দি স্টেটসম্যান, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
জাতিসংঘে বিতর্ক শুরু
শরণ সিং কর্তৃক বাংলাদেশ সমস্যার
রাজনৈতিক সমাধান দাবী
জাতিসংঘ সদরদপ্তর, ২৭শে সেপ্টেম্বর – ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ শরণ সিং আজ জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি আহ্বান জানান “ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর চাপ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিতে যে শক্তি প্রয়োগ করে সফল হওয়া যাবে না এবং সামরিক জান্তা ও ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হওয়া জরুরী”, পিটিআই জানায় “আরো খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাকে আমরা অত্যন্ত অদূরদর্শী চিন্তা বলে মনে করি” তিনি বলেন।
“দ্বিপক্ষীয়ভাবে সকল সরকার তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারে তাদেরকে নিশ্চিত করতে যে সামরিক জান্তা এই দমনপীড়ন বন্ধ করবে এবং নির্বাচিত নেতাদের সাথে আলোচনায় বসবে তাদের সম্মতির মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি অর্জন করতে এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে”। মিঃ সিং বলেন শুধুমাত্র এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার মাধ্যমেই শরণার্থীদের ঢল থামানো যাবে এবং ইতিমধ্যেই যারা ভারতে চলে এসেছে তারা তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারবে।
মিঃ শরণ সিং আজ জাতিসংঘে শুরু হওয়া সাধারণ আলোচনা সভায় এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন। ভারত এই বিতর্কের দ্বিতীয় বক্তা যেটি আরো কয়েকদিন ধরে চলবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ব্রাজিল ছিল প্রথম বক্তা। পাকিস্তান অক্টোবর মাসের শুরুতে বক্তব্য রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
একটি বিস্তারিত বক্তব্যে যেটিতে তিনি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্বন্ধে বলেন যার মধ্যে চীনকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদান, ভিয়েতনাম ও মধ্যপ্রাচ্যে নিরস্ত্রীকরণ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ছিল। মিঃ সিং বাংলাদেশের সমস্যা মোকাবেলা বিষয়ে কথা বলেন এবং সেখানে যে এখনো ত্রাসের রাজত্ব বলবত রয়েছে তা জানান।
তিনি সাধারণ সভার নতুন সভাপতি মিঃ আদম মালিক এবং প্রাক্তন সভাপতি নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড হ্যামব্রোকেও ভারতের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
চীনের সদস্যপদ প্রাপ্তির বিষয়ে মিঃ সিং ভারতের মনোভাব দৃঢ়তার সাথে ব্যক্ত করেন যে চীনদেশ একটিই আছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এই বিষয়টি চলমান সভায়ই নিষ্পত্তি হবে। “এখানে একটিই চীনা আসন রয়েছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন সরকার জাতিসংঘের এই আসন দখলে রাখার অধিকারী”, তিনি বলেন। “আমরা সবসময়ই নিশ্চিত ছিলাম যে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপস্থিতি এই সংস্থাটিকে আরো কার্যকর করে তুলবে”। মিঃ সিং বলেনঃ “এই বিষয়ে একটি বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নেয়া আমরা অনেকদিন থেকে স্থগিত করে রেখেছি, আমরা আর গড়িমসি না করি”।
ভিয়েতনাম বিষয়ে মিঃ শরণ সিং আক্ষেপ করে বলেন যে উত্তর ভিয়েতনামের কিছু অংশে পুনরায় বোমাবর্ষণ শুরু হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে প্যারিস এবং অন্যান্যস্থানে আলোচনার ভিত্তিতে “অবিলম্বে ভিয়েতনামের এই নিদারুণ যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটবে যাতে করে মার্কিন ও অন্যান্য বিদেশী সৈন্যরা অবশেষে একটি নির্দিস্ট তারিখের মধ্যে অপসারিত হবে এবং অবশেষে ভিয়েতনামের জনগণ বহিঃশক্তির কোনধরনের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের নিজস্ব ইচ্ছানুযায়ী তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারন করতে পারবে”। তিনি বলেন প্যারিসে প্রদত্ত সাত-দফা প্রস্তাব আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার জন্য একটি যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি প্রদান করেছে বলে মনে হয়।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে মিঃ শরণ সিং আক্ষেপ করে বলেন সাময়িক পদক্ষেপ হিসেবে যে যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া হয়েছিল যাতে করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো জাতিসংঘের দূত মিঃ গুননার জারিং এর মধ্যস্ততায় আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় আসতে পারে তা আগ্রাসীপক্ষের পক্ষে গিয়ে পরিস্থিতি অচল করে দিয়েছে।
মিঃ সিং তাঁর বক্তব্যের বেশীরভাগ সময় উৎসর্গ করেন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আলোচনায় ধারাবাহিকভাবে ঘটনাবলী বিবেচনা করে যার মধ্যে নির্বাচনের ফলাফলও ছিল।
৬-দফা কর্মসূচী
মিঃ শরণ সিং স্মরণ করেন ছয়-দফা কর্মসূচীর কথা, যেটি পূর্ব বঙ্গের জন্য আরো বৃহত্তর মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন বিবেচনা করেছিল এই উদ্দেশ্যে যে বৈষম্য এবং শোষণের পরিসমাপ্তি ঘটবে। “আপাতদৃষ্টিতে এই নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানের শাসকদেরকে এতটাই চমকে দেয় যে তারা পুর্ব অংশের উপর তাদের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতি একে হুমকিস্বরূপ মনে করতে থাকে। এথেকেই তাদের তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া এবং সামরিক শাসন চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পরিস্কার বোঝা যায়”।
মিঃ সিং বলেন যে সেনাবাহিনী পুর্ব বঙ্গে বেসামরিক জনগণের উপর যা করেছে এবং এর বৃহদায়তন আক্রমণে যা এখনো করে যাচ্ছে তা সবাই খুব ভালো করেই জানে। ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল এবং এখনো তা বলবত রয়েছে।
হত্যা, জ্বালাওপোড়াও, ধর্ষন এবং লুটপাট ব্যাপক আকার ধারন করেছে এবং এর অবধারিত পরিণতিই ঘটেছে। মানুষ সন্ত্রাস ও সহিংসতা এড়াতে তাদের যাকিছু ছিল তা ফেলে রেখেই ভারতে পালিয়ে এসেছে। “তাদের সংখ্যা নব্বুই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে এবং এই যাত্রা এখনো অব্যাহত রয়েছে। মানবজাতির ইতিহাসে যেকোনো আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেড়িয়ে শরণার্থীদের এই যাত্রা নজিরবিহীন”।
মিঃ শরণ সিং বলেন, “নিজেদের সবচেয়ে অপরিণামদর্শী এবং প্রাণঘাতী কার্যকলাপের জন্য অন্যদেরকে দোষারোপ করা ছাড়া পাকিস্তানের শাসকেরা আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে যেগুলো আসলে বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। তাদের এই পদক্ষেপগুলো আসলে ঠিক কতটা অকার্যকর তা বোঝা যাবে শরণার্থীদের স্রোতের উপর এগুলোর প্রভাব বিবেচনা করলেই। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সময়ে সময়ে শরণার্থীদেরকে আহ্বান জানিয়েছেন ফিরে যাওয়ার জন্য, কিন্তু ভারতের দিকে স্রোতের মতো শরণার্থীদের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে”।
বেসামরিক বিন্যাস
মিঃ শরণ সিং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে একটি তথাকথিত বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে এমন সব ব্যক্তিদের নিয়ে যাদের প্রতিনিধিত্বমুলক খ্যাতি বলতে প্রায় কিছুই নেই এবং তারা নিছক পুতুল-সম যারা তাদের সামরিক নেতাদের নির্দেশ মানতে বাধিত। একটি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে একইসময়ে দেশদ্রোহী হিসেবে বিবেচনা এবং বিচার করা হচ্ছে। আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করছি যে পাকিস্তানের সরকার গঠন করা যে দলটির অধিকার ছিল সেটিকে নিষিদ্ধ এবং সবধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অর্ধেককে জাতীয় সংসদে আসন গ্রহণ করতে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের মতে ততক্ষণ পর্যন্ত শরণার্থীদের স্রোত থামবে না বা যারা ইতিমধ্যেই ভারতে রয়েছে তারা ফিরে যাবে না যতক্ষন পর্যন্ত না জনগণ দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
মিঃ শরণ সিং বলেন, “মাননীয় মহাসচিব, ইউ থান্ট এবং অন্য অনেক বিশিষ্ট কূটনীতিক, রাজনীতিক এবং জনগণের নেতা সবসময়ই বলে এসেছেন যে সমস্যাটি আসলে রাজনৈতিক”।
তিনি বলেন যে রাজনৈতিক সমাধানের দিকে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে এবং তাঁর সাথে আলোচনা শুরু করতে হবে।
মিঃ শরণ সিং আরো বলেন, “এই পদক্ষেপগুলো ছাড়া, যা পাকিস্তানীরা নিজেরাই নিতে পারে, ঠিক এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আর কিই বা করতে পারে? সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ এই সভা এবং জাতিসংঘের ভিতরের বা বাইরের অন্যসব আন্তর্জাতিক সংস্থা নিতে পারে তা হচ্ছে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার উপর চাপ প্রয়োগ করে বুঝিয়ে দিতে যে শক্তি প্রয়োগ করে সফল হওয়া যাবে না এবং একারণেই, সামরিক জান্তা ও ইতিমধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হওয়া জরুরী। আমরা আরো খারাপ পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাকে অত্যন্ত অদূরদর্শী চিন্তা বলে মনে করি”।