হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড
নয়াদিল্লী ০৩ নভেম্বর ১৯৭১
পাক হাইকমিশনের বেশির ভাগ কর্মচারী স্বাধীনতার জন্য পলায়ন
বিশেষ সংবাদদাতা
নয়াদিল্লী – ০২ নভেম্বর
১১ জন বাঙ্গালী কর্মচারীর ১০ জন পরিবার সহ বেরিয়ে এসেছেন এখানকার পাকিস্তানী হাই কমিশন থেকে, যেটাকে বাংলাদেশী মিশনের প্রধান “কশাইখানা” বলে থাকেন। যিনি বেরিয়ে আসতে পারেন নি তিনি হলেন মি. হোসেন আলী যিনি ভারতে পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মি. আব্দুল গনির ব্যক্তিগত সহকারী। যখন তিনি বেরিয়ে যাবার জন্য প্রধান ফটকের কাছে পৌঁছেছিলেন তখন তাকে পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করে ও টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যায়। মি. হোসেন আলী অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন পাকিস্তানী হাই কমিশনের ভেতরে, তার পাশে ছিলেন তার স্ত্রী ও তিন কন্যা, তাঁর দুটি তরুণ পুত্র অন্যদের সাথে বেরিয়ে এসেছিল। ভেতরে আরো আটকে ছিলেন পাকিস্তানী এয়ার এডভাইজারের ব্যাক্তিগত সহকারী মি. খলিলুদ্দিনের স্ত্রী তাঁর দুই কন্যা ও একটি শিশুপুত্র সহ। প্রায় দুই ঘণ্টা পরে অনুমতি পেয়ে তিনি বেরিয়ে এসে স্বামী ও দুই পুত্রের সাথে মিলিত হন যারা আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন।
যখন বাঙ্গালী কর্মচারীরা সামান্য যা কিছু আনতে পেরেছিলেন তাই নিয়ে পাকিস্তানী হাই কমিশনের বাইরে রাস্তায় বসে ছিলেন এ খবর পেয়ে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এইচ. আর. চৌধুরী তাঁর দুই সহকর্মী মি. কে এম সাহাবুদ্দিন ও মি. আমজাদুল হক-কে সাথে নিয়ে ছুটে এসেছিলেন, তখন পাকিস্তানী হাই কমিশনের ভেতর থেকে পাকিস্তানীরা ইঁট-পাটকেল ছোঁড়া শুরু করে। দেশি-বিদেশী সাংবাদিক ও পুলিশের সাহায্যে মি. চৌধুরী সেই ইঁট -পাটকেল বর্ষণ থেকে নারী ও শিশুদেরকে নিরাপদ জায়গায় পাঠিয়ে দেন। তাঁরা ফটকের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁদের জিনিসপত্র তুলে নিয়ে যান।
পুরো নাটকের শুরু হয় ভোর বেলায় যখন কমিশনের বাঙ্গালী কর্মচারীরা পরিবার পরিজন সহ ফটকের কাছে জড়ো হন। নীচু দেয়াল পেরুনোর আগেই পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মি. আব্দুল গনির উপদেষ্টা ক্যাপ্টেন আজিম দাউদপতা এবং কাশ্মিরে পাকিস্তানী সন্ত্রাসের দায়িত্বে থাকা ফার্স্ট সেক্রেটারী মি. আহমেদ জাবিদ শাহ তাঁদের নিষ্ঠুর ভাবে প্রহার করতে শুরু করে। কিছু কিছু বাঙ্গালী দেয়াল টপকে বেরিয়ে এসে “জয় বাংলা” বলে চিৎকার করতে থাকেন। অন্যরা তাঁদের সন্তানদেরকে দেয়ালের এপারে ছুঁড়ে দেন। এর মধ্যে চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে কিছু পুলিশ ফটকের কাছে জড়ো হন। তখন পাকিস্তানীরা ফটক খুলে বাঙ্গালীদেকে বাইরে আসতে দেয়। কিন্তু মি. হোসেন আলীকে এতই প্রহার করা হয়েছিলো যে তিনি বাইরে আসতে পারেন নি। অন্য বাঙ্গালীরা অভিযোগ করে যে মি. হোসেন আলীকে টেনে হিঁচড়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় ও একটি কক্ষে অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখা হয়। লোক-গননা শেষ হলে দেখা যায় যে মি. হোসেন আলীর পরিবারের সাথে দুই কন্যা ও এক পুত্র সহ মি. খলিলুদ্দিনের স্ত্রীও বেরিয়ে আসতে পারেন নি।
মি. এইচ আর চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন যে পাকিস্তানী হাইকমিশনের সমস্ত বাঙ্গালী কর্মচারীরা গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশ সরকারে যোগ দিতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁদের জোর করে পাকিস্তানী হাইকমিশনের ভিতরে ধরে রাখা হয়। কিছু বাঙ্গালী কর্মচারীরা বেরিয়ে গেলে হাইকমিশনার সমস্ত নিষেধ তুলে নেন ও যাঁরা ইচ্ছে করে তাঁদেরকে পরিবার সহ বেরিয়ে যাবার অনুমতি দেন। মি. চৌধুরী বলেন, এই সিদ্ধান্ত তাঁর উপস্থিতিতেই নেয়া হয়েছিলো যখন তিনি হাই কমিশনের সাথে বোঝাপড়া করেছিলেন, ওই আদেশে তাঁর দস্তখত দেয়া হয়েছিলো। মি. চৌধুরী বলেন ভারত-সরকারকেও পাকিস্তানী হাইকমিশন এই ধারণাই দিয়েছে।
মনে হয় বাঙ্গালিরা এই আদেশ আক্ষরিক অর্থে নিক সেটা পাকিস্তানের হাইকমিশন চায় নি। যখন বাঙ্গালী কর্মচারীরা বলেছে তারা বাংলাদেশ সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদেরকে নির্মমভাবে প্রহার করতে শুরু করে। কিছু কর্মচারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। মি. হোসেন আলী তখনো হাই কমিশনের ভেতরে ছিলেন, তার দুই পুত্র ও অন্যান্য বাঙ্গালী যাঁরা বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, তাঁরা হাইকমিশনের সামনে রাস্তায় সর্বক্ষণ অবস্থান ধর্মঘট করে হোসেন আলী ও তাঁর পরিবারের মুক্তি দাবী করতে থাকেন।
বাংলাদেশ মিশনের প্রধান পাকিস্তানীদেরকে এই মর্মে হুঁশিয়ারী দেন যে, যদি ৪৮ ঘন্টার মধ্যে মি. হোসেন আলীকে মুক্তি দেয়া না হয় তবে বাংলাদেশে একজন পশ্চিম পাকিস্তানীও মুক্তি বাহিনীর হাত থেকে নিরাপদ থাকবে না। বাঙ্গালী কর্মচারীরা চাণক্যপুর পুলিশ স্টেশনে হাই কমিশনের অ-কুটনীতিক কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রহার করার অভিযোগ দাখিল করেন। আন্তর্জাতিক আইনে যে কোন হাই কমিশনের অ–কুটনীতিক কর্মচারীরা দেশের আইন মানতে বাধ্য থাকেন।
হাইকমিশন, যাকে বাঙ্গালীরা বলছেন পাকিস্তানী কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁরা প্রথমেই জনগনের নির্বাচিত আইনসিদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তাঁদের ভাষায়, পাকিস্তান মৃত ও তার কবর হয়ে গিয়েছে। তাঁদের প্রায় সবাই নিশ্চিত করেছেন যে বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর বর্তমান সাফল্যে হাই কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মচারীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।