দি স্টেটসম্যান, ১২ আগস্ট, ১৯৭১
পাক বাহিনীর কৌশলগত পশ্চাৎপসরন
– আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি
মুক্তিযুদ্ধের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার সময় সম্প্রতি বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মি সেক্টর কমান্ডারদের কয়েকজন মনে করেন মুক্তি বাহিনীর কমান্ডো ও গেরিলারা অপারেশনে মুখোমুখি অবস্থানে বেশ কয়েকটি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধে তেমন যুক্ত হয়নি। কমান্ডাররা মনে করেন যে এটি কৌশলগত কারণে হতে পারে।
এটা এখন স্পষ্ট যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা গঠিত এবং তারা পূর্ববাংলার কাদা এবং কাঁটাঝোপে সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন যে প্রবল বর্ষণ পরিস্থিতি চলছে যা যুদ্ধের জন্য ভালো পরিবেশ না। সেনাবাহিনীর বর্তমান কৌশল হতে পারে বর্ষা পরবর্তি মৌসুমের জন্য তারা অস্ত্র ও শক্তি সংরক্ষণ করছে। বর্ষার পরে হয়ত তারা কঠোর আক্রমণ শুরু করবে।
মুক্তিবাহিনী সদর দপ্তরের একটি নোটে কমান্ডাররা বলছেন যে মুক্তি বাহিনীর বর্ষায় আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়াতে হবে যাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পশ্চাদপসরণের ফলে “মুক্ত অঞ্চল” বিস্তৃত হতে পারে। কমান্ডাররা বলেন যে বন্যার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর জাল বজায় রাখার লক্ষ্যে লিবারেশন আর্মি অবকাঠামো অনুযায়ী বুদ্ধিমান পদক্ষেপ নেবে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলি থেকে চলে আসা বাঙালি গানার , সৈন্যরা যোগ দেয়ার ফলে মুক্তি বাহিনী আরও শক্তিশালী হয়েছে। তারা পশ্চিম থেকে এসে লিবারেশন আর্মি হেডকোয়ার্টারে যোগ দিয়েছেন। কমান্ডাররা বলছেন যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এখন একটি সম্পূর্ণ গানার রেজিমেন্ট আছে এবং এটিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা উচিত।
কিন্তু কমান্ডাররা আশঙ্কা করছেন যে, যদি অক্টোবরের মাঝামাঝি বর্ষা শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের যুদ্ধ দীর্ঘদিনের হবে। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। সেনা কর্মকর্তারা মনে করেন যে বর্ষার তিন মাসে যত বেশি সম্ভব অস্ত্র মজুদ করতে হবে এবং সফল অপারেশন শেষ করতে হবে।
মুক্তিবাহিনীর সব কমান্ডার পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের প্রচলিত ও বিশেষ যুদ্ধ কৌশল ট্রেনিং করেছে যা আমেরিকায় ওঁ কিছু ন্যাটো দেশে হয়েছিল। বহু বছর ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে তাদের কাজ করার কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধের আক্রমনের ঘটনায় সেনাবাহিনী যা যা করতে পারে সে ব্যাপারে তাদের আগে থেকে ধারণা আছে।
কমান্ডারদের মতে পাকিস্তানি আর্মির প্রতি ইউনিটের অগ্নি শক্তি লিবারেশন আর্মি বা এমনকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর থেকেও বেশি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমেরিকা ও চীনা কর্তৃক প্রদত্ত সমস্ত স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত। তাদের অস্ত্র স্টক ক্রমাগত চীনা এবং কিছু অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি দ্বারা পূরণ হচ্ছে।
কমান্ডাররা স্পষ্ট শর্তাবলী দিয়ে কেস রেডি করেন। গেরিলাদের জন্য এবং কমান্ডারদের জন্য আরো অস্ত্র প্রয়োজন। সমগ্র বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু আছে। অস্ত্র সরবরাহের ঘাটতির জন্য এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগানো যাচ্ছেনা।
কিছু গেরিলা ইউনিট বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করেছে এবং সেখানে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলিতে প্রশিক্ষণের সুবিধার্থে স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া অসাধারণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণ কিছু সময়ের জন্য অব্যাহত রয়েছে এবং সারা দেশ জুড়ে শক্তিশালী ইউনিট গড়ে উঠেছে, – একটি রিপোর্ট অনুযায়ী এ খবর পাওয়া যায়।
বর্ষা মৌসুমে লিবারেশন আর্মি কে মূলত অগ্রগামী এলাকায় যেতে হবে এবং বাস্তব ক্ষেত্রে সব ইউনিটগুলিকে তাত্ক্ষণিক একশন দরকার। কমান্ডাররা মনে করেন যে সকল সম্ভাব্য উৎস থেকে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। সম্প্রতি, কমান্ডাররা বাংলাদেশ ক্যাবিনেটের সাথে বৈঠক করেছেন এবং যুদ্ধের পরিস্থিতি ও আরও অস্ত্রের প্রয়োজনের উপর জোর দিয়েছেন। প্রচলিত হার্ডওয়্যারগুলির জন্য অত্যাধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল না। তারা বলেছিল যে গেরিলারা লাঠি ও ড্যাগার নিয়ে সুসজ্জিত সশস্ত্র শত্রুদের মুখোমুখি হোক এটা আশা করে না।
বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধকে অন্যত্র অনুরূপ সংগ্রামের সমতুল্য করা উচিত নয়, কারণ প্রথমবারের মত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সমগ্র জনগণ সংগ্রামের সাথে ছিল এবং দ্বিতীয়ত, একটি সম্পূর্ণ প্রশিক্ষিত বাহিনী মুক্তি বাহিনীর সাথে অংশ গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনীতে পদাতিক, বন্দুকবাজ এবং সংকেত ইউনিট এবং বিভিন্ন ধরণের যুদ্ধ, সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য নানা গ্রুপ থাকে।
কিছু কমান্ডার এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন যে তারা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম। তারা আশা করেছিল যে বাংলাদেশ সরকার অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যথাসাধ্য করবে এবং বর্ষা মৌসুমে আরও ভাল ব্যবহার করা হবে। যেহেতু যত অস্ত্র পাওয়া যাবে ততই মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্ব তাদের গর্বিত করবে যেভাবে অন্য কোন সেনাবাহিনী গর্বিত হয়।