যমটি মেরামতের জন্য পাকিস্তান তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে চাঁদপুর পর্যন্ত একটি আভ্যন্তরীণ নদীপথ চালু করার। এটি অবশ্য, খুব একটা সফল হয়নি কেননা কম্যান্ডোরা চাঁদপুরেও সক্রিয় ছিল। চীন থেকে সাম্প্রতিককালে সংগৃহীত একটি সহ সামরিক বাহিনীর জন্য খাদ্য এবং অন্যান্য সরবরাহ বহনকারী মোট চারটি জলযান কিছুদিন আগেই এখানে ডুবিয়ে দেয়া হয়।
মরিয়া হয়ে, পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাদের গানবোটগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে চালনা এবং সাতক্ষীরা এলাকায় চলাচলকারী সব দেশী নৌকাকে গুলি করে ধ্বংস করে দেয়ার। এতে করে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কেননা এই বদ্বীপ এলাকার মানুষ সবসময়ই ভ্রমন এবং মালামাল পরিবহণের জন্য জলপথ ব্যবহার করে আসছে। এতে করে পরবর্তীতে স্থানীয়রা দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হতে পারে।
পাকিস্তান কি তার সরবরাহ ব্যবস্থার অব্যবস্থা সংশোধন এবং পরিস্থিতির উন্নতি সাধন করতে পারবে? বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুক্তি বাহিনীর ক্রমবর্ধমান কার্যক্রমের মধ্যেও এটি করা সম্ভব তবে কাজটি সহজ হবে না। এজন্য পশ্চিম পাকিস্তানের মূল ঘাঁটি থেকে যে দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার যে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থা তা এই কাজটিকে আরো কঠিন করে তুলবে।
তাহলে, পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে? এরকম হতে পারে যে মরুযুদ্ধে রোমেলের সৈন্যদের যে পরিণতি হয়েছিল বাংলাদেশে তারই পুনরাবৃত্তি হবে। মুক্তি বাহিনী ইতিমধ্যেই বালিঘড়ি উল্টে দিয়েছে এবং যদি তারা অতীতের মতো তাদের চাপ বজায় রাখতে পারে তাহলে পাকিস্তানী বাহিনীর সময়ের বালি শেষ হয়ে যাওয়াটা এখন সময়ের ব্যপার মাত্র।