You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.18 | দি স্টেটসম্যান, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিন, ২৪-জাতি সম্মেলনের আহ্বান - সংগ্রামের নোটবুক

দি স্টেটসম্যান, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিন
২৪-জাতি সম্মেলনের আহ্বান
বাংলাদেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে
জানাচ্ছেন আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি

নয়া দিল্লী, ১৮ই সেপ্টেম্বর – বাংলাদেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানকারী ২৪টি দেশের প্রতিনিধিরা আজ এখানে সর্বসম্মতিক্রমে আহ্বান জানান শেখ মুজিবুর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি প্রদানের জন্য যাকে তারা বর্ণনা করেন বাংলাদেশের জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে।

এই তিন-দিনব্যাপী সম্মেলন, যার আলোচনা শুরু হয় বাংলাদেশে যারা নিহত হয়েছে তাদের স্মরণে দুই মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে, বিশ্ববাসী এবং তাদের সরকারদের প্রতি আহ্বান জানায় পাকিস্তানের সামরিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করার জন্য যাতে করে তারা সভ্য সমাজে স্বীকৃত নাগরিক সুবিধা ও মানবিক স্বাধীনতা পরিচালনাকারী সবধরনের আইনের ধারা গভীরভাবে ভঙ্গ করা থেকে বিরত হয়।

এই সম্মেলনের সভাপতি মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রস্তাব, সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় যখন সম্মেলনে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এই প্রস্তাবের প্রতি তাদের সমর্থন জানান।

মিঃ নারায়ণ, তাঁর বক্তব্যে ইঙ্গিত দেন “সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়া, ভারতের বাইরের পৃথিবী”, পাকিস্তানের শাসকদেরকে তাদের অপরাধের জন্য নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সম্মেলনের সবাইকে দ্ব্যর্থহীনভাবে এই শাসকদেরকে নিন্দা জানানোর জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, “অবশ্য শুধুমাত্র নিন্দা জানানোতে কাজ হবে না”। তিনি এতদূর পর্যন্ত বিশ্বাস করেন যে শরণার্থীরা ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দেশে ফিরে যাবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না শেষ পাকিস্তানী সৈন্যটি বাংলাদেশ ত্যাগ করছে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

ভিন্ন ঘটনা
তিনি আরো বলেন, তিনি জানেন যে তাঁর বক্তব্য তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত জাতি-রাষ্ট্র বিভাজনের প্রত্যাশিত দুর্দশার আতঙ্ক উত্থাপন করবে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর প্রতিনিধিদের মনে। কোন বিচক্ষণ ব্যক্তিই তা কখনো চাইবে না, তিনি বলেন, “কিন্তু এক্ষেত্রে এ বিষয়টি সার্বজনীন মনে করা ভুল হবে”। সাম্প্রতিক ইতিহাসে ঘটে যাওয়া অন্য সব ঘটনার চেয়ে বাংলাদেশের ঘটনাটি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভিন্ন।
প্রথমত, পৃথিবীতে পাকিস্তানের মতো অন্য আর কোনো জাতি-রাষ্ট্র নেই যার দুই অংশ ১,০০০ মাইল দূরত্বে বিভক্ত, সমুদ্র দ্বারা নয় – প্রায় ৭০০ মাইল – যেমন মালয়শিয়ার ক্ষেত্রে, বরং ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা। দ্বিতীয়ত, ধর্ম ছাড়া পাকিস্তানের পূর্ব এবং পশ্চিম অংশের মধ্যে কোন মিলই নেই। তৃতীয়ত, পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশ প্রায় ৬০%, পূর্ব অংশে বসবাস করে। চথুর্তত, বেশ কিছু পরিস্থিতির কারণে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা সবসময়ই কতিপয় রাজ্যশাসক পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক অফিসারের হাতে ছিল যার ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তান একটি উপনিবেশে পরিণত হয়।

তারপরেও শেখ মুজিবুর রহমান কখনই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেননি। বরং, শেখ মুজিব প্রকাশ্যে বলেছেন যে, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় কখনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে আলাদা হয়ে যায় না। ফলে, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তিনি গত সাধারণ নির্বাচনে লড়েছেন তা পুর্ন আভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের দাবীর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। তাঁর জয়লাভ অবশ্য, পাকিস্তানের শাসকদেরকে আতঙ্কিত করে তোলে, কেননা এর মানে দাঁড়ায় রাষ্ট্র-ক্ষমতার মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, যেখানে সামরিক-বেসামরিক রাজ্যশাসন ক্ষমতা জনতার হাতে হস্তান্তর এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে যাওয়া। বাকি সবকিছু সাম্প্রতিক ইতিহাসের অংশ এবং মিঃ নারায়ণ বিস্ময় প্রকাশ করেন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবাধ নজিরবিহীন অত্যাচারের মুখে বাঙালীদের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার জন্য তাদেরকে কেউ কিভাবে দোষারোপ করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানীরা মার্চের ২৫-২৬ তারিখের মধ্যরাত থেকে তাদের উপর যা করেছে তারপর বাঙালীদের সামনে আর অন্য কোনো উপায় ছিলনা। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার কোনো দ্বিধা নেই বলতে যে ওদের জায়গায় থাকলে আমিও ঠিক একই কাজ করতাম। বরং, আমার সন্দেহ আছে যে আত্ম-সম্মানজ্ঞান সম্পন্ন যেকোনো ব্যক্তি বা জনগণ পৃথিবীর যেকোনো স্থানে এই ধরণের পরিস্থিতিতে ভিন্ন আচরণ করতো।

“পাকিস্তান আর নেই”
কাজেই, মিঃ নারায়ণ আরো বলেন, এটা পরিস্কারভাবে বুঝতে হবে যে বিশ্ববাসী যে পাকিস্তানকে চিনতো সেই পাকিস্তান আর নেই। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দিন আহমেদকে উদ্ধৃত করে, তিনি বলেন, লাশের পর্বতের নিচে সেই দেশ চাপা পড়ে গেছে।

মানবিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য স্বাগত জানিয়ে মিঃ নারায়ণ প্রতিনিধিদেরকে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় গঠিত সশস্ত্র আন্তর্জাতিক ব্রিগেডের আদলে একটি বাহিনী গঠন করার প্রতি আকর্ষণ করেন। এই বিষয়ে মিঃ আন্দ্রে ম্যালরো, যিনি একজন স্বনামধন্য লেখক হবার পাশাপাশি স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়কার একজন গেরিলা নেতা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে একজন মাকুই নেতাও ছিলেন বলে, তাঁর কাছ থেকে আসা বাঙালী গেরিলাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার প্রস্তাব উষ্ণভাবে স্বাগত জানানো এবং আরো বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত বলে মনে করেন।

মিঃ নারায়ণ আরো প্রস্তাব করেন যে এই সম্মেলনের বিবেচনা করা দরকার “বিশ্বের সরকার গুলোর জন্য কিছু বাস্তব পরিকল্পনা” তৈরী করা, বা এমন কিছু করা যা থেকে আমরা আশা করতে পারি যে তারা কোন না কোন ভাবে বাংলাদেশের সরকার এবং তার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক, রাজনৈতিক এবং বাস্তব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ যার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে তা হচ্ছে “ইসলামাবাদে ক্ষমতায় আসীন হিটলারের সমতুল্য জান্তা যে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে কোনো অংশে কম অধীন করে রাখেনি”, তিনি বলেন।

সিলনের (শ্রীলংকা) মিঃ গুনাবর্ধনে, যিনি এক দশকেরও বেশী সময় ধরে জাতিসংঘে তাঁর দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বলেনঃ “বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান হবে নৈতিকতার জয়, সত্যের জয়”, ইউএনআই আরো জানায়।

তিনি বলেন বাংলাদেশের এই দুঃখজনক ঘটনা সিলনবাসীদেরকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে এবং তারা ওখানে যা ঘটছে তাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে দেখছে না। বাংলাদেশের জনগণ তাদের আত্ম নির্ধারনের অধিকার অনুশীলন করেছে এবং তারা যাতে তাদের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে পারে এটা নিশ্চিত করা বিশ্ববাসীর দ্বায়িত্ব।

মিঃ গুনাবর্ধনে, অন্য আর প্রায় সকল বক্তার মতো বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এবং “দখলদার বাহিনী”-এর একজন সৈন্যও যেন পূর্ব বঙ্গে না থাকে তা নিশ্চিত করতে এবং তাদের অতিপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেনঃ “এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনধরনের সামরিক সমাধান কোনভাবেই থাকতে পারে না এবং এমনকি রাজনৈতিক সমাধানের জন্যও এখন দেরি হয়ে গেছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান”।

“মানুষের মর্যাদা”
নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মিঃ বি. পি. কৈরালা, হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন “যদি বাংলাদেশের বাতি নিভে যায় তাহলে বাকি পৃথিবীরও আরো অনেক বাতি নিভে যাবে তা নিশ্চিত”। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা শুধুমাত্র তাদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে তা নয় বরং তারা তাদের “মানুষের মর্যাদা” বজায় রাখার জন্যও যুদ্ধ করছে।

মিঃ গানি ফাওয়েহিন্মি, নাইজেরিয়ান লইয়ার্স এসোসিয়েশনের প্রতিনিধি, বলেন “বাংলার লাখ লাখ মানুষকে আমরা নিষ্পেষিত হতে দেব না”। তিনি বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানান এটা নিশ্চিত করতে যে বোমা ও গুলি যেন ধ্বংস করতে সক্ষম না হয় বাংলাদেশের জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা কেননা তাঁর ভাষ্যমতে এরা অব্যাহত শোষণের স্বীকার এবং এখন তারা তাদের ন্যায্য দাবীর জন্য লড়ছে।

ওয়ার অন ওয়ান্ট এর সহ-সভাপতি, স্যার জর্জ ক্যাটলিন (যুক্তরাজ্য) বলেন, এই সম্মেলনের উচিত জাতিসংঘের উপর কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা যাতে করে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাগুলো পূর্ন হয় এবং তাদের অবর্ননীয় দুর্দশার পরিসমাপ্তি ঘটে।

প্রফেসর ৎসুয়োশি নারা (জাপান), যিনি জাপানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সম্মেলনে এসেছেন, তিনি বাংলাদেশের এই সমস্যা যাতে করে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মদদে একটি বৃহত্তর এশীয় যুদ্ধে রূপান্তরিত না হয় তা নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানান।

মিঃ ক্লোভিস মাকসুদ (মিশর), যিনি লিবিয়া এবং সুদানেরও প্রতিনিধিত্ব করছেন, বলেন যে বাংলাদেশের এই সমস্যাকে কোনভাবেই পাক-ভারত বিরোধের অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।

এক আবেগপূর্ন বক্তব্যে তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি একটি মানবিক উদ্বেগের বিষয়। পূর্ব বঙ্গের জনগণকে ন্যায়বিচার দিতে অস্বীকার করার মানে হচ্ছে একটি বর্নবাদী নীতি রচনা করা।

মিঃ মাকসুদ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেন বাঙালীদের এই মর্যাদা রক্ষার যুদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের পাশাপাশি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের বিষয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে এটা উপলব্ধি করতেই হবে যে পূর্ব বঙ্গের জনগণকে ন্যায়বিচার দিতে যেকোনভাবে অস্বীকৃতি জানানোর মানে হবে বর্নবাদী ঔপনিবেশকতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা।

তিনি বলেন, ঘটনার প্রকৃত স্বরূপ সচক্ষে দেখার জন্য তিনি আরব বিশ্বের অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে এখানে এসেছেন। আরব দেশগুলো পরিস্থিতি সম্বন্ধে যতটা জ্ঞাত থাকার কথা ততটা ছিল না কেননা তারা তাদের নিজেদের মাতৃভূমি সংক্রান্ত সমস্যাদি নিয়ে গভীরভাবে জড়িত ছিল।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেলিস্ট নামের প্রতিষ্ঠানটি তাদের দুইজন প্রতিনিধি ডেনমার্কের মিঃ নিলসন এবং নরওয়ের মিসেস সিগরিড হাননিসদাল-এর মাধ্যমে, সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিনিধিদের সাথে একাত্ম হয়ে পূর্ব বঙ্গের জনগণকে তাদের আত্ম নির্ধারনের অধিকার অনুশীলন করা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে।

আফগানিস্তানের মিল্লাত অব কাবুল-এর প্রতিনিধি মিঃ হেরদাদ বাঙালীদের আশ্বস্ত করেন যে আফগানিস্তানের জনগণ তাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন পূর্ব বঙ্গের বাঙালীদের শোষণের শিকল ছিঁড়ে ফেলার আকাঙ্ক্ষার প্রতি আফগানিস্তানের জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

ডাঃ হোমার এ. জ্যাক, ওয়ার্ল্ড কনফারেন্স অফ রিলিজিয়ন্স ফর পীস-এর সাধারণ সম্পাদক, তুলনাহীন নিষ্ঠুরতার বর্ননা দেন যে ঘটনাগুলো সম্বন্ধে তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশে তাঁর অবস্থানের সময়।